
‘ক্ষুধা এবং অভাব আমাদের সেখানে যেতে বাধ্য করে। জানি আমরা যেকোনো সময় আহত বা নিহত হতে পারি। তবুও সেখানে যাই এক কেজি আটা আনতে।’ বলছেন গাজার বাসিন্দা ৩৩ বছর বয়সী মোহাম্মদ আল-কেদরা। বৃটিশ দাতব্য সংস্থা ইউকে-মেড পরিচালিত ফিল্ড হাসপাতালে আনা অনেক রোগীর মধ্যে তিনিও একজন, যারা খাবার চেয়েছিলেন কিন্তু পেয়েছিলেন সহিংসতা।
মোহাম্মদ বলেন, ইসরাইল ও মার্কিন সমর্থিত গাজা হিউম্যানিটেরিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ) পরিচালিত নিকটবর্তী একটি ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রে পরিবারের জন্য খাবার আনতে যাওয়ার সময় তার হাতে ও পায়ে গুলি লাগে। বিবিসিতে কর্মরত একজন সাংবাদিককে তিনি বলেন, ‘আঘাত লাগার পর কেউ একজন আমাকে হাসপাতালে নিয়ে আসেন। মোহাম্মদের কথায়, জিএইচএফ সাইটে পৌঁছানোর চেষ্টা করে তিনি যে ঝুঁকি নিচ্ছেন তা তিনি জানেন, কিন্তু তার কাছে আর কোনো বিকল্প ছিল না।’ দুর্ভিক্ষ আমাদের সকলের বেঁচে থাকা দুর্বিসহ করে তুলেছে। আজ, আমি হাসপাতালে আছি । একবার সুস্থ হয়ে উঠলে, যাই হয়ে যাক না কেন, আমি এই কেন্দ্রগুলোতে আবার যাব। আমি পুরো পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী। বলছেন, গাজার এই হতভাগ্য বাসিন্দা।
জাতিসংঘের মানবাধিকার অফিসের তথ্য অনুযায়ী, গত দুই মাসে খাদ্য সহায়তা পেতে গিয়ে ইসরাইলি সেনাবাহিনীর গুলিতে এক হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে কমপক্ষে ৭৬৬ জনকে জিএইচএফের চারটি বিতরণ কেন্দ্রের আশেপাশে হত্যা করা হয়েছে, যেগুলো মার্কিন বেসরকারি নিরাপত্তা ঠিকাদারদের দ্বারা পরিচালিত এবং ইসরাইলি সামরিক অঞ্চলের অভ্যন্তরে অবস্থিত।
জাতিসংঘ এবং অন্যান্য ত্রাণ কনভয়ের কাছে আরও ২৮৮ জন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। ইসরাইল হামাসকে ত্রাণ কেন্দ্রের কাছে বিশৃঙ্খলা উস্কে দেয়ার জন্য অভিযুক্ত করেছে। তারা বলেছে যে, তাদের সৈন্যরা ইচ্ছাকৃতভাবে বেসামরিক লোকদের গুলি করে না। বৃটিশ প্যারামেডিক স্যাম সিয়ার্স বলেন, উপকূলীয় আল-মাওয়াসির ইউকে-মেড হাসপাতালের জরুরি বিভাগে প্রতি মাসে প্রায় ২,০০০ রোগী ভর্তি হচ্ছেন, যাদের অনেকেই সাহায্য নিতে গিয়ে আহত হয়েছেন। প্রায় এক বছর ধরে হাসপাতালে কর্মরত ফিলিস্তিনি চিকিৎসক ডা. আসিল হোরাবিকে নিজেই এই মারাত্মক সাহায্য কেন্দ্রগুলোতে যেতে হয়েছে, তিনি এটিকে ‘মৃত্যুর পথ’ বলে উল্লেখ করেছেন।
হোরাবি বলছেন, 'আমার স্বামী একবার অথবা দুবার গিয়েছিলেন এবং তারপর গুলিবিদ্ধ হন। এটাই শেষ! যদি আমাদের ক্ষুধায় মারা যেতে হয়, তাহলে তাই শ্রেয়। আমি প্রচুর আহত মানুষকে হাসপাতালে আসতে দেখছি। মাঝে মাঝে আমরা প্রতিদিন ৫০ জন পর্যন্ত আহতকে চিকিৎসা দিচ্ছি। দিনের বেলায়, আমাদের চোখ বন্ধ করে বিশ্রাম নেয়ার, এমনকি এক কাপ চা পান করারও সময় থাকে না।
