
আওয়ামী লীগের জন্য বড় দুঃসংবাদ। ৭৬ বছরের এই পুরোনো রাজনৈতিক দলের সব রাজনৈতিক কার্যক্রম বাংলাদেশে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। শনিবার সাপ্তাহিক ছুটির দিন শেষে রাতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের এক বিশেষ সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ ও এ দলের নেতাদের বিচারকার্য সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত দলটির যাবতীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকবে। বিশেষ সভাটিতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের সংশোধনী প্রস্তাবও অনুমোদন করা হয়। এই সংশোধনীতে রয়েছে ট্রাইব্যুনাল কোনো রাজনৈতিক দল, এর অঙ্গসংগঠন বা সমর্থকগোষ্ঠীকে শাস্তি দিতে পারবে। রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের এই বিশেষ সভায় সভাপতিত্ব করেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সভা শেষে আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল সভার সিদ্ধান্ত সম্পর্কে সরকারের বিবৃতি পড়ে শোনান। তিনি জানান, সোমবার এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি হবে।
আওয়ামী লীগ আগেও দুবার নিষিদ্ধ হয়েছে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান সরকার আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করে। আর ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার একদলীয় বাকশাল প্রতিষ্ঠা করে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে নিজের দল আওয়ামী লীগকেও নিষিদ্ধ করেন। পঁচাত্তরের পটপরিবর্তনের পর জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে অন্যান্য দলের সঙ্গে আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করেছিলেন।
আওয়ামী লীগের কার্যক্রম কেন নিষিদ্ধ করা হলো? উত্তর খুব সহজ। দলটির ফ্যাসিবাদী কার্যক্রমের কারণে। আওয়ামী লীগের শত্রু কে? উত্তর খুব সহজ। আওয়ামী লীগ নিজেই আওয়ামী লীগের শত্রু। আওয়ামী লীগ ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়নি। তাই বড় এবং পুরোনো রাজনৈতিক দল হওয়া সত্ত্বেও ইতিহাসের চরম প্রতিশোধের শিকার হয়েছে আওয়ামী লীগ। ইতিহাসের শিক্ষা হচ্ছে ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না। স্বাধীনতার পর ১৯৭২-৭৫ শেখ মুজিবুর রহমানের ফ্যাসিবাদী শাসনের কারণে আওয়ামী লীগকে এ দেশের মানুষ ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল। শেখ মুজিব নিজেই তার দল ও নৌকাকে ডুবিয়ে দেন। ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করেছিলেন তিনি। আর এবার তারই কন্যা শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগকে দ্বিতীয়বার জবাই করলেন। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের ভাষায় আওয়ামী লীগকে শেখ হাসিনাই কবর দিয়েছেন তার গত পনেরো বছরের নিকৃষ্ট ফ্যাসিবাদের শাসনের মাধ্যমে। ফ্যাসিবাদের ক্ষেত্রে তিনি তার পিতা শেখ মুজিবকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন। দুঃশাসন, খুন, গুম, স্বৈর ও ফ্যাসিবাদী শাসন, দুর্নীতি-লুটপাট, গণতন্ত্র হরণ ও নির্বাচনী ব্যবস্থা ধ্বংস করে দেওয়ার মাধ্যমে দেশে এক জংলি শাসন কায়েম করেছিলেন শেখ হাসিনা। আর নিজেকে তিনি প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন এক দানবীয় শাসক হিসেবে। অসহায় মানুষ নীরবে-নিভৃতে তার অত্যাচারের স্টিম রোলার সহ্য করেছে। কিন্তু কতদিন তা সহ্য করা যায়? ছাত্র-জনতা একদিন ফুঁসে উঠে। শুরু হয় আন্দোলন। মাও সেতুংয়ের ভাষায়, স্ফুলিঙ্গ থেকে সৃষ্টি হয় দাবানল। ৩৬ দিনের জুলাই বিপ্লবের আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায় শেখ হাসিনার তখতে তাউস। প্রাণ বাঁচাতে তিনি ভারতে পালিয়ে যান। শুধু তিনিই নন। তার দলের সব নেতা কেন্দ্রীয় থেকে ইউনিয়ন পরিষদ পর্যন্ত পালিয়ে যান। অনেকে আত্মগোপন করেন। এমনকি শেখ হাসিনার নিয়োগ করা বায়তুল মোকাররম মসজিদের ইমামও পালান। এত বড় ঘটনার পরও বোধোদয় হয়নি শেখ হাসিনা এবং তার দল আওয়ামী লীগের। একটি বারের জন্যও তারা অনুশোচনা করেননি। জনগণের কাছে ভুল স্বীকার করেননি। বলেননি যে, আমাদের ক্ষমা করে দিন, আমরা ভুল করে ফেলেছি। উল্টো ভারতে বসে শেখ হাসিনা উসকানি দিতে থাকেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে। দেশের অভ্যন্তরে একের পর এক অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়। অন্তর্বর্তী সরকারকে, ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে হেয় এবং ব্যর্থ করানোর জন্য একটির পর একটি ষড়যন্ত্র করা হয়। ফ্যাসিবাদ বিরোধী ছাত্র-জনতা আবার ফুঁসে ওঠে। না, আওয়ামী লীগের শিক্ষা হয়নি। তাদের উপযুক্ত শিক্ষা দিতে হবে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের ঠাঁই নেই। ফলে আবার শুরু হয় আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের আন্দোলন। যমুনার সামনে অবস্থান নেয় তারা। এরপর শাহবাগে ব্লকেড। সারা দেশে সভা-সমাবেশ। সব শেষে এক ঘণ্টার আল্টিমেটাম। ফলে সরকারকে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করতে বাধ্য হতে হয়। কী নির্মম পরিহাস! একদিন আওয়ামী লীগ শাহবাগে ফ্যাসিবাদের উত্থান ঘটিয়েছিল, সেই শাহবাগেই তার পতন হলো!
