Image description
বিদেশী সহায়তা হ্রাস প্রসঙ্গে ড. জাহিদ

জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত এই ছয় মাস সময়ের প্রথম তিন মাসে আন্দোলন, অস্থিরতা ও বন্যা এবং অকার্যকর প্রশাসনের কারণে বিদেশী সহায়তার পরিমাণ কমেছে। পরের তিন মাসও যে প্রশাসন সক্রিয় হয়েছে, সেটা তো বলা যাবে না। ফলে এই সময়ে বিদেশী সহায়তার প্রতিশ্রুতি ও ছাড় স্বাভাবিকভাবেই কমেছে বলে মন্তব্য করেছেন বিশ^ব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ও বর্তমানে সরকারের ব্যাংকিং খাতের সংস্কার কমিশনের সদস্য ড. জাহিদ হোসেন।
তার মতে, বিদেশী সহায়তার প্রতিশ্রুতি পাওয়ার জন্য প্রকল্প তৈরি করে নেগোসিয়েশনে যেতে হয়। এখনো তো প্রশাসন স্বাভাবিক পর্যায়ে পৌঁছায়নি। পটপরিবর্তনের পর গত ছয় মাসে বৈদেশিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি ৬৭.১১ শতাংশ কমে যাওয়া নিয়ে দৈনিক নয়া দিগন্তকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন।

ইআরডির তথ্য অনুসারে, বিগত সরকারের পতনের মাধ্যমে পটপরিবর্তনের পর উন্নয়ন সহযোগীদের আর্থিক প্রতিশ্রুতিতে ভাটা পড়েছে। আগের বছরের ৬ মাসের (জুলাই-ডিসেম্বর) তুলনায় বর্তমান সময়ে প্রতিশ্রুতি ৬৭.১১ শতাংশ কমে গেছে। চলতি সময়ে ৪৬৯ কোটি ১২ লাখ ২০ হাজার মার্কিন ডলার কম প্রতিশ্রুতি এসেছে। অর্থছাড়ও আগের বছরের তুলনায় কমেছে। তবে বাংলাদেশের দেনা পরিশোধ গত ছয় মাসে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় বেড়েছে ২৬.৪০ শতাংশ। এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদের সাক্ষাৎকারের বিস্তারিত নিচে-
প্রশ্ন: বিদেশী সহায়তার প্রতিশ্রুতি আগের সরকারের সময়ের তুলনায় কেন এতো কমে যাচ্ছে?
ড. জাহিদ হোসেন: জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত এই ছ’মাস যদি বিবেচনায় নেন, তা হলে সময়টা একেবারেই স্বাভাবিক ছিল না। এর তিন মাস তো আন্দোলন, অস্থিরতা ও বন্যা এবং অকার্যকর প্রশাসনের অধীনে ছিল দেশ। পরের তিন মাসও যে প্রশাসন সক্রিয় হয়েছে, সেটা বলা যাবে না। ফলে এই সময়ে বিদেশী সহায়তার প্রতিশ্রুতি ও ছাড় স্বাভাবিকভাবেই কমার কথা।

প্রশ্ন: প্রকল্প বাস্তবায়নের দুরবস্থার কি কোনো কারণ আছে?
ড. জাহিদ হোসেন: ছ’মাসে আন্দোলনের অস্থিরতা এবং পটপরিবর্তনের কারণে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) চলমান যেসব প্রকল্প ছিল সেগুলো বাস্তবায়ন এক দিকে বাধাগ্রস্ত হয়েছে, অন্য দিকে, প্রকল্প তৈরির কাজও অগ্রসর হতে পারেনি, থমকে ছিল। আগস্টে দেশে একটা সম্পূর্ণ নতুন সরকার দায়িত্বে এসেছে। সেই সরকার এক দিকে যেমন ঘর গুছাচ্ছে, আবার আগুনও তাদেরকে নেভাতে হচ্ছে। এখন পর্যন্ত সরকার এই কাজেই ব্যস্ত। এক দিকে আগুন নেভালে অন্য দিকে জ¦লে উঠে। ফলে প্রকল্প বাস্তবায়নের দিকে তেমন একটা নজর দিতে পারছে না।
অস্থির পরিস্থিতিতে প্রশাসনের ভেতর থেকে খুব বড় ধরনের সহযোগিতা সরকার যে পাচ্ছে সেটা বলা যাবে না। এমনকি রুটিন কাজগুলোও নিয়মিত হচ্ছে না। প্রকল্প তৈরির কাজ ও প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ যদি বাদও দেন, অন্যান্য যেসব কাজ নিয়মিত সকালে আসবেন, কাজ করবেন, ফাইলে সই করবেন, বিকেলে বাড়ি যাবেন, সেটাও তো নেই। এখন বলতে গেলে বসে বসে শুধু আন্দোলন করা হচ্ছে। মহার্ঘ্য ভাতা, পদোন্নতি, পদায়ন এসব নিয়েই তো দিন চলে যাচ্ছে। ফলে উন্নয়ন কর্মসূচির কোনো ধরনের অগ্রগতি হচ্ছে না। আর এটা না হলে প্রকল্প সাহায্যের প্রতিশ্রুতি ও ছাড় পেতেও শ্লথ গতি হবে এটাই স্বাভাবিক। প্রকল্পের কাজে গতি থাকলে উন্নয়ন সহযোগিতা ছাড়ে গতি বৃদ্ধি করে।

