
ধ্রুব এষ শিশুসাহিত্যে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার-২০২২ পেয়েছেন। প্রচ্ছদশিল্পী হিসেবেই তিনি বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছেন। জন্ম হাওর অধ্যুষিত মায়াবী জোছনার জেলা সুনামগঞ্জে। শৈশব থেকেই বই ও বইয়ের প্রচ্ছদের প্রতি তার তীব্র আকর্ষণ। কবি ও কথাসাহিত্যিক হিসেবেও তিনি খ্যাতি কুড়িয়েছেন। বিমূর্ত নকশার প্রতি তার ঝোঁক বেশি। প্রচ্ছদে তিনি ব্যবহার করেন উজ্জ্বল রং। নব্বই দশক থেকে বিশিষ্ট ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদের অধিকাংশ বইয়ের প্রচ্ছদ এঁকেছেন ধ্রুব এষ। আড়ালপ্রিয় এই প্রচ্ছদশিল্পীর বিশেষ এই সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন সিফাত বিনতে ওয়াহিদ।
প্রচ্ছদ করার ক্ষেত্রে বিশেষ কোনো বইকে গুরুত্ব দেন কি?
না, বিশেষ কোনো বইকে আলাদা গুরুত্ব দেওয়ার কী আছে? সব বইকেই আমি সমান গুরুত্ব দিই।
কখন মনস্থির করলেন প্রচ্ছদশিল্পী হবেন?
ছবি আঁকতাম শৈশব থেকেই। আমার মা প্রচুর বই পড়তেন, সেই সুবাদে আমার বই পড়ার অভ্যাস। বইয়ের প্রচ্ছদ দেখতে তখন থেকেই ভালো লাগত। নাইন-টেনে যখন পড়ি তখন থেকে প্রচ্ছদ করার ইচ্ছে জন্মে। তখন থেকেই আমার মনে হয়েছে আমি কেবল বইয়ের জগতেই থাকতে চাই। শুধু প্রচ্ছদই আঁকব, সিদ্ধান্তটাও সেই সময়ই নেওয়া। সারা জীবন প্রচ্ছদই করব, এটা একটা পাগলের মতো সিদ্ধান্ত।
পাগলের মতো সিদ্ধান্ত কেন মনে হচ্ছে? এই পেশায় এসে কোনো আফসোস কি কাজ করে?
আফসোস করার তো প্রশ্নই আসে না। এই কাজটাকে আমি যতটা ভালবাসি, অন্যকিছুকে সেভাবে নয়। পাগলের মতো সিদ্ধান্ত বললাম এই কারণে, প্রচ্ছদ করে পেট চালানোর চিন্তা পাগল ছাড়া আর কে-ই বা করতে পারে?
চারুকলায় পড়ার ইচ্ছে কি প্রচ্ছদ আঁকার ইচ্ছে থেকেই?
হ্যাঁ, সেটা তো অবশ্যই।
চারুকলায় পড়াশোনা করেও শুধুই বইয়ের প্রচ্ছদ নিয়ে কাজ করলেন, অন্য কোনো মাধ্যমে কাজ করার ইচ্ছে করেনি কখনো?
আগেই তো বললাম, আমি কেবল প্রচ্ছদই করতে চেয়েছি সারা জীবন। অন্য কিছু করার চিন্তা বা ইচ্ছা আমার কখনোই ছিল না, থাকবেও না।
জীবনানন্দ দাশ বলেছেন, ‘পৃথিবীতে নাই কোনো বিশুদ্ধ চাকুরী’- কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আপনি কখনোই চাকরিসূত্রে যুক্ত ছিলেন না। এর
পেছনে কী ভাবনা কাজ করেছে?
এটা একটা ভুল তথ্য। আমি প্রায় ২০-২১টা প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছি। এখন নিশ্বোসই তো ফেলার সময় পাই না, চাকরি করব কী করে? চাকরি করতে গেলে প্রচ্ছদ করা হবে না।
প্রচ্ছদ করতে পারবেন না বলে, নাকি স্বাধীনতা খর্ব হতে পারে ভেবে করেন না?
