নব্বইয়ের দশকে যখন বাংলা কাব্যে টানাপোড়েন চলে তখন অনেকেই হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। আদৌ এ টানাপোড়েন থেকে কাব্যের উত্তরণ সম্ভব কিনা এ নিয়ে তৎকালীন সময়ে অনেকেই জোরালো সংশয় প্রকাশ করেছেন। আবার কেউবা নিভৃতচারীদের মতো ব্যর্থতা গোচনে নিরলস চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। প্রকৃতপক্ষে শূন্যস্থান কখনোই শতভাগ পূরণ হয় না। আর কাব্য সাহিত্যেই হোক আর রাজনীতির ময়দানেই হোক মূলের টানাপোড়েন শুরু হলে তা যেমন সার্থকতা লাভ করে না, তেমনি কালের স্রোতেও টিকে থাকে না। নব্বইয়ের টানাপোড়েন থেকে বের হওয়ার জন্য কবি খালেদ উদ-দীনের চেষ্টার যেন ত্রুটি ছিল না। সমাজ, রাষ্ট্র, বিশ্ব পরিমণ্ডল থেকে প্রতিনিয়ত উপাদান নিয়ে কবিতায় নতুনত্ব আনয়নের চেষ্টা করতেন। তাঁর প্রথম কাব্য ‘রঙিন মোড়কে সাদা কালো’ থেকে দ্বিতীয় কাব্য ‘ভাঙ্গা ঘর নীরব সমুদ্র’ বইটিতে প্রকরণ ও বিষয় বৈচিত্র্যে বিশদ পার্থক্য রয়েছে। যা কাব্যটিকে স্বতন্ত্র ব্যঞ্জনা দান করেছে।
কবি খালেদ উদ-দীনের দ্বিতীয় প্রকাশিত কাব্য ‘ভাঙ্গা ঘর নীরব সমুদ্র’ উৎস প্রকাশন থেকে ২০০৯ সালে অমর একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে। তিন ফর্মার এই বইটিতে মোট ৩৮টি কবিতা রয়েছে। বইটি উৎসর্গ করা হয়েছে নীলপদ্মকে।
খালেদ উদ-দীন সাহিত্যের একজন নিবেদিত প্রাণ। মৌলিক সাহিত্য সৃষ্টিই তাঁর প্রধান লক্ষ্য। তাঁর শব্দ বুননের কৌশলে চমক রয়েছে। পাঠকমাত্রই এ সত্য স্বীকার করবে বলে আমার বিশ্বাস। চুম্বক যেমন লোহা জাতীয় পদার্থকে আকর্ষণ করে তেমনি খালেদ উদ-দীনের কবিতাও পাঠককুলকে নিঃসন্দেহে কাছে টানে। দীর্ঘদিন থেকে তিনি সাহিত্য চর্চায় নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। এক নজরে তাঁর সৃষ্ট সাহিত্যকর্মগুলো হল:
কাব্যগ্রন্থ:
রঙিন মোড়কে সাদা কালো ২০০৮
নীল সাগরের তীরে (যৌথ)
এই পদ্যের গাও গেরাম (যৌথ)
ভাঙ্গা ঘর নীরব সমুদ্র ২০০৯
জলপাতালে মিঠে রোদ ২০১৫
সম্পাদনা: বুনন
সহযোগী সম্পাদনা: বাউলা
কবি খালেদ উদ-দীনের ‘ভাঙ্গা ঘর নীরব সমুদ্র’ কাব্যটির বৈশিষ্ট্য নিম্নরূপ-
ক. সত্য প্রকাশে নিরঙ্কুস প্রত্যয়
খ. আত্মদৃষ্টি
গ. বৈশ্বিক জটিলতা
ঘ. দেশীয় রাজনীতি
ঙ. বিপন্ন মানবিকতা হালচাল
চ. ধর্মীয় গোঁড়ামীর স্বরূপ
ছ. সমকালীন বাস্তবতা
জ. ইতিহাসের ছায়াপাত
ঝ. অবক্ষয়ের করুণ চিত্র
ঞ. দেশপ্রেম
ট. শ্রেণি বৈষম্য
ঠ. প্রকৃতিপ্রেম
