Image description
জলাভূমি ভরাট করে নির্মাণ

রাজধানী ঢাকার পূর্ব-পশ্চিমের এলাকাগুলো ভূমিকম্পে প্রচণ্ড রকমের ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ রাজধানীর এই অঞ্চলটি গড়ে উঠছে জলাভূমি ভরাট করে। বালু ফেলে ফেলে ভরাট প্রক্রিয়া প্রতিনিয়ত চলছে, তাতে গড়ে উঠছে বড় বড় দালানকোঠা। পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, নীতিনির্ধারকদের চোখের সামনেই জলাভূমি ভরাট করে ঢাকার সম্প্রসারণ অব্যাহত থাকলেও তা ঠেকানোর যেন কেউ নেই। ১৯৪৭ সাল থেকেই বর্তমান পর্যন্ত ঢাকার ৫০ শতাংশ ভূমি বেড়েছে বন্যাপ্রবাহ অঞ্চল ভরাট করে। ফলে ঢাকার চার পাশে বয়ে চলা নদীগুলো সরু থেকে সরু হয়ে যাচ্ছে। ঢাকায় প্রবাহিত আভ্যন্তরীণ খালগুলোর বেশির ভাগ হারিয়ে গেছে। আবার অনেকগুলো সরু হতে হতে অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলার অবস্থা হয়েছে। ভরাট করে আমরা ঢাকাকে সম্প্রসারণ করে আরো অনেক মানুষের জন্য মাথা গোঁজার ঠাঁই বানিয়েছি ঠিকই, সেই সাথে ঢাকাকে করেছি ভূমিকম্পে ঝুঁকিপূর্ণ একটি শহরে। ঢাকায় অথবা ঢাকার আশপাশে রিখটার স্কেলে ৬ মাত্রা অথবা এর চেয়ে বেশি মাত্রার ভূমিকম্প হলে ঢাকা হয়ে উঠবে একটি ভয়াবহ বিপর্যয়ের শহর বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ পরিকল্পনা ইনস্টিটিউটের বর্তমান সভাপতি ড. আদিল মুহাম্মদ খান। তিনি বলেন, ‘ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেতে যত দ্রুত সম্ভব ঢাকাকে টেকসই পরিকল্পনায় ফিরে আসতে হবে। ঝুঁকি কমানোর জন্য যেখানে যা প্রয়োজন সেখানে তাই করতে হবে।’

ভূমিকম্পসহ অন্যান্য ঝুঁকি মোকাবেলা এবং নানা ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে ঢাকাকে রক্ষা করতে হলে ঢাকায় হাতিরঝিলের মতো ২০টি জলাধারের প্রয়োজন। ১৯৯৫ সালে রাজউক প্রণীত ঢাকা মেট্রোপলিটান ডেভেলপমেন্ট প্ল্যানে (ডিএমডিপি) ঢাকার আটটি বন্যাপ্রবাহ অঞ্চলকে যেমন ছিল সে রকমভাবে সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছিল; কিন্তু নীতিনির্ধারকদের চোখের সামনেই ডিএমডিপি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি।
পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান আরো বলেন, ‘শত বছর আগের গড়ে ওঠা ঢাকার কেন্দ্রীয় অঞ্চল ছাড়া অন্য সব অঞ্চলই ভূমিকম্পে কম-বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। প্রায় সব অঞ্চলই গড়ে উঠেছে নরম মাটিতে। এমনকি উত্তরা থার্ড ফেজ প্রকল্পের ভূমিটুকুও গড়ে তোলা হয়েছে জলাভূমি ভরাট করে।’ ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. মেহেদী আহমেদ আনসারী বলেন, ‘নরম মাটি ভরাট করে শহর গড়ে তোলারও প্রকৌশলগত কিছু পদ্ধতি আছে সেগুলোও ঢাকা তথা বাংলাদেশে মেনে চলা হয় না। নরম মাটিতে মজবুত ভবন তৈরি করতে হলে কিছু বাড়তি খরচ করতে হয়। বাড়িওয়ালা বা আবাসন ব্যবসায়ীরা তা করতে চান না। কারণ, যারা এসব ভবনে বসবাস করবেন তারা কিন্তু এর ঝুঁকি সম্বন্ধে জানেন না। ফলে ঢাকা শহর হয়ে উঠছে ভূমিকম্পে ঝুঁকিপূর্ণ।’

জলাভূমি ভরাট করে ফেলতে ফেলতে ঢাকার পানির স্তর ধীরে ধীরে নিচ থেকে আরো নিচে চলে যাচ্ছে। পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, বর্তমানে ঢাকার ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ এলাকা কংক্রিট দিয়ে আচ্ছাদিত। বৃষ্টি হলে পানি উপর দিয়ে চলে যায়; কিন্তু নিচে গিয়ে পানির স্তরকে ভরাট করতে পারছে না। ঢাকা শহরে আগে যে প্রাকৃতিক ড্রেনেজ সিস্টেম ছিল তা ভরাট হয়ে গেছে। ফলে বৃষ্টি হলেই পানি নিচের দিকে না গিয়ে ঢাকায় সৃষ্টি হচ্ছে জলাবদ্ধতা। তিনি বলেন, আগে একনাগাড়ে ১৫০ থেকে ২০০ মিলিমিটার বৃষ্টি হলে ঢাকার ড্রেন উপচে পানি রাস্তা অথবা ভবনের নিচতলায় উঠে যেত; কিন্তু এখন একনাগাড়ে ৫০ মিলিমিটার বৃষ্টি হলেই পানি উপচে জলাবদ্ধতার কারণ হচ্ছে। ৩০ বছর আগেও এমন অবস্থা ছিল না।
সারা দেশে এক হাজার ২৭২টি পর্যবেক্ষণ কূপের মাধ্যমে ৬০ বছর ধরে পানির পরিমাণ ও গুণমান পর্যবেক্ষণ করছে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। তাদের এক প্রতিবেদন অনুসারে, ঢাকার ভূগর্ভের পানির স্তর প্রতি বছর ২ মিটার বা প্রায় ৭ ফুট করে নেমে যাচ্ছে। বর্তমানে ঢাকায় গড়ে ২৪৬ ফুট নিচে নেমে গেছে পানির স্তর।

পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় বর্তমান ঢাকার ৫০ শতাংশ ভূমিই ছিল বন্যাবিধৌত অঞ্চলের অন্তর্গত। অর্থাৎ বর্ষায় বর্তমান ঢাকার ৫০ শতাংশ এলাকায় একসময় পানি থই থই করত। একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, জলাধারগুলোর যদি হারিয়ে যাওয়ার বর্তমান প্রবণতা অব্যাহত থাকে তাহলে ২০৩১ সালের মধ্যে ঢাকায় কোনো জলাধার থাকবে না, সেটি আকারে ছোট কিংবা বড় হোক। জলাভূমি হারিয়ে গেলে ঢাকা হবে ভূমিকম্পের জন্য আরো বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ পানির স্তর আরো নিচে নেমে যাবে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের তথ্য অনুসারে, একসময় ঢাকায় এক হাজার পুকুর বা জলাধার ছিল। যেগুলোতে বর্ষায় পানি জমা হতো এবং শুষ্ক মৌসুমে মানুষ গোসল করত অথবা অন্য কোনো কাজে সেই পানি ব্যবহার হতো। ভূমিকম্পের ঝুঁকি কমিয়ে আনা সম্ভব এখনো প্রকৌশলগত পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে গেলে।