প্রতিষ্ঠানে কাজের অভিজ্ঞতা আমার ভালো না। কাজ করতে যাওয়ার আগে সবাই খুব অ্যাপ্রিশিয়েট করেছে, কিন্তু যখন কাজ করতে গিয়েছি, দুই দিন না যেতেই তারা রং নিয়ে সাজেশন দেওয়া শুরু করল, কাজের ধরন নিয়ে সাজেশন দিতে আরম্ভ করল। এসব প্রাতিষ্ঠানিক সিস্টেম আমার ভালো লাগে না। এর চেয়ে বইয়ের প্রচ্ছদ করা অনেক ভালো। যাদের জন্য আমি প্রচ্ছদ করি তারা অনেক বেশি সহনশীল। তারা আমাকে অন্তত বুঝতে পারে।
বইয়ের প্রচ্ছদ তৈরিতে কতটুকু স্বাধীনতা পান?
প্রচ্ছদে আবার স্বাধীনতা-পরাধীনতা কীভাবে এলো?
লেখকের কাছ থেকে নিশ্চয় প্রচ্ছদ কেমন হবে সে ধরনের পরামর্শ থাকে। আপনি কি সেটা গ্রহণ করেন, নাকি নিজের মতো স্বাধীনভাবে কাজ করেন?
কেউ কেউ পরামর্শ দেন। তবে আমি এগুলো কম ফেস করি।
প্রতিটি বই কি পা-ুলিপি পড়ে প্রচ্ছদ করা সম্ভব হয়?
মাথা খারাপ! সব বইয়ের তো পা-ুলিপি পড়া সম্ভব না। আমি কেবল থিমটা শুনি। কিছু কিছু বইয়ের সিনোপসিস পড়ি। তারপর আমি আমার মতো করে কাজ করি। কাজের ক্ষেত্রে কারও আইডিয়া নিতে আমি পছন্দ করি না।
প্রতি বছর এত এত প্রচ্ছদ করলেও একটির সঙ্গে অন্যটির কোনো মিল নেই, এমনকি কোনো একঘেয়েমিও নেই- এটি কীভাবে সম্ভব?
বছরে ৭০০ প্রচ্ছদ করলে, প্রতিদিন প্রায় ২টা প্রচ্ছদের কাজ করতে হয়। এটা মনে রাখা কি খুব বড় ব্যাপার? আমার তো মনে হয় না। একটার সঙ্গে আরেকটা মিলবেই বা কেন? তবে ইদানীং কম্পিউটার ব্যবহারের কারণে দুয়েকটা অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। একটা কাজ দেখে মনে হলো এটা কোথাও ব্যবহৃত হয়নি, কিন্তু দেখা গেল অন্য কোনো বইয়ে ওই প্রচ্ছদ আগেই ব্যবহার করা হয়ে গেছে, আমার মনে নেই বা কনফিউশনের কারণে এ রকম দুয়েকটা ঘটনা ঘটেছে।
এত এত বইয়ের প্রচ্ছদ করতে গিয়ে মানের দিক দিয়ে কি কিছু বইয়ের প্রতি অবিচার করা হয় না?
কখনোই না। আমি এটা করি না। আমি এ ধারণায় বিশ্বোস করি না যে, ১০টা কাজ খুব ভালো করে করব আর বাকিগুলো হেলায়ফেলায় কোনোমতে করে দেব। প্রতিটা কাজের প্রতি আমি সমান দায়িত্বশীল। প্রচ্ছদ করতে গিয়ে প্রতিটা বইয়ের ডিমান্ড আমি ফুলফিল করতে পারি কি না, সেটাই আমার কাছে মুখ্য বিষয়।
এখন সবকিছুই প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল। আপনার প্রচ্ছদে প্রযুক্তির সঙ্গে হাতের ছোঁয়ার উপস্থিতিও সমানে সমান। এ ক্ষেত্রে আপনি কোনটিকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন?
গুরুত্ব-টুরুত্ব কিছু না। এখন প্রযুক্তির যুগ। হাতে আঁকার সঙ্গে প্রযুক্তির ব্যবহারটাও মানানসই।
বর্তমান প্রচ্ছদ শিল্পের সংকটগুলো কী?
