Image description

সৈয়দ আবদাল আহমদ

 

ভারত গত মঙ্গলবার মধ্যরাতের পর পাকিস্তানের অভ্যন্তরে সামরিক হামলা চালায়। ‘অপারেশন সিঁদুর’ নাম দিয়ে চালানো ওই হামলার পরিপ্রেক্ষিতে ভারত-পাকিস্তান সর্বাত্মক যুদ্ধের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, আশু করণীয় হিসেবে পাকিস্তান আজকালের মধ্যে ভারতের অভ্যন্তরে আরো বড় ধরনের পাল্টা হামলা চালাতে পারে। ইতোমধ্যে পাকিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তা কমিটির (এনএসসি) বৈঠকে দেশটির সশস্ত্র বাহিনীকে হামলার জবাব দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ। এরপর রাতে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণেও শাহবাজ শরিফ বলেছেন, ‘ভারতের বিমান হামলায় নিহতদের প্রতিটি রক্তের ফোঁটার বদলা নেওয়া হবে। পাকিস্তান জানে কীভাবে তার প্রতিরক্ষার উপযুক্ত জবাব দিতে হবে।’

পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনী কী ধরনের পাল্টা হামলা চালাতে পারে, এই মুহূর্তে তা অনুমান করা কঠিন। তবে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের পূর্বাভাস হচ্ছে-ক্ষেপণাস্ত্র হামলার আশঙ্কাই বেশি। কারণ গত শনিবার পাকিস্তান স্বল্পপাল্লার ‘আবদালি’ নামে একটি ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়েছে।

স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী ভারত-পাকিস্তান এই মুহূর্তে সর্বাত্মক যুদ্ধে লিপ্ত হলে পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে চীনের অস্ত্র বেশি ব্যবহার করবে। কারণ গত চার বছরে পাকিস্তানে চীনের অস্ত্রভান্ডার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮০ শতাংশ, ২০০০-এর দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত যা ৩৮ শতাংশ ছিল। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া এফ-১৬ যুদ্ধবিমানও পাকিস্তান ব্যবহার করবে। ভারত অস্ত্রের জন্য এক সময় মস্কোর ওপর নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু গত কয়েক বছরে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মিত্রতা গড়ে তুলে তাদের কাছ থেকে অস্ত্র কিনেছে। পাশাপাশি ইসরাইল এবং ফ্রান্সসহ পশ্চিমা দেশগুলোর অস্ত্র কিনছে। ওই অস্ত্র ব্যবহার হতে পারে।

পাকিস্তানের সিনিয়র বিশ্লেষক মাজহার আব্বাস জিও টিভি ও ডন পত্রিকায় বিশ্লেষণে বলেন, ভারত পেহেলগাম হামলায় পাকিস্তানের জড়িত থাকার প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেনি। পাকিস্তান এ হামলায় তার জড়িত থাকার বিষয়টি অস্বীকার করে আন্তর্জাতিক তদন্ত দাবি করেছিল। কিন্তু ভারত সেটাকেও গুরুত্ব দেয়নি। কোনোকিছু যাচাই-বাছাই না করে হামলা করে বসে। ফলে আন্তর্জাতিক সমালোচনার মধ্যে পড়ে ভারত। তারা মঙ্গলবার রাতের আঁধারে পাকিস্তানে হামলা করে। রাতের অন্ধকারে হামলা করা কাপুরুষদের কাজ। এক্ষেত্রে পাকিস্তান ধৈর্য ধরেছে এবং ইতোমধ্যে ভারতকে তিনটি ফ্রন্টে পরাজিত করেছেÑ যুদ্ধ, মিডিয়া এবং কূটনীতি। সমন্বিত এ প্রচেষ্টা চালিয়ে গেলে যুদ্ধ বাঁধলেও পাকিস্তান সফল হবে।

কূটনীতিক মালিহা লোধি ডন ডটকমকে দেওয়া বিশ্লেষণে বলেন, ভারত যে হামলা চালিয়েছে তা আন্তর্জাতিক মহলে চিহ্নিত হয়েছে। এটি দেশটির জন্য গুরুতর সংকট সৃষ্টি করবে। ভারতের হামলার পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তান ভারতের পাঁচটি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করে এবং নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর ভারতীয় পোস্ট ধ্বংস করে আক্রমণের প্রাথমিক জবাব দিয়েছে। এরপর পূর্ণাঙ্গ হামলা চালিয়ে বড় জবাব দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

