Image description

হোসাইন মোহাম্মদ হাই জকী

ধরুন আপনি একটি ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান। আপনার দাদা বহু জমিজমা, ব্যবসা আর সম্পদের মালিক। আপনার বাবা এবং একমাত্র চাচা, দুই ভাই মিলে সেই পারিবারিক সম্পদের দেখভাল করেন। হঠাৎ এক দুর্ঘটনায় আপনার বাবা ঘটনাস্থলেই মারা গেলেন, আর হাসপাতালে কয়েকদিন চিকিৎসার পর আপনার দাদাও পরলোক গমন করলেন। এখন মুসলিম পারিবারিক উত্তরাধিকার আইনের হানাফি মাজহাব অনুযায়ী, যেহেতু আপনার দাদার একজন জীবিত পুত্র (আপনার চাচা) রয়েছেন এবং আপনার বাবা তার আগে মারা গেছেন; আপনার দাদার সমুদয় সম্পদের মালিক এখন আপনার একমাত্র চাচা। আপনারা অর্থাৎ আপনার মা, ভাইবোন এবং আপনি আপনার দাদার বিপুল সম্পত্তিতে কোনো অধিকার পাবেন না। মুসলিম উত্তরাধিকার বিধান মতে আপনার দাদার দৃষ্টিকোণ থেকে আপনি দূরবর্তী আত্মীয় (নাতি) আর আপনার চাচা হলেন তার নিকট আত্মীয় (ছেলে)। যেহেতু আপনার দাদার নিকট আত্মীয় হিসেবে আপনার চাচা জীবিত আছেন, সুতরাং দূরবর্তী আত্মীয় হিসেবে আপনি দাদার সম্পদের উত্তরাধিকারী হবেন না।  এখন আপনাদের অবস্থা একেবারে রাস্তার ভিখারির সমান, সম্পূর্ণ চাচার দয়ার উপর নির্ভরশীল। এ পরিস্থিতি শুধুই একটি কল্পনা নয়, এক সময়ের বাংলাদেশের বহু মুসলিম পরিবারের বাস্তব জীবনের করুণ চিত্র। উত্তরাধিকার আইন সংক্রান্ত এই অসাম্য দীর্ঘকাল ধরে বহু মানুষকে সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে।

১৯৬১ সালে পাকিস্তান আমলে সামরিক শাসক জেনারেল আইয়ুব খান এই বিষয়ে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। তার শাসনামলে প্রণীত Muslim Family Laws Ordinance, 1961 এর ৪ ধারা অনুযায়ী, কোনো সন্তান মারা গেলে তার সন্তান (নাতি বা নাতনি) যেন দাদার সম্পত্তিতে মৃত পিতার প্রাপ্য অংশটি পায়, সেই বিধান করা হয়। হানাফি মাজহাবের ঐতিহ্যগত ব্যাখ্যা অনুযায়ী এটি শরিয়াহ বিরুদ্ধ বলে ধর্মীয় রক্ষণশীল গোষ্ঠী তীব্র প্রতিবাদ করলেও, আইয়ুব খান নিজের প্রগতিশীল অবস্থান থেকে এই আইন বলবৎ রাখেন। এ আইনের ৪ নম্বর ধারা বাস্তবে বহু মুসলিম পরিবারের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ হয়েছে। বহু এতিম নাতি-নাতনি তাদের বাবার অংশটুকু পেয়ে সম্মানের জীবন যাপন করতে পেরেছে। পাকিস্তান আমলের এই উত্তরাধিকার আইনের সংস্কার বর্তমান সময়েও একটি ইতিবাচক সংস্কার হিসেবে বিবেচিত হয় এবং আজ আর কেউ ধর্মীয় ব্যাখ্যা টেনে এই আইনের বিরুদ্ধে কথা বলেন না বা পরিবর্তনের দাবি তুলেন না। 

বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন জাগে, উত্তরাধিকারে নারী-পুরুষের সমান অধিকার নিয়ে আজ যারা ধর্মের দোহাই দিয়ে মেয়েদের বঞ্চিত রাখতে চান, তারা আসলে কারা কারা? মূলত তারা সেই পুরোনো রক্ষণশীল মানসিকতারই ধারক, যারা একসময় ধর্মের দোহাই দিয়ে মৃত পুত্রের এতিম সন্তানদের (নাতিদের) দাদার সম্পত্তির অধিকার দিতেও রাজি ছিলেন না। আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায় নারী-পুরুষের সমান অধিকার কেবল একটি মানবিক দাবি নয়, এটি টেকসই উন্নয়নের পূর্বশর্ত। নারী শিক্ষিত হচ্ছে, কর্মক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিচ্ছে, কিন্তু যখন তারা তাদের জন্মপরিচয়ের ভিত্তিতে পিতার সম্পদে ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হন, তখন এই সমতা প্রতিষ্ঠার বক্তব্যগুলো প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। একটি দেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক মানুষকে পেছনে রেখে কখনও সে দেশটি উন্নত রাষ্ট্র হয়ে উঠতে পারে না।

