Image description

হঠাৎ করে শতাধিক পণ্য ও সেবায় মূল্য সংযোজন কর বা (ভ্যাট) বাড়ানোর ঘটনায় তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। রাজনৈতিক দলসহ অর্থনীতিবিদ ও ভোক্তারা সরকারের এ পদক্ষেপের তীব্র সমালোচনা করেছেন। বাড়তি শুল্ক ও কর কার্যকর হয়েছে মানুষের অতি প্রয়োজনীয় সাবান, বিস্কুট, চশমা, ওষুধ, হোটেল, রেস্তরাঁ, ফলমুল, মুঠোফোন সেবা ও ইন্টারনেট, কোমল পানীয়, ডিটারজেন্ট, বিমান ভাড়া, গৃহস্থালি সহ শতাধিক সেবা ও পণ্যে। ইতিমধ্যে এসব পণ্যের দামও বেড়ে গেছে। মোবাইল কল ও ইন্টারনেটের বাড়তি খরচ কেটে নিচ্ছে অপারেটরগুলো। যার চাপ পড়ছে সরাসরি ভোক্তার ওপর। চড়া মূল্যস্ফীতির এই সময়ে এনবিআর’র এমন সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার দাবি সাধারণ মানুষের। 

উল্লেখ্য, চলতি অর্থবছরের বাকি ছয়মাসে বাড়তি ১২ হাজার টাকা আদায় করতে চায় এনবিআর।

চশমা: প্রয়োজনীয় চশমায় সম্পূরক শুল্ক বেড়েছে তিনগুণ। উৎপাদন ও ব্যবসায়ী পর্যায়ে চশমার প্লাস্টিক ফ্রেম ও রিডিং গ্লাস বিক্রিতে ১৫ শতাংশ কর নির্ধারণ করা হয়, যা আগে ছিল ৫ শতাংশ। আর সানগ্লাসের ক্ষেত্রে যা করা হয় দ্বিগুণ। প্রায় দুই দশক ধরে রাজধানীর পল্টনে চশমা ও সানগ্লাসের পাইকারি ব্যবসা করেন হাবিব। তিনি বলেন, আমাদের কাছে ক্রেতা আসে হাতেগোনা। বিক্রিও কম। নতুন করে শুল্ক হার বাড়ায় চিন্তিত তিনি। 

মোবাইল সেবার খরচ: মাত্র ছয় মাসের ব্যবধানে দ্বিতীয়বারের মতো বাড়লো মোবাইল সেবার খরচ। এর আগে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে মোবাইল সেবার ওপর সম্পূরক শুল্ক ৫ শতাংশ বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশ করা হয়। এবার সেই শুল্ক আরও ৩ শতাংশ বাড়িয়ে ২৩ শতাংশ করা হলো। সেই হিসাবে দ্বিতীয়বার কর বাড়লো মোবাইল সেবা খাতে। বাড়তি শুল্কের হিসাবে গ্রাহক ১০০ টাকা রিচার্জ করলে সরকার পাবে ৫৬ টাকা ৩০ পয়সা। আর গ্রাহক ব্যবহার করবেন বাকি মাত্র ৪৩ টাকা ৭০ পয়সা। এক্ষেত্রে ১০০ টাকা রিচার্জ করলে সম্পূরক শুদ্ধ, ভ্যাট ও সারচার্জ বাবদ কর্তন হবে ২৯ টাকা ৮০ পয়সা। অপারেটররা বলছে, পৃথিবীর আর কোনো দেশে মোবাইল সেবার ওপর এত কর রাখা হয় না। আগামী বাজেটে বিষয়টি বিবেচনার আবেদন জানাবেন তারা। 

ওষুধের খরচ: অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের ক্ষেত্রে স্থানীয় ব্যবসায়ী পর্যায়ে ভ্যাট ২.৪ থেকে বাড়িয়ে ৩ শতাংশ করা হয়েছে। এতে ওষুধের খরচ বাড়বে বলে মনে করেন ব্যবসায়ীরা। ওষুধ উৎপাদনকারী উদ্যোক্তারা বলেছেন, ওষুধের দাম বাড়ার শঙ্কা রয়েছে। কারণ, ব্যবসায়ীরা লোকসান দিয়ে ওষুধ উৎপাদন করবেন না।

রেস্তরাঁ ও বিস্কুট: নতুন সিদ্ধান্তে রেস্তরাঁর খাবারে ভোক্তাকে পাঁচের পরিবর্তে ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হচ্ছে। এ খাতের ব্যবসায়ীরা জানান, তাদের বেশির ভাগই ছোট উদ্যোক্তা। এতে উদ্যোক্তারা ঝুঁকিতে পড়েছেন। বাংলাদেশ রেস্তরাঁ মালিক সমিতির মহাসচিব ইমরান হাসান বলেন, গ্রাহকরা ভ্যাট দিতে চাচ্ছেন না। ওদিকে বিস্কুটের ক্ষেত্রে ভ্যাট ৫ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। কম আয়ের মানুষের ওপরই চাপ বেশি পড়লো। কারণ বিস্কুট ও রুটিজাতীয় খাদ্যপণ্য বড় লোকেরা কম কেনেন। এসব পণ্যের ভোক্তা নিম্ন্ন ও মধ্যবিত্ত। এতে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ব্যবসা বন্ধের উপক্রম হয়েছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ অটো বিস্কুটস অ্যান্ড ব্রেড ম্যানুফ্যাকচারার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি শফিকুর রহমান ভূঁইয়া।