ড. মানবতা
ঢ. ভাবী স্বপ্নের পূর্বভাস
ড. বিবিধ
মধ্যযুগে শ্রীচৈতন্য বলেছিলেন, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তার উপরে নাই’ – বাক্যটি ছোট হলেও এর ভিতর দিয়ে মানবতার জয়গানকেই মূলত তিনি তোলে ধরেছিলেন। কবিরা মূলত সত্য ও সুন্দরের পূজারি। তবে সত্য বলার সাহস সব কবিদের ক্ষেত্রেই দেখা যায় না। প্রার্থনালয় থেকে যে মানব সেবাই উত্তম-কবি সে দিকটির প্রতিই অঙ্গুলি নির্দেশ করেছেন।
“মিলেমিশে একাকার হয়ে দেখেছি ওখানে কিছু নেই
পরম মমতায় হাত রেখেছি, কেঁপে উঠেছে বোধের শরীর
বিশ্বাসের সাদা কফিনে মুড়িয়ে শবযাত্রার মিছিলে
তুলসি পাতা অথবা গীর্জায় ঈশ্বর একাএকা কেঁদেছে”।
উৎস: বোধের শরীর, পৃষ্ঠা ১১
যুগ জটিলতা কবিকে বড় বেশি ভাবিয়ে তোলেছে। সত্যিকার অর্থেই কবিরা একটু বেশি আবেগপ্রবণ হয়। বোধের আঙিনায় তারা একটু বেশিই কাতর হয়ে থাকেন। ফলে সমাজ কিংবা রাষ্ট্রে ঘটে যাওয়া সাধারণ ত্রুটি-বিচ্যুতিতেও তারা অনেকটাই কাতর হয়ে পড়েন। কোন ধরনের সীমাবদ্ধতা দেখলেই কবি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন।
“খুব সহজ নিয়মেই বন্দি হয়ে আছি, চারদিকে সীমান্তের কাঁটাতার
এপার-ওপার ছুটাছুটি বৃথা, রাইফেল হাতে দাঁড়িয়ে আছে প্রহরী
------------------------------------------------------------------
আসলে পৃথিবীটাই একটা মস্তবড় কারাগার, বেরুনোর পথ নাই”।
উৎস: খাঁচা, পৃষ্ঠা ১২
কবি খালেদ উদ-দীন তাঁর কাব্যে রোমান্টিকতা তোলে ধরেছেন নিজের মতো করে। নকশি কাঁথা শিল্পীরা যেমন আপন মনে শিল্পের বুনন করে চলে তেমনি তিনিও তাঁর কাব্যে রোমান্টিকতার বুনন করেছেন। সে বুননের সাথে মিশে আছে কবি সত্ত্বার প্রাণ। জগৎ সংসারের অনেক স্পষ্ট জিনিসও খুব কাছে থেকে দেখলে অস্পষ্ট মনে হয়। দীর্ঘ দিন কাছাকাছি থাকার পরও প্রিয় মানুষটিকে অচেনা লাগে, অচেনা লাগে তার গতিপথ।
“আমাদের ভালোবাসার সংসারে শুধুই গ্রহণকাল
অথচ তোমার ফর্সা হাতের রেখায়; দেখো-
আঁকাবাঁকা পথগুলোও কত অস্পষ্ট”।
উৎস: কবুতর ও অন্যান্য ছবি, পৃষ্ঠা ১৪
নির্মম বাস্তবতার কষাঘাতে কবি বারবার জর্জরিত হয়েছেন। নিজের প্রাজ্ঞতা, বিজ্ঞতা অনেক সময়ই চলার পথে হয়ে উঠেছে প্রশ্নবিদ্ধ। সত্য ও সুন্দর প্রকাশে কবি ছিলেন সদাই তৎপর। সমাজের কুৎসিত রূপকেও তিনি অনেকটা ব্যঙ্গাকারে উপস্থাপন করেছেন তার কবিতায়।
“মনে রাখবেন সুধীজন,
কেবল অভিজ্ঞতাই একমাত্র অযোগ্যতা
বিবেচনায় রাখবে তুমিও!”