মালিহা লোদি আরো বলেন, দুই দেশই পারমাণবিক শক্তিধর। এ পরিবেশে আরো উত্তেজনা গুরুতর ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে। অর্থাৎ তিনি বোঝাতে চেয়েছেন-দুই পরমাণু শক্তিধর দেশে যতি এ ধরনের উত্তেজনা বাড়তে থাকে, তবে পারমাণবিক বোমাই হবে ভয়ের কারণ। তিনি বলেছেন, এ ঝুঁকি এড়ানো সম্ভব কি না, তা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে এটি প্রতিরোধে মার্কিন হস্তক্ষেপ দেখতে পাচ্ছি। কারণ ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে অতীতের সংকটগুলো সর্বদা ওয়াশিংটন দ্বারা প্রশমিত করা হয়েছে।

পররাষ্ট্রনীতি বিশেষজ্ঞ মাইকেল কুগেলম্যান অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে বলেন, ভারত-পাকিস্তান দুই দেশেরই শক্তিশালী সেনাবাহিনী রয়েছে। পরমাণু বোমা রয়েছে। তাই বড় যুদ্ধের আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

হামলা যে এখানেই থামছে না, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের বক্তব্যে তা স্পষ্ট। তিনি নিরাপত্তা কমিটির বৈঠকে বলেছেন, জাতিসংঘ সনদের ৫১ অনুচ্ছেদের আওতায় তাদের আত্মরক্ষার অধিকার রয়েছে। ভারতের হামলা উসকানিমূলক ও কাপুরুষোচিত। তারা যে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে তার সমুচিত জবাব তাদের প্রাপ্য। এরই অঙ্গীকার হিসেবে জাতির উদ্দেশে ভাষণে শাহবাজ শরিফ বলেন, প্রতিটি রক্তের ফোঁটার বদলা নেওয়া হবে।

মঙ্গলবার মধ্যরাতে ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের রাজধানী মোজাফফরাবাদ ও পাঞ্জাবের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং মসজিদ লক্ষ্য করে হয়েছে। এতে ২৬ জন নিহত হন। যদিও ভারতের পক্ষ থেকে বলা হয়, তারা সন্ত্রাসী ঘাঁটি লক্ষ্য করে হামলা করেছে।

এই হামলা ও পাল্টা হামলা ভারত-পাকিস্তানকে পূর্ণাঙ্গ একটি যুদ্ধের দিকে নিয়ে যাচ্ছে, যা কাম্য নয়। এ ঘটনায় আন্তর্জাতিক উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন দেশ সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, এ ঘটনা লজ্জাজনক। ভারত ও পাকিস্তান দশকের পর দশক ধরে লড়াই করছে। এখন এটা থামানো উচিত। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও দুই দেশকে সামরিক উত্তেজনা যুদ্ধে রূপ নেওয়ার আগেই শান্তিপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে সমাধা করে ফেলার আহ্বান জানান।

ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে দীর্ঘদিন কোনো কূটনৈতিক আলোচনা হচ্ছে না। ইতঃপূর্বে উত্তেজনাকর পরিস্থিতিগুলো ওয়াশিংটনের চাপে প্রশমিত হয়েছে। এবারও যুক্তরাষ্ট্র নজর দিয়েছে। ফলে পরিস্থিতি যুদ্ধ পর্যন্ত নাও গড়াতে পারে।

১৯৪৭ সালে ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই ভারত ও পাকিস্তান পরস্পর বৈরী। দেশ দুটির মধ্যে কাশ্মীর ইস্যুতেই ১৯৪৭-৪৮ এবং ১৯৬৫ সালে দুটি বড় যুদ্ধ হয়েছে। এরপর ১৯৯৯ সালে কারগিল যুদ্ধেও বিপুলসংখ্যক হতাহতের ঘটনা ঘটে।