Image description

সৈয়দ আবদাল আহমদ

গাজা থেকে ইসরাইলের দৃষ্টি হঠাৎ কেন ইরানের দিকে? অনেকের মনেই এমন প্রশ্ন। বিশ্বের তুখোড় সামরিক বিশ্লেষকদের বিশ্লেষণ থেকে এর উত্তর পাওয়া গেছে। সিএনএনসহ আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে সামরিক বিশ্লেষকরা তাদের অভিমত তুলে ধরেছেন। তারা ইসরাইল ইরান হামলা ও পাল্টা হামলা এবং পরবর্তী ঘটনা-প্রবাহ বিশ্লেষণ করে বলেছেন, ইরানের সম্ভাব্য পারমাণবিক বোমার ভয়ই নেতানিয়াহুকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছে এবং ইসরাইল গত সপ্তাহে ইরানে নজিরবিহীন হামলা চালিয়েছে। ইরানের পাল্টা হামলার পর প্রতিদিনই সংঘাত বাড়ছে এবং ক্রমেই তা পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে রূপ নিচ্ছে।

গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের খবর, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে। যে কোনো মুহূর্তে পারমাণবিক বোমা ইসরাইলে আঘাত হানার জন্য প্রস্তুত হয়ে যাবে। খবরটি ইসরাইলের কসাই প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর মাথা খারাপ করে দিয়েছে। ঘুম তার হারাম হয়ে গেছে। তড়িঘড়ি করেই তার সিদ্ধান্ত— ইরান আক্রমণ করতে হবে। তাই গাজা এখন তার কাছে বড় বিষয় নয়। যদিও গাজায় হত্যাযজ্ঞ থেমে নেই। কসাই নেতানিয়াহু ২০২৩ সালে ৭ অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত ৫৫ হাজার ৪৩২ জন ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে, যার বেশিরভাগই শিশু ও নারী।

তবে গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের খবরের প্রেক্ষিতে ইসরাইল গত সপ্তাহে ইরান আক্রমণ করলেও পারমাণবিক অস্ত্র সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা তথ্য ভিন্ন। সিএনএন-এর খবরে বলা হয়, মার্কিন গোয়েন্দা তথ্য হচ্ছে ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির মতো অবস্থায় এখনো নেই। পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে ইরানের আরো অন্তত তিন বছর সময় লাগবে। ট্রাম্প প্রশাসনের চারজন কর্মকর্তার বরাতে সিএনএন এ খবর প্রকাশ করলেও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার কর্মকর্তা ও যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থার খবরের সঙ্গে পুরোপুরি একমত হচ্ছেন না। তিনি ইসরাইলের নেতানিয়াহুকে বিশ্বাস করছেন এবং মোসাদের খবরকেই আমলে নিচ্ছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দাদের খবর হচ্ছে ইরান বর্তমানে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করার ঠিক আগের ধাপে রয়েছে। যদি ইরান পারমাণবিক বোমা তৈরি করতে চায় তাহলে এর জন্য যা যা করার তার সবকিছুই তাদের কাছে রয়েছে। অর্থাৎ পারমাণবিক বোমা তৈরির মাল-মসলা ইরানের কাছে মজুত আছে। পারমাণবিক বোমা তৈরির জন্য ইউরোনিয়াম সমৃদ্ধ হতে হয়। এজন্য দরকার হয় সেন্ট্রিফিউজের। ইরানের নাতাঞ্চ পারমাণবিক স্থাপনায় সেই সেন্ট্রিফিউজের মজুত রয়েছে। ইসরাইল নাতাঞ্চ পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালিয়ে এর কিছুটা ক্ষতিসাধন করেছে। কিন্তু ভূ-গর্ভে ইরানের সুরক্ষিত আরেকটি পারমাণবিক স্থাপনা ফরদোর ক্ষতি করার মতো সক্ষমতা ইসরাইলের নেই। এই ফরদোর ক্ষতি করতে হলে যুক্তরাষ্ট্রকে লাগবে অথবা পারমাণবিক চুক্তিতে ইরানকে বাধ্য করতে হবে।