আওয়ামী লীগের জন্ম ও কার্যক্রম
১৯৪৯ সালের ২৩ জুন বিকালে পুরোনো ঢাকার কেএমদাস লেনের রোজ গার্ডেনে নতুন রাজনৈতিক দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ। পরে ‘মুসলিম’ শব্দ বাদ দিয়ে দলের নাম হয় আওয়ামী লীগ।
পাকিস্তান হওয়ার পর ১৯৪৮ সালে ঢাকায় মুসলিম লীগের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতেন মাওলানা আকরম খান এবং খাজা নাজিমুদ্দিন। সোহরাওয়ার্দী-আবুল হাশেম নেতৃত্বাধীন বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের অনুসারী উদারপন্থি নেতারা তখন ছিলেন অবহেলিত। তখন তারা মোঘলটুলিতে ১৫০ নম্বর বাড়িতে এক কর্মিসভা করেন। সেখানেই নতুন দল গঠনের চিন্তা হয়। তখন কলকাতা থেকে সোহরাওয়ার্দীর একনিষ্ঠ ক্যাডার হিসেবে পরিচিত শেখ মুজিবুর রহমান এসে তাদের সঙ্গে যুক্ত হন। মোঘলটুলির ওই সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২৩ জুন ১৯৪৯ প্রায় তিনশ’ রাজনৈতিক নেতাকর্মীর উপস্থিতিতে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর প্রস্তাবে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয়। আর পুরো পাকিস্তানব্যাপী দলের নামকরণ করা হয় ‘নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ।’ এর সভাপতি ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। ঢাকায় রোজ গার্ডেনে মওলানা ভাসানীকে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের কমিটি গঠনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। নতুন ৪০ জনের কমিটির সভাপতি হলেন মওলানা ভাসানী, সহ-সভাপতি আতাউর রহমান খান ও সাধারণ সম্পাদক টাঙ্গাইলের শামসুল হক। শেখ মুজিব ছিলেন কারাগারে। তাকে করা হয় যুগ্ম সম্পাদক। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগকে পরাজিত করে যুক্তফ্রন্ট বিজয় লাভ করে। যুক্তফ্রন্ট পেয়েছিল ২৩৭টি আসনের মধ্যে ২২৩টি আসন। আওয়ামী মুসলিম লীগ পেয়েছিল ১৪৩টি আসন। যুক্তফ্রন্টের প্রধান তিন নেতা ছিলেন মওলানা ভাসানী, একে ফজলুল হক এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। ১৯৫৫ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগের কাউন্সিলে ‘মুসলিম’ শব্দ বাদ দেওয়া হয়।
আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক অসুস্থ হয়ে পড়লে শেখ মুজিবকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক করা হয়। কিন্তু তখনকার রাজনীতিকদের অনেকেরই অভিযোগ, শামসুল হককে শেখ মুজিবের চক্রান্তে অসুস্থ দেখানো হয়েছে। তিনি অসুস্থ ছিলেন না, ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে মুকুল সিনেমা হলে আয়োজিত সাধারণ সম্মেলনে শেখ মুজিবকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়। তিনি ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত এ পদে ছিলেন। শেখ মুজিবসহ তার অনুসারীদের অব্যাহত চক্রান্তে মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগ ছেড়ে দেন কাগমারীতে সম্মেলনের পর। ঢাকার রূপমহল সিনেমা হলে মওলানা ভাসানী ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠন করলে ওইদিন শেখ মুজিবের নেতৃত্বে গুণ্ডারা ইট মেরে মওলানা ভাসানীর মাথা ফাটিয়ে দেয়। ১৯৬৬ সালের পর শেখ মুজিব আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে দলের পুরো কর্তৃত্ব নিজের হাতে নেন। আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার দিন-তারিখ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। সেই দিনটি ছিল ২৩ জুন। এই দিনে ইংরেজদের ষড়যন্ত্রে এবং মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতায় বাংলার স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পতন হয়। সেই দিনটিকে দল হিসেবে আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠায় তখন অনেকেই প্রতিবাদ করেছিলেন। কিন্তু তখন সেটা আমলে নেওয়া হয়নি। আওয়ামী লীগকে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল হিসেবে বলা হলেও মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লীগের নেতাদের সরাসরি অংশগ্রহণ নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। দেশের সর্বস্তরের মানুষ মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে উপস্থিত থেকে মুক্তিযুদ্ধ করলেও আওয়ামী লীগের বেশিরভাগ নেতা কলকাতা শহরে অবস্থান করে আরাম-আয়েশে কাটিয়েছেন। স্বাধীনতা ঘোষণা না দিয়েই শেখ মুজিব স্বেচ্ছায় গ্রেপ্তার হয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে চলে যান। বাংলাদেশ স্বাধীন হলে তিনি বীরের বেশে দেশে প্রত্যাবর্তন করেন।
পাকিস্তান থেকে ফিরে এসে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ মুজিব জাতীয় সরকার গঠনের পরিবর্তে আওয়ামী লীগের সরকার গঠন করে প্রধানমন্ত্রী হন। আবির্ভূত হন স্বৈরাচারী মূর্তিতে। যখন প্রয়োজন ছিল জাতীয় পুনর্গঠনে ব্রতী হওয়া, তিনি জাতিকে দুই ভাগে বিভক্ত করেন। বহুদলীয় গণতন্ত্রের লক্ষ্যে যে দেশ স্বাধীন হয়, সেই দেশে চালু হয় একনায়কতন্ত্র। পরমতসহিষ্ণুতার অভাব থেকে জন্ম নেয় বিচিত্র দমনমূলক ব্যবস্থা। রক্ষীবাহিনী, লালবাহিনী, নীলবাহিনী। অর্থনীতি দেউলিয়া হয়ে পড়ে। দেশে স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি ছিল না। মনুষ্যসৃষ্ট ১৯৭৪ সালের কৃত্রিম দুর্ভিক্ষে মানুষ ছিলেন দিশাহারা। গণতন্ত্র থেকে অনেকদূর সরে যায় আওয়ামী লীগ। অবশেষে শেখ মুজিব সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী এনে গণতন্ত্র দাফন করেন একদলীয় বাকশাল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। তখন দেশ পরিণত হয় খুনের জনপদে। রক্ষীবাহিনীর অত্যাচারে মানুষ চরমভাবে বিপদাপন্ন হয়ে পড়ে। তখনকার বিরোধী রাজনৈতিক দল জাসদের ৩০ হাজার রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে হত্যা করা হয়। গুমের ঘটনাও তখনই চালু হয়। তেমনি চালু হয় বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। বিপ্লবী সিরাজ সিকদারকে হত্যা করে দম্ভ করে সংসদে শেখ মুজিব বলেছিলেন-‘কোথায় আজ সিরাজ সিকদার?’ ফ্যাসিবাদী শাসনের কারণেই শেখ মুজিবের পতন হয়েছিল। আওয়ামী লীগ দীর্ঘ ২১ বছর রাষ্ট্রক্ষমতায় আসতে পারেনি। কিন্তু সেখান থেকে দলটি কোনো শিক্ষা নেয়নি। ১৯৯৬ সালে এবং পরে ২০০৯-২৪ পর্যন্ত ক্ষমতায় প্রায় ২০ বছরেরও বেশি সময় থেকে আওয়ামী লীগ ফ্যাসিবাদকে প্রতিষ্ঠা করে গেছে। বিশেষ করে গত পনেরো বছরে শেখ হাসিনার শাসনামলে ফ্যাসিবাদের নগ্ন অবস্থা দেশের মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে। বিডিআর ম্যাসাকারে ৫৭ জন চৌকস সেনা কর্মকর্তাকে নির্মম হত্যা করা হয়েছে ভারতের স্বার্থে। জুডিশিয়াল কিলিংয়ের নজির স্থাপন করা হয়েছে দেশে। শাপলা চত্বরে ৩০০ জনের বেশি আলেম-ওলামা গণহত্যার শিকার হয়েছেন। মাওলানা সাঈদীর ফাঁসির রায়কে কেন্দ্র করে ২৫০ জন গণহত্যার শিকার হন। তেমনি মোদির সফরকে কেন্দ্র করে গণহত্যা চালানো হয়। জুলাই বিপ্লবে জাতিসংঘ মানবাধিকারবিষয়ক সংস্থার রিপোর্টেই ১৪০০ ছাত্র-জনতা গণহত্যার কথা বলা হয়েছে। রিপোর্টে আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনাকে ফ্যাসিবাদের জন্য দায়ী করা হয়।