আমাদের দেশে আবার সংকট কী? আমাদের দেশে তো এখন অনেক ভালো ভালো প্রচ্ছদ হচ্ছে।
কোনো সংকট নেই বলছেন?
আমার চোখে পড়ে না।
বাংলা বইয়ের প্রচ্ছদে আধুনিকতা তো আপনার হাত ধরে এসেছে।
এগুলো আপনারা খামাখা বাড়িয়ে বলেন। আমাকে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি ক্রেডিট দেন। আধুনিকতার বিষয় না, বিষয়টা একটা চেঞ্জের, যেটা হুমায়ূন আহমেদের মতো একজন ব্যক্তিকে পাশে পেয়েছিলাম বলেই সম্ভব হয়েছিল। আগে উপন্যাসের বইয়ের প্রচ্ছদ হতো ফিগার এঁকে। একজনের বা দুজনের মুখের ছবি দিয়েই প্রচ্ছদ হয়ে যেত। হুমায়ূন স্যারই প্রথম আমাকে বলেছিলেন তার বই করতে গেলে কোনো ফিগার আঁকতে হবে না। তিনি আমাকে ডেকে বললেন, ‘আমার বইয়ের প্রচ্ছদ করার সময় চিন্তা করবা কবিতার বইয়ের প্রচ্ছদ করছো, ফিগার আঁকার দরকার নাই’। এখন একজন লেখক যদি আর্টিস্টকে এই স্বাধীনতা দিয়ে দেন আর সেই আর্টিস্ট যদি বোকা না হয়ে থাকে তবে সেই সুযোগটাকে সে কাজে লাগাবে না কেন? আমি আমার কর্মজীবনে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়েছি হুমায়ূন স্যারকে দিয়েই। হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন বলেই, আমি ধ্রুব এষ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছি।
প্রচ্ছদ আঁকার পেছনে কোনো অনুপ্রেরণা কাজ করে কী?
আমরা সবাই তো ইউনিক। যার যার মতো তার তার কাজ। অনেকের প্রচ্ছদই ভালো লাগে। আদর্শ মানা-টানা এসব প্রাচীন ব্যাপার। আগে ভিঞ্চিকে আদর্শ মেনে লোকে ছবি আঁকত, এখন কী আঁকে? এখন সেসব নেই।
বইয়ের প্রচ্ছদও যে শিল্প হতে পারে, পুর্ণেন্দু পত্রীর পরে এ বিষয়টা আপনার মতো করে আর কেউ তুলে ধরতে পারেনিÑএ বিষয়ে কাউকে আদর্শ মনে করেন?
এটা আমি বিশ্বোস করি না। এটা যারা বলছে তারা কাজ দেখেননি। অনেক ভালো কাজ হয়েছে। পুর্ণেন্দু পত্রী যে কাভার করেছেন, আমি সাত জন্মেও সে রকম কাভার করতে পারব না। সুব্রত জহিরের কাজ দেখেন, শুভ্র গঙ্গোপাধ্যায়ের কাজ দেখেন- তাদের কাজ অসম্ভব ভালো। আমাদের দেশে প্রথম কাভারে চেঞ্জ নিয়ে আসেন কাজী হাসান। এরপর আফজাল হোসেন। ডিজাইনার হিসেবে তিনি অসাধারণ। উনি বিজ্ঞাপন নিয়ে ব্যস্ত না হয়ে পড়লে আরও ভালো কাজ পাওয়া যেত। আমি যখন কাজ করতে এসেছি, আফজাল ভাইয়ের কাজ দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছি। কাইয়ুম স্যার, নবী স্যার আর হাশেম স্যারদের কথা তো বাদই দিলাম, এ ছাড়াও এদেশে অনেক ভালো মানের কাজ হয়েছে। আমি কাজ শুরু করার পরই পেলাম হুমায়ূন আহমেদকে। তাকে পাশে পাওয়াটা ছিল অনেক বেশি জরুরি।
পেশায় প্রচ্ছদশিল্পী হলেও নেশা আপনার লেখালেখি। ছোট-বড় সবার জন্য বিস্তর লিখছেন। এ দুই মাধ্যমে আপনি কোনটিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন?