ট্রাম্প ও বাইডেন প্রশাসনে কাজ করা যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য দায়িত্ব পালন করা একজন কূটনীতিক ব্রেট ম্যাকগার্ক সিএনএনকে বলেন, ইসরাইল ইরানের এসব পারমাণবিক স্থাপনায় নজরদারি চালাতে পারে কিংবা এগুলো হামলা করে অকেজো করে দিতে পারে। কিন্তু এগুলো ধ্বংস করতে হলে যুক্তরাষ্ট্রকে হামলা করতে হবে। ম্যাকগার্কসহ আরো কয়েকজন মার্কিন কূটনীতিকের অভিমত হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহায়তা ছাড়া ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা ধ্বংস করা ইসরাইলের পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ ভূগর্ভস্থ এসব স্থাপনা ধ্বংস করার মতো বোমা এবং বোমারু বিমান কেবল যুক্তরাষ্ট্রের কাছেই রয়েছে। আর যুক্তরাষ্ট্রের বোমারু বিমান ‘বি-২’-এর পক্ষেই এসব বোমা দিয়ে হামলা চালানো যায়, যা ইসরাইলের কাছে নেই। সামরিক বিশ্লেষকরাও বলেছেন, শুধু যুক্তরাষ্ট্রের কাছে থাকা এমন বোমারু বিমান এবং ব্যাংকার ধ্বংসকারী বোমা রয়েছে যা ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা বিশেষ করে ভূ-গর্ভের গভীরে থাকা স্থাপনাগুলোতে আঘাত হানতে সক্ষম।

এদিকে ইউএস সেন্ট্রাল কমান্ড যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলসহ সংশ্লিষ্টদের সতর্ক করে দিয়েছে যে, ইরান যদি পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির বিষয়ে তৎপরতা অব্যাহত রাখে তাহলে কয়েক মাসের মধ্যেই তারা সেটা করতে পারবে। জাতিসংঘের পারমাণবিক নজরদারি প্রতিষ্ঠান আইএইএ গত সপ্তাহে ঘোষণা করেছে ইরানের কাছে যে পরিমাণ ইউরোনিয়াম এখন পর্যন্ত মজুত রয়েছে তা দিয়ে ৯টি পারমাণবিক বোমা তৈরি করতে পারবে।

 

অবশ্য মার্কিন গোয়েন্দা তথ্য এবং প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, পারমাণবিক বোমা তৈরির জন্য ইরানের আরো সময় প্রয়োজন হবে। ইচ্ছা করলেই এখন তারা পারমাণবিক বোমা তৈরি করতে পারবে না। তাছাড়া এখনো ইরান পারমাণবিক বোমা তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়নি। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনিও পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির অনুমোদন দেননি। ২০০৩ সালে খামেনি পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির কর্মসূচি স্থগিত করে দেন।

 

বিশ্বের উন্নত সাতটি দেশ জি-৭ এর নেতারা গত সোমবার এক যৌথ বিবৃতিতে ইসরাইল-ইরান সংঘাত থামানোর পরিবর্তে ইসরাইলের প্রতি সমর্থন প্রকাশ করেছেন। তারা হামলাকারী ইসরাইলের পরিবর্তে ইরানকেই দোষারোপ করে বলেছেন, ইরান নাকি মধ্যপ্রাচ্য অস্থিতিশীলতার উৎস।

 

ইসরাইল-ইরান যুদ্ধের কারণে কানাডায় অনুষ্ঠিত জি-৭ সম্মেলন অনেকটা আড়ালে পড়ে যায়। তবে তাদের যৌথ বিবৃতি ইরানের জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা বলেছে, ইরানের অধিকার নেই পরমাণু অস্ত্র তৈরির। অর্থাৎ জি-৭ দেশগুলো সরাসরিই ইসরাইলের পক্ষে দাঁড়িয়ে গেছে।

 