রাফায় তার বাড়ি ধ্বংস হওয়ার কারণে তার পরিবারের সাথে কাছের একটি তাঁবুতে বসবাসকারী হোরাবি বলেন, এমন অনেক দিন গেছে যেদিন কিছুই হয়তো খাননি। হোরাবির কথায়, আমি এক কেজি আলু কিনেছিলাম যার দাম ছিল ১২০ শেকেল (৩৬ ডলার )। দাম স্বাভাবিক নয়। জিনিসপত্র জোগাড় করা কঠিন। মাত্র এক বেলার খাবারের জন্য আপনি প্রতিদিন ১০০ ডলার কিভাবে জোগাড় করবেন? হাসপাতালে, বর্তমানে রোগীদের কোনও খাবার দেয়া হয় না। যদি খাবার থাকে, তবে রোগীদের অল্প পরিমাণে দেয়া হয়। আমাদের ক্ষুধার্ত রোগীদের সাথে মোকাবিলা করতে হয় এবং আমরাও ক্ষুধার্ত।
বুধবার ১০০টিরও বেশি আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা এবং মানবাধিকার গোষ্ঠী ইসরাইলের বিরুদ্ধে গাজায় ‘অবরোধ’ আরোপের অভিযোগ এনেছে, যার ফলে গাজায় পণ্য প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপের মাধ্যমে ব্যাপক দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্বাহী পরিচালক ডঃ টেড্রোস আধানম ঘেব্রেয়েসাস এ বিষয়ে বলেন, ‘গাজার জনসংখ্যার একটি বিশাল অংশ অনাহারে রয়েছে। এটা মানুষের তৈরি। আর এটা খুব স্পষ্ট। এর কারণ অবরোধ।’
তিনি আরও বলেন,১,০০০ এরও বেশি মানুষ নিজেদের খাবার জোগাড় করতে গিয়ে মারা গেছে। অনাহার মেটাতে তারা তাদের জীবনের ঝুঁকি নিচ্ছে। মার্চের শুরুতে ইসরাইল গাজায় ত্রাণ সরবরাহ সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দেয় এবং দুই সপ্তাহ পর হামাসের বিরুদ্ধে পুনরায় সামরিক অভিযান শুরু করে, যার ফলে দুই মাসের যুদ্ধবিরতি ভেঙে যায়। যদিও প্রায় দুই মাস পর অবরোধ আংশিকভাবে শিথিল করা হয়েছিল, তবুও দুর্ভিক্ষের আশঙ্কার মধ্যে খাদ্য, ওষুধ এবং জ্বালানির ঘাটতি আরও তীব্র হয়ে উঠেছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে যে, ২১ লাখ জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ দুর্ভিক্ষের মতো পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছে এবং প্রায় ১,০০,০০০ নারী ও শিশু তীব্র অপুষ্টিতে ভুগছে। আজাদের হামাস পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে যে রবিবার থেকে অপুষ্টির কারণে কমপক্ষে ৪৫ জন মারা গেছে। বুধবার এক ব্রিফিংয়ে ইসরাইল সরকারের মুখপাত্র ডেভিড মেনসার বলেন, ‘আজ গাজায় ইসরাইলের কারণে কোনও দুর্ভিক্ষ হয়নি। তবে, হামাসের তৈরি মানবসৃষ্ট ঘাটতি রয়েছে। দুর্ভোগের কারণ হল হামাস’।
মেনসার বলেন, গত দুই মাসে ৪,৪০০ টিরও বেশি লরি বোঝাই ত্রাণ গাজায় প্রবেশ করেছে, কিন্তু জাতিসংঘ এবং তার মানবিক অংশীদারদের ত্রাণ লুট করার জন্য দুটি ক্রসিং পয়েন্টে প্রায় ৭০০ লরি অপেক্ষা করছে। এটি গাজায় মানবিক সাহায্যের ধারাবাহিক প্রবাহ বজায় রাখার ক্ষেত্রে প্রধান বাধা। জাতিসংঘের সংস্থাগুলো বলেছে যে ইসরাইলি সেনাদের সাথে তাদের ত্রাণবাহী কনভয়গুলো নিরাপদে নিয়ে যাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছে। যার ফলে ফিলিস্তিনিরা দুর্ভিক্ষের মধ্যে পড়ছে এবং গাজার প্রতিটি পরিবারকে গ্রাস করছে অনাহার।
সূত্র : বিবিসি