Image description

এক বছর আগে ছিল জুলাই ২০২৪ সাল। দিনগুলো ছিল ঘোরতর অন্ধকার রাত্রির অনুষঙ্গ স্বরূপ। ছিল এক তীব্র আশ্রয়হীনতার বোধ। ভয়ের দোলাচলে কাঁপতে থাকা মানবমণ্ডলীর সামনে ছিল ঘৃণায় বিভক্ত স্বদেশের খণ্ড খণ্ড কুরুক্ষেত্র। এক বছর পরে ২০২৫ সালের জুলাই। ঘন অমানিশার দুর্ভেদ্য অচলায়তনে থেমে থেমে দৃশ্যমান কুসুমিত ইস্পাতের ঝিলিক। হতাশার আস্তরণ। আশার দোলাচল। লক্ষ্যে-অলক্ষ্যে পথ খোঁজার বার্তা।

সকলেই উচ্চকিত ও উচ্চকণ্ঠ। সবাই যার যার এজেন্ডা নিয়ে কলরব তুলেছে। একের কণ্ঠ অন্যের সঙ্গে জট পাকাচ্ছে। কে শোনে কার কথা এই সংকুল কালপর্বে! কে বলে সঠিক কথা এই অস্থিরতায়। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলা যায়:
‘তোমার কথা হেথা কেহ তো বলে না, করে শুধু মিছে কোলাহল
সুধাসাগরের তীরেতে বসিয়া পান করে শুধু হলাহল।’

এই ‘তুমি’ কে? যার কথা কেউ বলে না, শুধু বলে নিজেদের কথা? ‘তুমি’ হলো গণতন্ত্র। একটি বিপ্লবাত্মক পরিস্থিতির পর গণতান্ত্রিক উত্তরণের কথাই উচ্চারিত হওয়া মুখ্য বিষয়। সে কথাগুলো কোলাহলে চাপা পড়ছে। অগ্নিগর্ভ রাজনীতিতে দগ্ধ হচ্ছে। শান্ত, সমাহিত, বিচক্ষণতায় গণতন্ত্রের উত্তরণের বিষয়গুলো যদি এগিয়ে নেয়া না যায়, তাহলে গণতান্ত্রিক আশাবাদ কিনা ব্যাহত হয়, এমন সন্দেহ ও হতাশা কালোমেঘের মতো ঘিরে ধরছে চারপাশ থেকে। চারপাশের পরিস্থিতি ও পরিবেশ দেখে জাগছে আতঙ্ক, ভীতি ও অনিশ্চয়তা।  
এক বছর আগের জুলাইয়ে, অনেকেই ভেবেছিলেন, শঙ্খ ঘোষের কথামালার মতো করে, কিছুটা স্বপ্নে, কিছুটা বাস্তবে, কিছুটা কৌশলে, কিছুটা বুঝে কিংবা না-বুঝে:
‘এসো এই মুমূর্ষুর বুকে রাখো হাত
এর ক্ষীণ রক্ত থেকে তোমার রক্তের দিকে বয়ে যাক দাহ
ঘটুক সংঘাত
দেখো তার মধ্য থেকে ভিন্ন কিছু জেগে ওঠে কি না’
জানি না এই কবিতা রচনার পেছনে কোনো উপলক্ষ কিংবা চিন্তা কাজ করেছিল। হয়তো সমকালীন কোনো আবহ বা প্রপঞ্চ ঘিরে আছে কবিতার শরীর ও সত্তা। কিন্তু বাংলাদেশে কবিতার পাঠমগ্নতা থেকে বাস্তবের ভূমিতল স্পর্শে, আমরা জানি না, সংঘাতের মধ্য থেকে ভিন্ন কিছু জেগে ওঠে বা উঠেছে কি না।
সংঘাতের মধ্যদিয়ে পুরনো অনেক কিছু ধ্বংস হয়, নতুন কিছু জাগে। যেমন, জাগ্রত হয় বহুমাত্রিক পরিবর্তন। সূচিত হয় সংকট থেকে উত্তরণ অথবা নতুন বাস্তবতার দিকে যাত্রা। সমাজে বিদ্যমান অন্যায় বা বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংঘাতই শেষ পর্যন্ত সামাজিক আন্দোলন ও আইন পরিবর্তনের কারণ হতে পারে। ব্যক্তিগত জীবনে সংঘাত আমাদের আরও পরিণত হতে শেখাতে পারে বা ভিন্ন পথে হাঁটার সাহস জোগাতে পারে।

কিন্তু এসব না করে সংঘাত যদি কলহ ও দ্বন্দ্বের বিস্তার ঘটায়, ভ্রাতৃঘাতী দ্বৈরথে লিপ্ত করে মানুষকে, তাহলে রক্তপাত ও ক্ষতির ঘূর্ণাবর্তে আবর্তিত করতেই থাকে, তাহলে ঠিকভাবে সামলাতে পারলে সংঘাতের মধ্যদিয়েই আসে পরিবর্তন, উপলব্ধি এবং নতুন পথের উন্মোচন। আর বেসামাল সংঘাত কেমন পরিণতি আনে?