এই সম্মেলনে এসেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি সম্মেলনে পুরোটা সময় থাকেননি। সম্মেলন শেষ হওয়ার আগেই ওয়াশিংটনে চলে যান। তার চলে যাওয়ার পর ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ বলেছিলেন, ইসরাইল-ইরানের মধ্যে যুদ্ধবিরতির জন্যই ট্রাম্প ওয়াশিংটন চলে গেছেন। সেই যুদ্ধবিরতি চুক্তি হলে ফ্রান্স তাতে সমর্থন দেবে। মাখোঁর এই উক্তির পর ট্রাম্প তার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট দিয়ে বলেছেন, ‘মাখোঁ কিছুই জানেন না, আমি কেন ওয়াশিংটনে ফিরে গেছি সেটা হচ্ছে, আমি আরো বড় কারণে ওয়াশিংটনে ফিরেছি।’

 

আগেই উল্লেখ করেছি, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার খবরের চেয়ে ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। তিনি নেতানিয়াহুর কথাকেই প্রাধান্য দিচ্ছেন। ইতোমধ্যে তার বক্তব্যেও তা প্রকাশ পেয়েছে। মঙ্গলবার তিনি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র জানে আয়াতুল্লাহ খামেনি কোথায়? তিনি যেখানেই লুকিয়ে থাকুন তাকে এখনই হত্যা নয়।

 

আয়াতুল্লাহ খামেনি ইসরাইলের কসাই প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর প্রধান টার্গেট। নেতানিয়াহু মনে করেন খামেনি অত্যন্ত ধীরস্থির ও ধৈর্যর সঙ্গে ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্রে সমৃদ্ধ করে চলেছেন। আর বেশি দেরি করলে খামেনিকে থামানো যাবে না। দীর্ঘদিন ধরেই নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তিনি ইরানকে পরাজিত করতে সাহায্যের জন্য আমেরিকাকে টেনে আনতে চান। এ ক্ষেত্রে তিনি সম্ভবত সফল হতে যাচ্ছেন। তার আশা পূর্ণ হওয়ার দ্বারপ্রান্তে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মনে হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রকে এই যুদ্ধে জড়িয়ে ফেলছেন। খামেনিকে হত্যার ক্ষেত্রেও ট্রাম্প একধাপ এগিয়ে গেছেন। তার মুখ দিয়ে খামেনি হত্যার কথা উচ্চারিত হয়েছে। এর আগে নেতানিয়াহু হুমকি দেন খামেনি হত্যার মাধ্যমেই যুদ্ধের শেষ হবে।

 

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বুধবার ইরানের আকাশসীমা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার দাবি করে বলেছেন, আমি ইরানকে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের আহবান জানাই। তার এই বক্তব্যের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স হ্যান্ডলে দেওয়া জাতির উদ্দেশ্যে এক পোস্টে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনি বলেন, আত্মসমর্পণের প্রশ্নই আসে না। ইরান যা কিছু করেছে তা আত্মরক্ষার্থে। ইরান কখনোই জায়নবাদীদের সঙ্গে আপস করবে না। আমরা তাদের প্রতি কোনো দয়া দেখাব না। তিনি ট্রাম্পকে কারবালার ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দেন।

 

ইসরাইলের কসাই প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু আগেই বলেছেন, খামেনিকে হত্যাই যুদ্ধ থামাতে পারে। অর্থাৎ এটা স্পষ্ট যে, এই মুহূর্তে ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম কাজ হতে যাচ্ছে ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনিকে হত্যা করা। এরপর ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা ধ্বংস করা এবং ইরানের পারমাণবিক বোমার হাত থেকে ইসরাইল ও নেতানিয়াহুকে রক্ষা করা। ইসরাইল গত ৫ দিনে ইরানের ১১শ’ লক্ষ্যবস্তুতে হামলা করেছে। আর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইরানের পরমাণু কার্যক্রম বন্ধে কূটনীতির চেয়ে সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণকেই অগ্রাধিকার দিচ্ছেন বলে স্বয়ং মার্কিন সংবাদ মাধ্যম সিএনএন বলেছে।

 

লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, দৈনিক আমার দেশ