দাবানলে উৎখাত আওয়ামী লীগ
আওয়ামী উর্দু শব্দ, অর্থ জনগণ। তাই আওয়ামী লীগের কাছে জনগণের প্রত্যাশা ছিল তারা তাদের প্রত্যাশাকে মূল্য দেবে। কিন্তু জনগণ আওয়ামী লীগের কাছ থেকে বরাবরই উপেক্ষিত হয়েছে। আওয়ামী লীগ ফ্যাসিবাদকে তাদের শক্তিমত্তার প্রধান হাতিয়ার করেছে। রাজনীতির নামে হত্যা, ক্যু, ষড়যন্ত্র এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডকে প্রাধান্য দিয়েছে। শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীকে অবিশ্বাস করতেন। এজন্য সেনাবাহিনী অবহেলিত হয়। তিনি রক্ষীবাহিনী গঠন করেছিলেন এর পাল্টা হিসেবে। আওয়ামী লীগের মদতেই ১৯৮২ সালে জেনারেল এরশাদ ক্যু করে রাষ্ট্রক্ষমতা কুক্ষিগত করেন। শেখ হাসিনা তখন বলেছিলেন, ‘আই অ্যাম নট আন হ্যাপি।’ পরে এরশাদের নির্বাচনে অংশ নিয়ে তাকে বৈধতা দিয়েছিলেন। ১৯৯৬ সালে জেনারেল নাসিমের ‘ক্যু’-এর ইন্ধনদাতাও ছিল আওয়ামী লীগ। তেমনি ১/১১-এর মঈন-মাসুদের জরুরি সরকারের ষড়যন্ত্রের সঙ্গেও ছিল আওয়ামী লীগ। শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘এই সরকার আমাদের আন্দোলনের ফসল।’ এটা আরো স্পষ্ট হয় ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জীর আত্মজীবনীতে। শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় আনতে জেনারেল মঈনকে তিনি কী বলেছিলেন সে কথা লেখা আছে বইটিতে। বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে ১৭৩ দিনের হরতাল করে দেশকে ছারখার করে দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। লগি-বৈঠার তাণ্ডব চালিয়েছিল দলটি। সাপের মতো পিটিয়ে মানুষ হত্যার সেই নগ্ন ফ্যাসিবাদের কথা মানুষ ভুলে যায়নি। এরপর গত ১৫ বছরের ফ্যাসিবাদী কর্মকাণ্ডের সাক্ষী তো আমরা সবাই। একটির পর একটি গণহত্যা, গুমের বিভীষিকা, আয়নাঘর নিয়ে কী বীভৎস্য নির্যাতন!
জুলাই বিপ্লবে আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার পতন হয়। লেখক, গবেষক ও রাজনীতিক বদরুদ্দীন উমর বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে আওয়ামী লীগ সম্পর্কে তার বিশ্লেষণ তুলে ধরেন। বদরুদ্দীন উমরের ভাষায়, ১৯৫৪ সালে মুসলিম লীগ যেভাবে উৎখাত হয়েছে, তেমনি আওয়ামী লীগও ২০২৪ সালে দেশ থেকে উৎখাত হয়েছে। মনে রাখতে হবে একটা দেশে কেন গণঅভ্যুত্থান হয়? সরকার পরিবর্তনের জন্য নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়মিত থাকলে তো আর অভ্যুত্থান হয় না। আওয়ামী লীগ সেই ব্যবস্থা ধ্বংস করে দিয়েছে। মানুষের ওপর ব্যাপক নির্যাতন করে রাজনৈতিক দলগুলোকে পিটিয়ে শেষ করে দিতে চেয়েছিল। এর ফলে ফ্যাসিবাদ পরিবর্তনের তাগিদ জনগণ অনুধাবন করে। ছাত্রদের কোটা আন্দোলনটা ছিল স্ফুলিঙ্গের মতো। জনগণের যে আকাঙ্ক্ষা ছিল সেটার মধ্যে পড়ে দাবানল সৃষ্টি হলো। আওয়ামী লীগের পতন হলো। আওয়ামী লীগ ঘুরে দাঁড়াতে পারে এ সম্ভাবনা আর নেই। মনে রাখতে হবে আওয়ামী লীগ উৎখাত হয়ে গেছে। ইতিহাস আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিয়েছে।
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক