Image description

বিশ্ববাজারে সয়াবিন ও পাম অয়েলের দাম পড়তির দিকে থাকলেও দেশে বাড়ানো হয়েছে ভোজ্যতেলের দাম। বাড়তি দাম নিয়ে সরকারের বাণিজ্য উপদেষ্টা ও ব্যবসায়ীদের পরস্পরবিরোধী বক্তব্যে বাজারে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়েছে। এতে খুচরা বিক্রেতাদের অনেকে বাড়তি দামে; আবার কেউ কেউ আগের দামেই বিক্রি করছেন। তবে রাজধানীর পাড়া-মহল্লার দোকানে বাড়তি দামেই ভোজ্যতেল বিক্রি হতে দেখা গেছে।

রাজধানীর কারওয়ান বাজারের মায়ের দোয়া স্টোরের ব্যবসায়ী ইমাম উদ্দিন বাবলু গতকাল মঙ্গলবার বিকালে আমার দেশকে বলেন, বাণিজ্য উপদেষ্টা ও কোম্পানির মালিকদের বিপরীতমুখী বক্তব্যে খুচরা বাজারে চরম বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়েছে। কোনো কোনো দোকানি সোমবার রাত থেকেই সয়াবিন ও পাম ওয়েলের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। আবার আমার মতো অনেকেই আগের দামেই বিক্রি করছেন।

এ প্রসঙ্গে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এসএম নাজের হোসাইন বলেন, বাণিজ্য উপদেষ্টার বক্তব্য দায়িত্বজ্ঞানহীন ও ব্যর্থতার বড় প্রমাণ। কেউ নিয়ম-কানুন না মানলে তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র ব্যবস্থা নেবে—এটাই স্বাভাবিক। দাম বাড়ানোর বিষয়ে তিনি আরো বলেন, এটা ব্যবসায়ীদের অজুহাত মাত্র। তাদের হিসাবে সর্বশেষ বোতলজাত সয়াবিনের দাম ১৪ টাকা বাড়ানোর পর ব্যবসায়ীদের লাভ হচ্ছে লিটারে অন্তত ১২ টাকা।

রাজধানীর পূর্বাচলে গতকাল দুপুরে এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন বলেছেন, ভোজ্যতেলের দাম বাড়ায়নি সরকার, উৎপাদকরা বাড়িয়েছে। অন্যদিকে, ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করেই আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নতুন মূল্য সমন্বয় করা হয়েছে; যা গতকাল থেকে কার্যকর হয়েছে।

এর আগে গত সোমবার বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানোর ঘোষণা দেয়। নতুন দাম গতকাল থেকে কার্যকর হওয়ার কথা বলা হয়।

আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবের কথা উল্লেখ করে গত সোমবার বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাহী কর্মকর্তা মো. নুরুল ইসলাম মোল্লার স্বাক্ষর করা সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে নতুন দাম বৃদ্ধির এ তথ্য জানানো হয়।

এতে বলা হয়, নতুন নির্ধারিত দামে এক লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলের মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ১৯৫ টাকা এবং পাঁচ লিটার বোতল সয়াবিন তেল ৯৪৫ টাকা। খোলা সয়াবিন তেল প্রতি লিটার ১৭৭ টাকা এবং খোলা পাম তেল ১৬৩ টাকায় বিক্রি হবে।

এতদিন বাজারে বোতলজাত সয়াবিন তেল ১৮৯ টাকা, খোলা সয়াবিন ১৭৪ এবং পাম তেল ১৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছিল। সে হিসেবে লিটারপ্রতি বাড়ল তিন থেকে ১৩ টাকা।

গত এপ্রিল মাসে সর্বশেষ সয়াবিন তেলের দাম বাড়ানো হয়েছিল। তখন বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ১৪ টাকা বাড়িয়ে ১৮৯ টাকা করা হয়েছিল। এ ছাড়া প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন ও পাম তেলের দাম ১২ টাকা বাড়িয়ে ১৬৯ টাকা এবং বোতলজাত পাঁচ লিটার সয়াবিন তেলের দাম ৭০ টাকা বাড়িয়ে ৯২০ টাকা করা হয়। অবশ্য আগস্টের মাঝামাঝি সময়ে এসে খোলা পাম তেলের দাম লিটারে ১৯ টাকা কমিয়ে ১৫০ টাকা করা হয়।

এদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির কারণে দেশেও ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানোর কথা বলা হলেও গত তিন বছরের মধ্যে আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন তেলের দাম এখন সর্বনিম্ন পর্যায়ে।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) প্রতিবেদন অনুযায়ী ভোজতেলের মূল্যসূচক ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরে এক দশমিক দুই শতাংশ কমে ১৬৭ দশমিক ৯ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে—যা ২০২২ সালের জুনের পর সর্বনিম্ন স্তরে পৌঁছেছে।

বিশ্ববাজারে দাম কমলেও দেশের বাজারে এই তেল বিক্রি হচ্ছে তুলনামূলক বেশি দামে। সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের দাবি, ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন এবং যথাসময়ে ব্যাংকের সহায়তা না পাওয়ায় বিশ্ববাজারে দর কমার সুফল পাচ্ছেন না দেশের ভোক্তারা।

বিশ্বব্যাংকের নিয়মিত মাসিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক বাজারে ২০২২ সাল থেকে সয়াবিন, পাম অয়েল ও সয়াবিন বীজের দাম নিম্নমুখী। ২০২২ সালে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি টন সয়াবিন তেলের গড় দাম ছিল এক হাজার ৬৬৭ ডলার। ২০২৩ সালে সেই দর নেমে আসে এক হাজার ১১৯ ডলারে। ২০২৪ সালে তা আরো কমে দাঁড়ায় এক হাজার ২২ ডলারে।

চলতি বছরের প্রথম তিন মাসেও সয়াবিনের দাম এর কাছাকাছি ছিল। গত জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত সয়াবিনের গড় দাম ছিল এক হাজার ৪০ ডলার। এপ্রিল মাস থেকে দাম আরো কমতে শুরু করে। ভোজ্যতেলের মূল্যসূচক ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরে এক দশমিক দুই শতাংশ কমে ১৬৭ দশমিক ৯ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে—যা ২০২২ সালের জুনের পর সর্বনিম্ন স্তরে পৌঁছেছে।

একই চিত্র পাম অয়েলের ক্ষেত্রেও। ২০২২ সালে বিশ্ববাজারে পাম অয়েলের গড় দাম ছিল এক হাজার ২৭৬ ডলার। ২০২৩ সালে ছিল মাত্র ৮৮৬ ডলার। ২০২৪ সালে দাঁড়ায় ৯৬৩ ডলার। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে পাম অয়েলের গড় দাম এক হাজার ৬৮ ডলার। এপ্রিল মাসের পর আবার কমতে শুরু করে এর দাম। সেপ্টেম্বরেও দাম কমেছে।