ভুল বললেন। পেশা ও নেশা দুটোই আমার প্রচ্ছদ করা। লেখালেখিটা আমার শখ বলতে পারেন। এটা আদৌ কেউ পড়ে কি না আমি জানি না। স্বাচ্ছন্দ্যবোধের কথা যদি বলেন সেটা স্বাভাবিকভাবেই প্রচ্ছদ করেই পেয়ে থাকি। তবে সারা জীবন শুধু বই পড়তে পারলে বোধহয় আমার বেশি ভালো লাগত। সেটা তো আর সম্ভব না।
ব্যক্তিমানুষ রাষ্ট্র ও সমাজ কাঠামোর মধ্যে থাকে, তাকে সবকিছু স্পর্শ করেÑআপনার লেখায় কোনো রাজনৈতিক প্রভাব পড়ে কি?
যে কারোর লেখাতেই রাজনৈতিক প্রভাব থাকে। আমরা তো কেউ রাজনীতির বাইরে না। এখন রাজনৈতিক প্রভাব মানেই তো আর মিছিল দেখাতে হবে, লাশ দেখাতে হবে- তা না। একেবারে পলিটিক্যাল লেখা ছাড়া কি রাজনৈতিক লেখা হয় না? মানুষ পুরাটাই রাজনৈতিক। এর বাইরে যাওয়া সম্ভব না।
শিশুদের জন্য অনেক লিখছেন, আঁকছেন। আগামী দিনে শিশুদের জন্য কী ধরনের কাজ করার স্বপ্ন দেখেন?
যতদিন আমার পাশে শিশুরা থাকবে ততদিন তাদের জন্য লিখব। যখন আর থাকবে না, তখন হয়তো আর লিখব না। শিশুদের নিয়ে যে গল্পগুলো লিখি, সেগুলো তারা আমার আশপাশে যা করছে ঠিক তা-ই লিখছি। এর বাইরে আমি কিছু লিখিনি। বানিয়ে-টানিয়ে আমি লিখতে পারি না।
প্রচ্ছদ আঁকা, শিশু-কিশোর সাহিত্য থেকে গল্প-কবিতা সব ক্ষেত্রেই সমান দক্ষতা নিয়ে আপনার আবির্ভাব- এ ক্ষেত্রে কোনো আইডেন্টিটি ক্রাইসিস তৈরি হয় কি?
আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে পৃথিবীর কোন মানুষটা ভোগে না? আমি একা কেন ভুগব? আমি কে- এই প্রশ্নের উত্তর কী আমরা কেউ-ই জানি? আমি নিজেকে স্রেফ একজন কামলা মনে করি।
জীবনযাত্রায় আপনাকে বেশ উদাসীন মনে হয়, এটা কী সচেতনভাবে করেন?
অগোছালো থাকা আর উদাসীন থাকা কিন্তু এককথা না। উদাসীন হলে একজনের পক্ষে আর্টিস্ট হওয়া সম্ভব না। আর্টিস্টের থাকতে হয় সবকিছু দেখার মতো চোখ। আমরা কবিদের উদাসীন বলি, কবিদের যে তীব্র অনুভূতি সেটা আমাদের কারোর নেই। আপনি তো কবি? আপনি কি নিজেকে উদাসীন মনে করেন? কবির মতো করে আমরা কেউ সত্য উচ্চারণ করতে পারি না। কবি মানেই আমরা ধরে নিই বোহেমিয়ান। এটা আমাদের ধারণা মাত্র। কবি অন্য মাপের মানুষ। নূর হোসেন মারা যাওয়ার পর যে শামসুর রাহমান ‘বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়’ লিখবে, এটা কে আগে থেকে বুঝতে পেরেছিল? অগোছালো হলো আমার ব্যক্তিগত জীবনযাপনের অংশ। এখন এটা ইচ্ছা করলেই তো আর পরিবর্তন করতে পারব না।
হুমায়ূন-ধ্রুব এষ পাঠকের কাছে এক যুগলবন্দি। কেমন ছিল সে যাত্রা? শুরুটাই বা কীভাবে হলো?