ইতিহাসে ভাষ্য হলো, সব সংঘাত থেকে গঠনমূলক কিছু জন্মায় না। অনেক সময় সংঘাত হয়ে ওঠে নিঃশেষকারী- ভ্রাতৃঘাতী দ্বন্দ্ব। যেমন মহাভারতে কুরু ও পাণ্ডবদের মধ্যে দেখা যায়। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ গীতার জন্ম দিলেও, সেই পথ রক্তে ভেজা। দুর্যোধনের অহঙ্কার, দ্রৌপদীকে অপমান, বিভেদের বিষ- এগুলোই তো পৌরাণিক সংঘাতকে ঘনীভূত করেছে। ফল হলো মারাত্মক ও ভয়াবহ। ১৮ দিনের মধ্যে এক বিরাট সভ্যতা ভেঙে পড়লো। সুতরাং, যদি সংঘাত অহংকার, প্রতিহিংসা অথবা স্বার্থের দ্বারা চালিত হয়, তবে তা কেবল ধ্বংসের দিকেই নিয়ে যায়। অনেক সংঘাত কেবলই ধ্বংস, রক্ত ও মৃত্যু রেখে যায়।

আমাদের চারপাশে, দৃশ্যমান ও অদৃশ্য, দ্বন্দ্ব-সংঘাতের মধ্যদিয়ে সত্যিই কিছু জাগছে? জাগ্রত হয়েছে আমাদের অন্তর্দৃষ্টি, পরিবর্তন, উপলব্ধি, এমনকি সৃজনশীলতা? এমন প্রশ্নের উত্তর নেই। আশা আছে শুধু: সংঘাতের মধ্যদিয়ে যদি জন্ম নেয় বিবেক, ধ্বংসের ছায়ায় যদি প্রলম্বিত হয় মানুষ চেতনার দীপ্তি এবং অন্ধকারের বুক চিরে যদি আলো আসে চুপিসারে, তাহলেই আসবে নতুন ভোর।

এই আশার বাণী শুনতে অপেক্ষমাণ সবাই। যেমন অপেক্ষা করেছিল কালো আফ্রিকা। সবচেয়ে গভীর ক্ষত থেকে পেয়েছিল সবচেয়ে গভীর উপলব্ধি। দুঃখকে রূপান্তর করতে পেরেছিল ঘুরে দাঁড়াবার শক্তি-স্বরূপে। নেলসন ম্যান্ডেলা ২৭ বছর জেল খেটে দুঃখকে ঘৃণায় রূপ না দিয়ে রূপান্তর করেছিলেন ক্ষমা ও পুনর্মিলন-এ। হলোকাস্ট বেঁচে যাওয়াদের অনেকেই পরবর্তীতে মানবাধিকারের পক্ষে দাঁড়ান। মানুষ এভাবেই সংঘাত ও যন্ত্রণার অভিজ্ঞতায় আত্মবোধ ও দায়বদ্ধতার প্রতিচিত্র নির্মাণ করেছে ইতিহাসের নানা পর্বে।

যারা সংঘাত ও অন্ধকারের ঘূর্ণিপাকে নিমজ্জিত না হয়ে একে ইতিহাসের আয়না হিসেবে দেখেছে, তারাই উত্তরণ ঘটিয়েছে। সংঘাত যাদের ভেতরে সত্য জানার ও বুঝার আকাঙ্ক্ষা জন্ম দিয়েছে, তারা একদিন রচনা করেছে ইতিবাচকতার বিকল্প ভবিষ্যৎ। জার্মানি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর নাৎসি ইতিহাস অস্বীকার না করে, তারা সাহসের সঙ্গে সেটার মুখোমুখি হয়েছে। তারা শিক্ষা নিয়েছে কীভাবে একটা জাতিকে ভ্রান্ত আদর্শ ধ্বংস করতে পারে। আজ তারা মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের মডেল।

যারা ক্ষমা করে এবং যারা অনুশোচনা করে, তারা কেবল সংঘাতের দুষ্টচক্র ও প্রতিশোধের ধারাবাহিকতা থামায় না- তারা ভবিষ্যতের জন্য সামনে এগিয়ে চলার জীবন্ত শিক্ষা হয়ে দাঁড়ায়। ভয়ের দোলাচলে কাঁপতে থাকা এবং ঘৃণায় বিভক্ত এক পরিস্থিতিতে, নিঃশবব্দে ও যত্নে করা কাজগুলো শেষ পর্যন্ত টিকে থাকে ও সাহস জোগায়, এটাই আশার কথা। এটাও আশার কথা যে, মানুষ ও মানবতার হৃদয় তার ক্ষতগুলোর চেয়েও বেশি জোরে স্পন্দিত হয় আশায়, সাহসে, সংকল্পে ও ইতিবাচকতায়।
 

লেখক: চেয়ারম্যান, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।