পোশাক: নিজস্ব ব্র্যান্ড-সংবলিত তৈরি পোশাকের শোরুম বা বিপণিবিতানের পণ্য ও সেবার ওপর ভ্যাট সাড়ে ৭ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করেছে এনবিআর। ফলে পোশাকের দর বেড়ে গেছে। ফ্যাশন উদ্যোগ, ফ্যাশন এন্টারপ্রিনিয়র এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সহসভাপতি ও দেশি ব্র্যান্ড কে-ক্রাফটের স্বত্বাধিকারী খালিদ মাহমুদ খান বলেন, চিঠি দিয়েছে এনবিআর। ফলে নতুন মূল্য নির্ধারণ করা হচ্ছে। এ ছাড়া উপায় নেই। এক লাফে দ্বিগুণ ভ্যাট বাড়ানোর কারণে মানুষ পোশাক-আশাক কেনা কমিয়ে দেবে, যার প্রভাব পড়বে উদ্যোক্তাদের ওপর।

সিগারেট: সিগারেটে চার স্তরে দাম ও শুল্ক দু’টিই বেড়েছে। নিম্নস্তরে ১০ শলাকা সিগারেটের দাম ৫০ থেকে হয়েছে ৬০ টাকা। এতে প্রযোজ্য সম্পূরক শুল্ক ৬০ থেকে বাড়িয়ে ৬৭ শতাংশ করা হয়েছে। মধ্যম স্তরে ৭০ থেকে ৮০ টাকা এবং সম্পূরক শুল্ক ৬৫.৫ থেকে বাড়িয়ে ৬৭ শতাংশ করা হয়েছে। উচ্চস্তরে ১২০ থেকে বাড়িয়ে ১৪০ টাকা এবং সম্পূরক শুল্ক ৬৫.৫ থেকে বাড়িয়ে ৬৭ শতাংশ করা হয়েছে। অতি উচ্চস্তরের দাম ১৬০ থেকে ১৮৫ টাকা এবং সম্পূরক শুল্ক ৬৫.৫ থেকে বাড়িয়ে ৬৭ শতাংশ করা হয়েছে। এ ছাড়া লাইমস্টোন ও ডলোমাইটে ১০ শতাংশ হারে সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। নতুন উৎপাদন করা সিগারেট বাজারে না এলেও বাড়তি দাম নেয়া হচ্ছে।

উড়োজাহাজের টিকিট: অভ্যন্তরীণ রুট ও সার্কভুক্ত দেশের উড়োজাহাজের টিকিটে ৫০০ টাকা হারে আবগারি শুল্ক দিতে হয়। এটা যৌক্তিকীকরণের জন্য অভ্যন্তরীণ রুটে ২০০ টাকা বাড়িয়ে ৭০০ টাকা ও সার্কভুক্ত দেশে বর্তমানে দ্বিগুণ এক হাজার টাকা করা হচ্ছে। এ ছাড়া এশিয়ার দেশগুলোতে ২ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে আড়াই হাজার টাকা এবং ইউরোপের দেশগুলোতে ৩ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে চার হাজার টাকা করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে বর্ধিত সেই শুল্ক টিকিটের দামের সঙ্গে যুক্ত করে নতুন দামে টিকিট বিক্রি শুরু করেছে বিমান সংস্থাগুলো। ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের মহাব্যবস্থাপক মো. কামরুল ইসলাম জানান, বছরের মাঝপথে হঠাৎ করে আবগারি শুল্ক বাড়ানোয় ব্যবসা ও ভোক্তা পর্যায়ে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। আকাশপথে যাতায়াত অনেকটা প্রয়োজনীয় সেবার মতো হয়ে গেছে। ফলে সার্বিক বিষয় বিবেচনা করে এই শুল্ক প্রত্যাহার করা উচিত।

ফুঁসছে মূল্যস্ফীতি: প্রায় তিন বছর ধরে চলতে থাকা উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে স্বস্তিতে নেই ভোক্তারা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, গেল বছর গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ১০.৩৪ শতাংশ। তার আগের বছর ২০২৩ সালে এই হার ছিল ৯.৪৮। গত বছর উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে ছিল মানুষ। সে তুলনায় মানুষের আয় বাড়েনি। 

কনজ্যুমার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এসএম নাজের হোসাইন বলেন, যেসব পণ্যের দাম বাড়ানো হয়েছে এগুলো জীবন-জীবিকার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এগুলোর ওপর ভ্যাট ও শুল্ক বাড়ানোর প্রভাব পড়বে ভোক্তার ঘাড়ে। 

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডি’র বিশেষ ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, শুল্ক বাড়ানোর প্রভাব শেষ পর্যন্ত ভোক্তার উপর গিয়েই পড়ে। এতে মধ্যবিত্ত ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ওপর সবচেয়ে বেশি চাপ পড়বে। এমনিতেই মানুষ কষ্টে রয়েছে, এরপর কর বৃদ্ধির সিদ্ধান্তের কারণে মানুষের কষ্ট আরও বাড়বে। 

বিভিন্ন পণ্য ও সেবার ওপর সরকারের এমন ভ্যাট এবং করারোপের সিদ্ধান্তকে হঠকারী বলে মনে করেন সাধারণ ক্রেতারা। রাজধানীর মগবাজারের বাসিন্দা বিলকিস আক্তার বলেন, বাজারে সবকিছুরই দাম বেশি। সংসারের সাধারণ চাহিদাও মেটানো যাচ্ছে না। অনেক প্রয়োজনকে কাটছাঁট করতে হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে সরকার ভ্যাট বাড়ানোর কারণে আমাদের মতো নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারগুলোকে আরও সংকটের মুখে ফেলে দিচ্ছে। এমন সিদ্ধান্ত থেকে সরকারের সরে আসা দরকার।