প্রথমদিকে আমি সবচেয়ে বেশি প্রচ্ছদ করেছি ইমদাদুল হক মিলনের। তার তিন-চার বছর পর হুমায়ূন স্যারের প্রচ্ছদ করার সুযোগ আসে। আমি তখন তার মুগ্ধ পাঠক। এক প্রকাশক এক দিন এসে বললেন একজন লেখকের প্রচ্ছদ করতে হবে, কিন্তু উনি বেশ খুঁতখুঁতে স্বভাবের। প্রচ্ছদ ভালো না হলে উল্টাপাল্টা কথা বলতে পারেন। আমি বললাম, কে তিনি? হুমায়ূন আহমেদের নাম বলতেই রাজি হয়ে গেলাম। প্রচ্ছদ করতে দিল ‘১৯৭১’ মঞ্চ নাটক। প্রচ্ছদ করলাম। প্রকাশক তার কাছে নিয়ে গেলেন। উনি পছন্দ করলেন না। আরও দুইটা করলাম, পছন্দ হলো না। আরও দুইটা করে পাঠালাম, এবারও পছন্দ করলেন না। প্রকাশক এসে বললেন হুমায়ূন স্যার আমার সঙ্গে দেখা করতে চান। আমি গেলাম তার সঙ্গে দেখা করতে। উনি আমাকে দেখেই বললেন ‘ভাই তোমার তো কোনো প্রচ্ছদই আমার পছন্দ হয়নি। তুমি কি আরও প্রচ্ছদ করবে?’
আমি বললাম, হ্যাঁ করব। অনেকক্ষণ সেখানে বসে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তার কথা শুনলাম। বের হয়ে প্রকাশককে বললাম ওনার জন্য যদি আমার ১০০ প্রচ্ছদও করতে হয়, আমি তা-ই করব। ওনাকে প্রচ্ছদ পছন্দ করাবই। এরপর অবশ্য খুব বেশি কষ্ট করতে হয়নি। একটা প্রচ্ছদ করেছিলাম, সেটাই উনি পছন্দ করেছিলেন। সেই থেকে শুরু। এরপর বোধহয় আমি ছাড়া দু-একজনই স্যারের প্রচ্ছদ করার সুযোগ পেয়েছে। শুধু স্যারের প্রচ্ছদই আমি করেছি আড়াইশর মতো। আর লেখকের সঙ্গে আর্টিস্টের এত ব্যক্তিক সম্পর্ক তৈরি হওয়া উনি ছাড়া আমি কাউকে দেখিনি। এত মায়া দিয়ে স্যার ছাড়া আর কেউ আগলে রাখেনি। প্রকাশকরা আমাকে ঠিকমতো টাকা দিচ্ছেন কি না সেটা নিয়েও তিনি কনসার্ন ছিলেন। এমনকি প্রকাশকদের নিজে ফোন দিয়ে আমার টাকা পরিশোধ করা হয়েছে কি না খোঁজ নিতেন। এই মানুষটা সম্পর্কে আমি আসলে ব্যাখ্যা করতে পারব না। প্রতি বছর আমি যে দু-একটা বই বের করি সেটা স্যারকে উৎসর্গ করে। যতদিন বেঁচে থাকব, তাই করব। যদি একটা বই বের হয়, সেটা স্যারকে উৎসর্গ করেই বের হবে।
আপনাকে দিয়ে বইয়ের প্রচ্ছদ করানোর ইচ্ছে প্রায় সবার মধ্যেই থাকে, প্রচ্ছদ করার ক্ষেত্রে আপনি কোন বিষয়টাকে প্রাধান্য দেন?