উৎস: নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি, পৃষ্ঠা ১৫
শিক্ষকদের শিক্ষাদানের পরিসর সীমিত। একটি নির্দিষ্ট পরিকাঠামোতেই তারা শিক্ষাদান করে থাকেন। কিন্তু কবিদের পরিসর সে তুলনায় সুবৃহৎ। মনে রাখা উচিত যে, কবিরা হচ্ছেন সমাজের শিক্ষক। সমাজ ও সভ্যতার বিকাশে সৃষ্টিশীল লেখনীর মাধ্যমে তারা প্রতিনিয়ত নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। সমাজের কোথাও অবক্ষয় দেখলেই তারা কাতর হয়ে ওঠেন। আর তখনি তাদের কলম গর্জে ওঠে।
“দেখতে গেলে আলো চাই, খোলা চোখ যেখানেই হোক
একটু আলো দরকার; অন্ধকার কেবল দীর্ঘশ্বাসের জন্ম দেয়”।
উৎস: রঙের পাখি, পৃষ্ঠা ১৬
ভাষার কাজ হচ্ছে সরলীকরণ। প্রাচীন যুগের সাহিত্য থেকে মধ্যযুগের সাহিত্যকে যেমন ভাষার প্রয়োগের কারণে চিনা যায় তেমনি আধুনিক যুগের সাহিত্যকেও স্পষ্ট উপলব্ধি করা যায়। কবি খালেদ উদ-দীনের কবিতার মধ্যে ভাষার সরলীকরণ রয়েছে। ছেলে-বুড়ো পাঠমাত্রই হৃদয়ঙ্গম করতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস। তবে তার সাহিত্যে যে আঞ্চলিকতার প্রভাব রয়েছে তা যেন কোন ভাবেই কবি অস্বীকার করতে পারেন না। ভাষা প্রয়োগের ক্ষেত্রেও তিনি অনেকটা অবচেতন মনেই আঞ্চলিকতাকে নিয়ে এসেছেন।
আবার হতে পারে এটা মুদ্রনজনিত ত্রুটি! এ সম্ভাবনাকেও নিছক উড়িয়ে দিচ্ছি না। তবে পুরো কাব্যটি পড়লে মনে হয় কাব্যটির প্রকাশনার ক্ষেত্রে অনেকটাই অযত্ন করা হয়েছে। বিশেষ করে বানান সতর্কতার ক্ষেত্রে লেখক ও প্রকাশক উভয়কেই অনেকটা কাঁচা মনে হয়েছে। তবে আমি মনে করি বই হচ্ছে লেখকের কাছে সন্তানতুল্য। সুতরাং সে দৃষ্টিকোণ থেকে কবি বা লেখকে অবশ্যই যত্নবান হওয়া উচিত-ঠিক সন্তানদের ক্ষেত্রে আমরা যেভাবে যত্নবান হই।
তাঁর নিচের কবিতাদ্বয়ের মধ্যে তিনি আঞ্চলিকতার ছাপ রেখেছেন। নিম্নের পংক্তিতে দাগযুক্ত শব্দদ্বয় সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় বহুলভাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। মান ভাষায় হবে ‘ঠায়’, ‘টিকে’।
“তোমাকে শুধ একপলক দেখবো বলে, টায় দাড়িয়ে থাকি
আসা যাওয়ার পথে যদিবা দেখা হয়ে যায়”।
উৎস: তোমাকে দেখবো বলে, পৃষ্ঠা ১৯
“তোমাদের মাঝে কিন্তু আমি নেই আছি অন্যখানে
যেখানে সভ্যতা নিয়ে ঠিকে আছে অগণিত অ্যালবেট্রস!”