প্রশ্ন: যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প প্রশাসন ইসরাইল-মিসর ছাড়া বাকি সব জায়গায় ইউএসএইডের সহায়তা বন্ধের ঘোষণা দিয়েছেন। এই ঘোষণার কোনো প্রভাব কি আমাদের বৈদেশিক সহায়তায় পড়বে?
ড. জাহিদ হোসেন: দ্বিপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে অর্থাৎ ইউএসএইডের মাধ্যমে সরাসরি যেসব অর্থ আসে সেগুলো আপাতত ৯০ দিনের জন্য স্থগিত করা হয়েছে। নব্বই দিন পরে সেগুলোর কী হবে বলা মুশকিল। ট্রাম্প পরের দিন কী করবেন, সেটা আগের রাত ১২টায় আমরা বলতে পারবো না। মার্কিন সহায়তা বন্ধ থাকলে সাহায্যে হয়তো কিছুটা টান পড়তে পারে। এখন তো সবই স্থগিত করেছে। তবে বিশ^ব্যাংকের আইডা’তে তারা যে কন্ট্রিবিউশন করে, আমার মনে হয় না ওইখানে তারা হস্তক্ষেপ করবেন। ট্রাম্প এসেই যেমন বলছিল বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে বেরিয়ে যাচ্ছি। সে দিন আবার বললেন না, আমেরিকা ফিরে আসবে।

২০১৬ থেকে ২০২০ সাল সময়ের মধ্যে ট্রাম্পের যে একটা অবস্থান ছিল যে- আমরা একই অবস্থা দেখতে পারি। যদিও এখন মনে হচ্ছে ট্রাম্প কিছুটা বাস্তবমুখী। বিশ^ থেকে বেরিয়ে গেলে তো আমেরিকা ফার্স্ট থাকবে না। তার নিজের এজেন্ডা বাস্তবায়নে যে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা দরকার, বন্ধুরাষ্ট্র, উন্নয়ন সহযোগী রাষ্ট্রের সমর্থন না থাকলে সে একা চলতে পারবে না। আপনি যদি নেতৃত্ব দিতে চান তা হলে যাদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাদের স্বার্থ তো দেখতে হবে। সব সময় নিজের স্বার্থে কাজ করলে হবে না। ট্রাম্প তো ব্যবসায়ী, লেনদেন বোঝেন। আর তো কিছু বোঝেন ততটা বুঝেন বলে মনে হয় না।
প্রশ্ন: বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বাজেটে এক হাজার ৮২ কোটি ডলারের বেশি বৈদেশিক সাহায্য পাওয়ার যে লক্ষ্যমাত্রা সরকার নিয়েছিল সেটা কতটা অর্জিত হবে বলে আপনি মনে করেন।
ড. জাহিদ হোসেন: বর্তমান পরিস্থিতিতে সেটা অর্জন করা কঠিন হবে। তবে কিছু নেগোসিয়েশন চলমান আছে। প্রশাসন প্রথম ছ’মাসে যতটা নিষ্ক্রিয় ছিল, শেষ ছ’মাসে সেটার উন্নয়ন ঘটবে অবশ্যই। গেলো ডিসেম্বরে বিশ^ব্যাংক থেকে বাংলাদেশ ৫০ কোটি ডলারের একটা সহায়তা পেয়েছে। আর্থিক খাত সংশ্লিষ্ট আরেকটা প্রকল্প নিয়ে বর্তমানে আলোচনা চলছে। আমার মনে হয় দ্রুতই সেই সহায়তা পেয়ে যাবে সরকার। সামনে কয়েকটা বিনিয়োগ প্রকল্পেও অর্থায়ন হবে। প্রতিশ্রুতির ক্ষেত্রে প্রথম ছ’মাসের চেয়ে শেষ ছ’মাসে এসে অঙ্কটা বৃদ্ধি পাবে। তবে ইআরডি লক্ষ্যমাত্রা একটু বেশি করেই ধরে। সেটি অর্জন বেশ কঠিন হয়।