আমি সব ধরনের বইয়ের কাজই করি। বইয়ের মান যাচাই করার সুযোগ কই আমার? আমি তো পেশাদারত্বের জায়গা থেকে এটা করছি। কেউ যদি আমাকে সিনেমার বইয়ের কাভার করতে দেয়, আমি সেটাও করব। শাবনূর-পপির ছবি দিয়েই করব। আমি ভাই ইন্টেলেকচুয়াল আর্টিস্ট না। প্রচ্ছদ করে কিছু পরিবর্তন করার ইচ্ছে আমার নেই। যে কারোর বই আমি করব। বই যে মানের, প্রচ্ছদও সে মানেরই হবে।
প্রচ্ছদ শিল্পী হতে গিয়ে, ‘কথাশিল্পী’ পরিচয়টা কী আড়ালে পড়ে যাচ্ছে?
কথাশিল্পী পরিচয়ের দরকারই তো আমার নেই। কোনো পরিচয়েরই দরকার আমার নেই। কালকে যদি কেউ বলে বইয়ের প্রচ্ছদেও আর্টিস্টের নাম থাকবে না, আমি বরং খুশিই হব। কাজ করে যদি আমি তৃপ্ত হই, তাহলে নামের প্রয়োজন কেন? আমি তো জানি কোনটা আমার কাজ, সেখানে নাম থাকায় কিংবা না থাকায় কী আসে যায়?
এত কর্ম ব্যস্ততায় নিজের ব্যক্তিসত্তায় কোনো দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয় কি?
এই বাংলায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জন্মেছিলেন। উনি যে পরিমাণ চিঠি লিখেছিলেন, আমরা সারা জীবনেও সে পরিমাণ কাজ করতে পারব না। সেখানে দুটো কাজ করে যদি সবাইকে বলি অনেক করে ফেলেছি। আমার অন্তত মনে হয় না, আমি অনেক কাজ করেছি। কাজের ক্ষেত্রে আমি কোনো চাপ অনুভব করি না। চাপ অনুভব করি যখন বিভিন্নজন কাজ দিয়ে তাগাদা দিতে থাকেন, কালকেই কাজ দিয়ে দেওয়ার জন্য। তা ছাড়া ২৬-২৭ বছর ধরে এ পেশার সঙ্গে আছি, কোনোদিনও কাজের চাপ অনুভূত হয়নি। বরং এই কাজে আমি যে আনন্দ পাই তা কোথাও পাওয়া সম্ভব না। প্রথমদিন কাজের প্রতি আমার যে ভালোবাসা ছিল, শেষদিন পর্যন্ত ঠিক তেমনই থাকবে।
বাংলাদেশের প্রচ্ছদের ভাষাচিত্রের প্রধান প্রবণতাগুলো কী? প্রচ্ছদের কোনো ভাষাচিত্র নেই। ভাষা দিয়ে যে চিত্রটা তৈরি হয় সেটা লেখার। ছবির ভাষা আলাদা। প্রচ্ছদের ভাষাচিত্র হতে পারে না। প্রচ্ছদ তো আর অক্ষর দিয়ে বানানো যায় না। আমাদের আবার প্রচ্ছদের প্রবণতা কী?