আমরা প্রায়ই ভারতের হিন্দু সমাজের রক্ষণশীলতার সমালোচনা করি। সেখানে একটি রক্ষণশীল হিন্দু  জাতীয়তাবাদী দল দীর্ঘদিন ধরে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন। অথচ সেই ভারতেও  ২০০৫ সালে Hindu Succession (Amendment) Act পাস করে হিন্দু নারীদের সম্পত্তিতে সমানাধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। হিন্দু আইনে যেখানে কন্যা সন্তানের সম্পত্তির অধিকারই ছিল না, সেই হাজার বছরের বৈষম্যমূলক বিধান সংস্কার করতে ভারত সরকার রাজনৈতিক সাহস দেখিয়েছে। বাংলাদেশের মুসলিম সমাজে যেখানে নারী শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও রাজনৈতিক অংশগ্রহণ বাড়ছে; সেখানে এই আধুনিক যুগে এসে উত্তরাধিকার আইন সংস্কার নিয়ে গোঁড়ামি অগ্রহণযোগ্য। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হয়েও তুরস্ক ১৯২৬ সালে সুইস সিভিল কোড অনুসারে আধুনিক, ধর্মনিরপেক্ষ পারিবারিক আইন প্রণয়ন করেছে যাতে বিবাহ, তালাক, সম্পত্তি এবং উত্তরাধিকারসহ সব ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সম্পূর্ণ সমানাধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। আমাদের রাষ্ট্রীয় আইন হতে হবে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল নাগরিকের জন্য সমান।

পারিবারিক আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিলেই ঈশ্বরের বিধানের উপর হস্তক্ষেপ—এমন একটি ন্যারেটিভ দাঁড় করিয়ে এর বিরোধিতা করা হয়। প্রকৃতপক্ষে এখানে কেউ শরিয়াহর বিরুদ্ধে কথা বলছে না। বরং শরিয়াহর মূল উদ্দেশ্য ন্যায়বিচার, মানবিকতা ও সামাজিক কল্যাণ—এই চেতনাকে সামনে রেখে সময় ও সমাজের চাহিদা অনুযায়ী এই  আইনসমূহের সংস্কার সম্ভব। বাংলাদেশের Muslim Family Laws Ordinance, 1961 এর ৪ নম্বর ধারা একটি সফল উদাহরণ। বর্তমান সামাজিক বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে  আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি আরো বিস্তৃত হওয়া প্রয়োজন। নারী-পুরুষের সমান উত্তরাধিকার নিশ্চিত করতে একটি জাতীয় আলোচনার সূচনা করা যেতে পারে। বিভিন্ন ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ, আইনজ্ঞ, নীতিনির্ধারক ও সাধারণ মানুষ—সবাইকে নিয়ে গঠনমূলক সংলাপের মাধ্যমে এ বিষয়ে ঐকমত্য গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি। হাজার হাজার সাধারণ মানুষ—যারা এসবের কিছুই জানেন না তাদেরকে নিয়ে সমাবেশ ডেকে সেখানে চিৎকার করে হুমকি ধামকি দিয়ে শক্তি প্রদর্শন করে সমাজে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠিত হয় না। বরং পরিবর্তিত সামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে গঠনমূলক আলোচনা থেকেই আসতে পারে দীর্ঘস্থায়ী সমাধান। পিতার সম্পদে সমান অধিকার একজন নারীর জন্য শুধুই টাকা-পয়সার বিষয় নয়, এটি আত্মমর্যাদার প্রতীক। একটি মেয়ে যখন পিতার ঘরে বড় হয়, তখন তার প্রতি পরিবারের দায়িত্ব যেমন থাকে, তেমনি সেই পরিবারের সম্পদের সমান অংশীদারিত্বের অধিকারও তার থাকা উচিত। আর সেখানে কোন বৈষম্য থাকা মানেই নারীকে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক বানিয়ে রাখা। আমরা যদি সত্যিই নারীকে ক্ষমতায়িত করতে চাই, তবে উত্তরাধিকার আইনে সমতা আনা ছাড়া তা সম্ভব নয়। আইন, ধর্ম ও সামাজিক বিবেক—এই তিনের সমন্বয়েই ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা সম্ভব। ইতিহাস থেকে আমরা দেখেছি, ন্যায়ের পথে সাহসী পদক্ষেপ নেওয়া হলে তা-ই শেষ পর্যন্ত টিকে থাকে ও দীর্ঘস্থায়ী হয়।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও গবেষক, সিনিয়র সহকারী সচিব, বাংলাদেশ সরকার। মাস্টার অব ইকনোমিকস অ্যান্ড পাবলিক পলিসি (ডিস্টিংশন), দ্য ইউনিভার্সিটি অব কুইন্সল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া।