Image description
 

গত কয়েকদিন ধরে ঘুমাননি মুকিত শাহ, মোবাইল ফোনে একের পর এক খবর পড়ে যাচ্ছিলেন। ভারত-পাকিস্তান সংকটের খবরেই আটকে ছিলেন।

গত শনিবার তার মা তানভীরা বানুর একটি ফোনকল আসে। সেই ফোনকলই তার মধ্যে এক ধরনের ভয় ধরিয়ে দেয়।

‘বাবা, বাড়িতে চলে আয়। আলাদা থেকে মরার কী দরকার? একসঙ্গে থাকলে অন্তত একসঙ্গে মরতে পারব’— মায়ের এই কথা শুনে ভেঙে পড়েন দিল্লির এক বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৩ বছর বয়সী শিক্ষার্থী মুকিত। তিনি বলছিলেন, মায়ের এই আবেদন তার ভেতরটা একেবারে নাড়িয়ে দেয়।

ঘণ্টাখানেক পর তার ফোনে আরেকটি খবর আসে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জানান, ভারত ও পাকিস্তান ‘সম্পূর্ণ ও তাৎক্ষণিক’ যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে। এরপর দক্ষিণ এশিয়ার দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দেশই যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেয়। যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি দেশের মধ্যস্থতায় এমনটি সম্ভব হয়।

শাহ বলছিলেন, ‘একটা বিশাল স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিলাম। খুশিতে মাকে ফোন করে বলেন, দুই দেশই শান্তিতে পৌঁছেছে। আমরা আবার সময় কাটাব, ভয় পাবে না মা। ’ তখন তার ৪৮ বছর বয়সী মা বলেন, ‘পড়াশোনায় মন দাও, বার্ষিক পরীক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত বাড়ি ফিরতে হবে না। ’

তবে ওই ফোনকলের তিন ঘণ্টা পার হতে না হতেই আবারও ভেঙে পড়ে সেই স্বস্তি। ভারত- নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের শ্রীনগরে ড্রোন হামলার কারণে আবার বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। একই ধরনের হামলা, গুলি ছোড়ার খবর পাওয়া যায় জম্মু, অনন্তনাগসহ রাজস্থান ও গুজরাট সীমান্তের বিভিন্ন জেলা থেকেও।

পাকিস্তানের দিকেও নিয়ন্ত্রণ রেখা (লাইন অব কন্ট্রোল বা এলওসি) বরাবর বেশ কয়েকটি গ্রাম থেকে ভারতীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের অভিযোগ আসে। কাশ্মীরকে বিভক্ত করা এই অনানুষ্ঠানিক সীমান্তের দুই পাশে উত্তেজনা ক্রমেই বাড়তে থাকে।

যদিও পাকিস্তান ও ভারত পরস্পরের অভিযোগ অস্বীকার করে এবং যুদ্ধবিরতিতে অটল থাকার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করে, তবুও প্রশ্ন উঠতে থাকে—পরমাণু শক্তিধর দুই দেশের মধ্যে এই নাজুক চুক্তি আদৌ টিকে থাকবে কি না।

এরইমধ্যে, কান্নায় ভেঙে পড়া বানু আবারও ছেলেকে ফোন করেন।  

‘মাঝেমধ্যে থেমে থেমে কথা বলছিলেন মা, সেই ফাঁকে ফোনের ওপাশে বিস্ফোরণের শব্দ পাচ্ছিলাম, মা তখন কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন। যুদ্ধবিমানের গর্জনও খুব জোরে শোনা যাচ্ছিল। ’

শনিবার রাতে নয়াদিল্লির এক পাড়ায় কাশ্মীরি বন্ধুদের সঙ্গে গা ঘেঁষে বসে থাকা মুকিত আল জাজিরাকে এসব কথা বলছিলেন। নয়াদিল্লি থেকে তার বাড়ির দূরত্ব প্রায় ৮০০ কিলোমিটার (প্রায় ৫০০ মাইল)।

ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পর্যটন শহর পহেলগামে গত মাসে বন্দুকধারীদের হাতে ২৬ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হন। এর ঠিক ১৮ দিন পর সীমান্তের দুই পাশে প্রায় ১৬০ কোটিরও বেশি মানুষ আবারও কাশ্মীর নিয়ে এক নতুন যুদ্ধের আশঙ্কায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। এর আগেও ভারত ও পাকিস্তান কাশ্মীর নিয়ে একাধিকবার যুদ্ধে জড়ায়।

কাশ্মীর মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ হিমালয় অঞ্চলে অবস্থিত। দুই দেশই কাশ্মীর নিজেদের বলে দাবি করে। এই অঞ্চলে দুই দেশেরই আংশিক নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। ভারত নিয়ন্ত্রিত অংশে সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু হয় ১৯৮৯ সালে। সেই থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত কয়েক হাজার মানুষের প্রাণ গেছে— যাদের অধিকাংশই বেসামরিক নাগরিক।  

দিল্লির অভিযোগ, ইসলামাবাদ এই বিদ্রোহে মদদ দিচ্ছে। তবে পাকিস্তান এই অভিযোগ অস্বীকার করে এবং বলে, তারা কেবল কাশ্মীরিদের স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম বা পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার দাবিকে কূটনৈতিকভাবে সমর্থন করে।

কাশ্মীরিরা আবারো মাঝখানে আটকে গেছে

শ্রীনগরের বাসিন্দা আব্বাস আল জাজিরাকে বলেন, তিনি ও তার পরিবার শনিবার রাতে বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পান, যা ছিল ভয়াবহ। আব্বাস শুধু তার নামটুকুই বলেছিলেন। আর কোনো পরিচয় তিনি দেননি।

তিনি বলেন, ‘প্রতিটি বিস্ফোরণ যেন হঠাৎ করেই ঘটে যাচ্ছিল, আর আমাদের মধ্যে ভয় ছড়িয়ে দিচ্ছিল। একজন কাশ্মীরি হিসেবে আগেও কঠিন সময় পার করেছি, কিন্তু এবারকার পরিস্থিতি আলাদা লাগছে। কয়েক রাত ধরে বিস্ফোরণের মাঝেই ঘুম ভেঙে গেলে চারপাশে ছোট ছোট শিশুদের কান্না শোনা যায়। ’

‘এটা যেন আমাদের ওপর এক মানসিক যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। শুধু বিস্ফোরণের ভয় নয়—ভয়ের মূল উৎস হলো এই অনিশ্চয়তা, এই অন্ধকার। কেউ কিছু বলছে না, কেউ কিছু জানাচ্ছে না,’ বলছিলেন আব্বাস। ‘আবারও আমরা কাশ্মীরিরা মাঝখানে আটকে গেছি। আমাদের না আছে আশ্রয়ের জায়গা, না আছে পালানোর পথ। ’

শনিবার সন্ধ্যায় যুদ্ধবিরতির ঘোষণার পর ভারতীয় অংশের সীমান্তবর্তী কয়েকটি জেলায় উৎসবের আমেজ তৈরি হয়। বিশেষ করে যারা চলতি মাসের শুরুতে সীমান্ত উত্তেজনার কারণে ঘরছাড়া হয়েছিলেন, তাদের মধ্যে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফিরে আসে।

পুঞ্চ জেলার ৪০ বছর বয়সী বাসিন্দা দীপক সিংহ। ভারত-শাসিত কাশ্মীরের সীমান্তবর্তী এই জেলা পাকিস্তানের হামলায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার একটি। দীপক ফোনে দেওয়া সাক্ষাৎকারে আল জাজিরাকে বলেন, তার চার সদস্যের পরিবার আশ্রয়কেন্দ্র ছেড়ে নিজ বাড়িতে ফেরার অপেক্ষায় রয়েছে।

তিনি বলেন, ‘আমাদের এমন জীবনের অভিজ্ঞতা, যেখানে সীমান্ত সংঘাতে সব কিছু ওলটপালট হয়ে যায়। তবুও আশা করছি, খুব শিগগিরই বাড়ি ফিরতে পারব। ’

তবে এরপরই শ্রীনগর থেকে বিস্ফোরণের খবর আসে। দুই দেশই যখন একে অপরকে যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের অভিযোগে দোষারোপ করতে থাকে, তখন দীপক পুরোপুরি ভেঙে পড়েন। ‘আবারও সেই একই দৃশ্য। আর কতদিন এই আশ্রয়কেন্দ্রে ঘুমাতে হবে আমাদের? এই যুদ্ধবিরতি আদৌ কি টিকবে?’

এই সময়, ঘটনাস্থল থেকে এক হাজার কিলোমিটারেরও (৬২০ মাইল) বেশি দূরে, ভারতের পশ্চিম দিকের রাজ্য রাজস্থানের সীমান্ত শহর যোধপুরে একই ধরনের উদ্বেগের মধ্যে ছিলেন প্রদ্যোত বর্মা।  

২৬ বছর বয়সী আইনের এই শিক্ষার্থী বলেন, ‘যুদ্ধবিরতির ঘোষণায় শনিবার সন্ধ্যায় এলাকায় খুশির আবহ তৈরি হয়েছিল। কিন্তু তা স্থায়ী হয়নি। রাতেই আবার ব্ল্যাকআউট হয়। সঙ্গে সাইরেন বাজতে শুরু করে, আর স্থানীয়রা পড়ে যায় নতুন করে উৎকণ্ঠার চক্রে। ’

‘যুদ্ধবিরতির ঘোষণা শুনে আমরা উল্লাস করেছিলাম,’ বলছিলেন তিনি। ঘরে অন্ধকারের মধ্যেই বসে তিনি বলেন, ‘ভারতের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বারবার পাকিস্তান থেকে আসা ক্ষেপণাস্ত্রগুলো থামিয়ে দিচ্ছে। আমরা চাই, সেটাই যেন চালু থাকে। ’

‘যুদ্ধের কিনারা থেকে ফেরা’

চার দিনব্যাপী সামরিক উত্তেজনার পর ভারত ও পাকিস্তান যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, ‘দীর্ঘ আলোচনা’র পর এই যুদ্ধবিরতি সম্ভব হয়েছে—যেখানে যুক্তরাষ্ট্রসহ আরও কয়েকটি দেশ মধ্যস্থতা করেছে।

মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও জানান, দুই দেশ একটি নিরপেক্ষ স্থানে বিস্তৃত বিষয় নিয়ে আলোচনা শুরু করতেও সম্মত হয়েছে। তবে ভূরাজনৈতিক ও সামরিক বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, এই যুদ্ধবিরতি ভঙ্গুর এবং এর মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদে তেমন কিছু প্রত্যাশা করা যায় না।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক সুমন্ত্র বোস আল জাজিরাকে বলেন, ‘ভারত এরইমধ্যে মার্কো রুবিওর দাবির প্রতিবাদ জানিয়েছে, দুই দেশ নিরপেক্ষ স্থানে বিস্তৃত বিষয়ে আলোচনা করতে সম্মত হয়েছে। এটি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সরকারের পক্ষে করা সম্ভব নয়, কারণ তারা কাশ্মীর ইস্যুতে একপক্ষীয় অবস্থানে রয়েছে। সরকার পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক আলোচনার বিরোধী। ’ 

এই বিশ্লেষক বলেন, ‘এই যুদ্ধবিরতি গভীর রক্তাক্ত ক্ষতের ওপর শুধু ব্যান্ডেজ লাগানোর মতো— যাতে দ্রুত পচন ধরতে পারত, এমনকি প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারত। যদিও বিদেশি হস্তক্ষেপে সংঘাত আপাতত বন্ধ হয়েছে, তবে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক এবং কাশ্মীর সংকটের অন্যান্য দিক ও গতিপথ একই রকম রয়ে গেছে—বরং আগের চেয়েও তিক্ত ও বিষাক্ত হয়ে উঠেছে। ’

তবে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি বিশ্লেষক মাইকেল কুগেলম্যান জোর দিয়ে বলেন, এই উপমহাদেশ ‘যুদ্ধের কিনারা থেকে ফিরে এসেছে’। তিনি আল জাজিরাকে বলেন, ‘কিছু লঙ্ঘন নিয়েও যুদ্ধবিরতিটি টিকে থাকলে— তা গত কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় আঞ্চলিক নিরাপত্তার হুমকির অবসান ঘটাবে। ’ 

‘এই যুদ্ধবিরতি ধরে রাখা খুবই কঠিন হবে। ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা যখন চরমে, তখন এটি তড়িঘড়ি করে কার্যকর করা হলো,’ বলেন কুগেলম্যান। তিনি আরও বলেন, ‘এটি এমন এক যুদ্ধবিরতি, যেটিকে ভারত ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করছে। ’

তিনি কাশ্মীর নিয়ে ভারতের ঐতিহাসিক অবস্থানের কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘পাকিস্তান যখনই এই ইস্যুকে আন্তর্জাতিকভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছে, ভারত তা বরাবরই প্রত্যাখ্যান করেছে। ’

কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিদ্বন্দ্বী দুই দেশের উত্তপ্ত সীমান্ত অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষের জন্য সতর্ক আশাবাদই এখন একমাত্র ভরসা। ‘এই যুদ্ধবিরতিকে আমরা খুব যত্ন করে আঁকড়ে ধরেছি,’ বলছিলেন এক কাশ্মীরি রাজনৈতিক বিশ্লেষক। তিনি নিজের নাম প্রকাশ করতে চাননি।

তিনি আরও বলেন, ‘যুদ্ধ যারই হোক—ভারত কিংবা পাকিস্তানের—সীমান্ত অঞ্চলের মানুষ, কাশ্মীরি হোক বা পাঞ্জাবি, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে প্রাণ হারাচ্ছে। আমি প্রার্থনা করি, এই পাগলামি যেন এখানেই শেষ হয়। ’