বাংলাদেশের প্রচ্ছদ দেখলে বোঝা যায় এটা এ দেশের প্রচ্ছদ। সেটাই তো বেশি জরুরি।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রচ্ছদে কী পার্থক্য আছে? ভাষা এক হওয়ার কারণে পশ্চিমবঙ্গের প্রচ্ছদের সঙ্গে আমরা তুলনা করতে পারি। তাদের থেকে আমাদের প্রচ্ছদের চিন্তা-ভাবনার জায়গা অনেক আলাদা। বিশ্বের অন্য দেশের ভাষার সঙ্গে আমাদের বইয়ের তুলনা করতে পারবেন? সেখানে তো বিস্তর তফাত রয়েছে। প্রতিটা ক্ষেত্রেই তাই। বাংলাদেশ থেকে চূড়ান্তভাবে আন্তর্জাতিক মাধ্যমে একটাই কাজ গেছেÑফটোগ্রাফি। অসম্ভব ভালো কাজ হয়েছে এই সেক্টরে।
প্রচ্ছদশিল্পীর ভাষা লেখকের ভাষাকে অতিক্রম করতে পারে কি? প্রচ্ছদ শিল্পীর ভাষা, লেখকের ভাষাকে কখনোই অতিক্রম করতে পারবে না। এটা সম্ভব না। লেখার সঙ্গে তো প্রচ্ছদের কোনো দ্বন্দ্ব নেই যে, এটাকে অতিক্রম করতে হবে।
প্রচ্ছদ কি পণ্যমূল্য বৃদ্ধিতে সহায়তা করে? প্রচ্ছদের জন্য কেউ বই কিনে কি না জানি না। পণ্যমূল্য হয়তো আছে, কিন্তু সেটা গুরুত্বপূর্ণ কিছু না।
লেখক এবং প্রচ্ছদ শিল্পীর মধ্যে কী ধরনের ভাবের আদান-প্রদান হওয়া প্রয়োজন? লেখকের সঙ্গে কী জন্য ভাবের আদান-প্রদান করতে হবে? একটা অনুবাদের বইয়ের যদি প্রচ্ছদ করতে যাই তবে অনুবাদকের সঙ্গে ভাবের আদান-প্রদান করব নাকি লেখকের সঙ্গে? সিনোপসিস পড়ে যতটুকু বোঝা যায় সেটা দিয়েই কাজ করা যায়। আর আমি কারোর কাছ থেকে আইডিয়া নেওয়া পছন্দ করি না। আইডিয়া কেউ শুনাতে পারে, সেটার প্রতি আমি অসম্মান করছি না। কিন্তু কাজ আমি নিজের মতোই করতে ভালোবাসি।
প্রচ্ছদ কি আপনি বিজ্ঞাপন হিসেবে দেখতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন, নাকি শিল্প? বিজ্ঞাপনই মনে করি। আর দশটা মোড়কের মতোই। অনেকেই হয়তো ডিফার করবে, আমি আমার দৃষ্টিকোণ থেকে বললাম। বই না থাকলে খালি প্রচ্ছদ কোনো কাজে আসত? প্রচ্ছদকে আমি পূর্ণমাত্রার শিল্প মনে করি না। শিল্পের নিজস্বতা আছে, স্বকীয়তা আছে। প্রচ্ছদ তো পরাশ্রয়ী। মিল্টন গ্রেসারকে প্রচ্ছদ বা গ্রাফিক্সের দেবতা বলা হয়। তিনি বব ডিলানের পোস্টার থেকে শুরু করে শেক্সপিয়ারের বইয়ের প্রচ্ছদ নতুন আঙ্গিকে করেছেন। যদি বই না থাকত তাহলে এসব প্রচ্ছদ মূল্যহীন হয়ে পড়ত। ভেতরে লেখা না থাকলে এবার বইমেলায় আমি ৭০০টা প্রচ্ছদ করে টাঙিয়ে রাখলে কেউ কিনবে? কিন্তু আবার একটা গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের যদি কুৎসিত প্রচ্ছদ হয়, লোকে তাও কিনবে।
পাঠকের তো আসলে এত সময় থাকে না বই নেড়েচেড়ে তারপরে কেনার। সে ক্ষেত্রে অনেকেই হয়তো প্রচ্ছদ দেখে আকৃষ্ট হয়ে বই কিনেন।
সেটা আমিও এক সময় কিনতাম। কিন্তু সেটা তো প্রচ্ছদের প্রতি আমার একধরনের দুর্বলতা ছিল সে কারণে। একবার আমি একটা বই পেলাম, ‘চারু মজুমদারের শেষদিনগুলো’। চারু মজুমদারের শেষ সময়ে তার যে ডাক্তার ছিল, উনি লিখেছিলেন। বইটার প্রোডাকশন বলেন, প্রচ্ছদই বলেন- কিছুই হাতে নেওয়ার যোগ্য না। কিন্তু তারপরও আমি বইটা কিনেছিলাম কেবল কনটেন্টের জন্য। এখন পাঠক তো অন্তত এটুকু বুঝবে যে বইটি কিনছে তার ভেতরের লেখার মান কী রকম?
অলঙ্করণ এবং প্রচ্ছদের মধ্যে পার্থক্য মূলত কী?
অলঙ্করণ আর প্রচ্ছদ সম্পূর্ণ ভিন্ন দুইটা জিনিস। আমাদের দেশে প্রচ্ছদের মাপ হলো পৌনে নয়-ছয়। এইটুকুর মধ্যে চূড়ান্ত মাত্রায় একটা এক্সপ্রেশন তৈরি করাই হলো প্রচ্ছদ। অলংকরণ করতে গেলে অবশ্যই গল্পের ডিটেইলিং সেখানে আনতে হবে। পুরো লেখাটাকে অলংকৃত করাকে অলঙ্করণ বলে। সত্যজিতের অলংকরণ দেখলে মুগ্ধ হতে হয়। উনি ফেলুদায় যে ঘোড়ার গাড়ি এঁকেছেন তার থেকে আমি খুড়ের শব্দ শুনতে পারি। যেসব অলি-গলি এঁকেছেন, মনে হয় যেন আমি সেখানেই আছি। প্রচ- শক্তিশালী সেসব অলংকরণ।
সৃষ্টির পেছনে কোনো না কোনো প্রণোদনা থাকে, নিশ্চয় আপনার আঁকা এবং লেখার পেছনেও কোনো প্রণোদনা আছে?
প্রণোদনা কাকে বলে? এসব আমি বুঝি না। কাজ করে তৃপ্তি পাই, তাই কাজ করি।
বিষয় নির্বাচন করে লেখেন নাকি লিখতে লিখতে বিষয় এসে যায়?
এত কিছু চিন্তা করি না। লিখতে লিখতে যেটা মাথায় আসে তাই লিখে ফেলি।
লেখার পেছনে কি কোনো উদ্দেশ্য অথবা সামাজিক দায়বদ্ধতা কাজ করে?
আমার কোনো দায়বদ্ধতা নেই। আমি সবকিছু আমার মতোই করি। লেখালেখি তো আমি শিশুদের নিয়ে করে থাকি আর এর বাইরে যেগুলো করি সেখানে খুন-খারাবিই বেশি। এর মধ্যে দায়বদ্ধতা আছে কি না আমি জানি না। সবাই ভালো থাকুক, এটাই চাই। সমাজে অন্য সবার যেটুকু দায় আছে, আমারও ততটুকুই। এর চেয়ে আলাদা কিছু নেই।
প্রচ্ছদশিল্পীদের নিয়ে একটি অভিযোগে আছেÑতারা সময়মতো কাজ বুঝিয়ে দেয় না, কমিটমেন্টের জায়গাকে আপনি কীভাবে দেখেন?
আমি যেহেতু নিজে কমিটমেন্টের জায়গা ঠিক রাখি, সেখানে কে কী করছে সে বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারব না। অন্যদের কমিটেড করার দায়িত্ব আমার না।
সাম্প্রতিক যে ধর্মীয় সহিংসতা, জঙ্গিবাদের উত্থান হচ্ছে বাংলাদেশে তা ঠিক কতটা মানানসই?
এটা আমাদের ব্যর্থতা। মৌলবাদ মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে আর আমরা কেবল আহাজারি করব- এটা তো হতে পারে না।
এর থেকে উত্তরণের উপায় কী?
এটা আমি কী করে বলব? এগুলো তো রাজনীতিবিদদের বলার কথা, তারা বলবেন।
তারপরও, আপনার কোনো সাজেশন নেই?
যদি এখন দেশে যুদ্ধ লাগে, আমি কি সাজেশন দিতে যাব, নাকি যুদ্ধ করব? যুদ্ধ করতেই নিশ্চয় যাব। সাজেশন যারা দেওয়ার তারা দেবে। আমরা যদি পারি, সহযোগিতা করব। আমার সাজেশনে তো আর রাষ্ট্র চলবে না। জীবন মানেই যুদ্ধ। পৃথিবী কবে যুদ্ধ ছাড়া ছিল? সারা পৃথিবীতে প্রতিদিন মানুষ খুন হচ্ছে। বিশ্বে যেখানে আক্রান্ত, সেখানে দেশ নিয়ে আলাদা করে কী ভাবব?