উৎস: অস্তিত্বহীন, পৃষ্ঠা ২২
দুর্নীতিবাজদের মূলত কোন দেশ-কাল নেই। সব জায়গায়ই এদের রূপ এক। দর্পণের রূপ যেমন সর্বত্রই এক তেমনি আর কি! চোখের সামনে ঘটা সামাজিক বিচ্যুতিগুলো কবিকে বেশ ভাবিয়ে তোলে। বিশ্ব রাজনীতির কুটিল চিত্র অবলোকন করে কবির ভিতরে প্রবল হতাশা জেগেছে। আবেগে বিহ্বল হয়ে পড়েছেন। আশু সমাধানের আশায় হৃদয় নগরে ক্ষরণ হয়েছে। নিজের সেসব নৈর্ব্যক্তিক কথাগুলোই তিনি তাঁর কবিতায় অত্যন্ত দক্ষতার সাথে তোলে ধরেছেন।
“চোখের সামনে পুড়ছে গাজা, লাশের ওপর লাশ
বিচারগুলোও কত আজগুবি। একতরফা দখলে পাড়ার ঘরগুলো
বুকের উপর পাথর রেখে বস্ত্র হরণের প্রতিযোগিতায়-
আমাদের বুশ প্রশাসন, আর নব্য ওবামা দু’জনে সমানে সমান”।
উৎস: আমাদের সাজানো বাগান, পৃষ্ঠা ২০
কবিরা মূলত স্থায়ী কোন বন্ধনে আবদ্ধ হতে সব সময়ই অনীহা প্রকাশ করেন। মুক্ত আকাশে বিচরণ করা পাখিদের মতোই তারাও নিজেকে সর্বদা মুক্ত রাখতে স্বাচ্ছন্দবোধ করেন। আবার নিজেই পরিবর্তন আনয়নের জন্য স্বেচ্ছা দুঃখকে বরণ করে নেন। আলাউদ্দিন আল–আজাদের কবিতার ভাষায় বলা যায়-
“দুঃখ তুমি আমার প্রিয়তাম
দুঃখ তুমি কাছে কাছেই থাকো
মিথ্যা সুখের অনেক গ্লানিই জমা
জ্বরতপ্ত কপালে হাত রাখো”।
কাজেই অজানাকে জানার নেশাই মূলত কবিকে নতুনের পানে হাতছানি দেয়। আর কবিও স্বানন্দে সে পথে হেঁটে চলেন।
“হেলেপড়া সূর্যের আলোয় তুমি এসেছিলে এক বিকেলে
দরজায় দাঁড়িয়ে ইতস্তত করেছিলে-বলেছিলাম এসো
-------------------------------------------------
আজ নিজেকে নিয়ে চলেছি গন্তব্যহীন অজানা এক পথে”।
উৎস: অজানা এক পথ, পৃষ্ঠা ২১
বার্ণাড জোসেফ চমৎকার একটি কথা বলেছেন- “এমন কোন রাত নেই যার ভোর হবে না। এমন কোন দুঃখ নেই যা সময়ে ফিকে হয়ে আসবে না” কাজেই কোন কাজে ব্যর্থ হলে হতাশ হতে নেই কবি এ মূলমন্ত্র ভালো করেই জানতেন। সত্য প্রকাশে কবি যেমন অকোতুভয় তেমনি সত্য অনুসন্ধানেও কবি ছিলেন সিদ্ধহস্থ।
“তুমি নিশ্চয়ই কাক আর কোকিলের কথা জান
-------------------------------
প্রকাশিত সত্যের আড়ালে ইতিহাস বড় যত্নের, ভালোবাসার”।
উৎস: তুমি তো জান সব, পৃষ্ঠা ২৬
অলংকারের নিপুণ ব্যবহারের ক্ষেত্রেও তিনি বেশ পাণ্ডডত্য দেখিয়েছেন। তাঁর কবিতার শরীর জুড়ে পশ্চাৎ সংস্কৃতির টান রয়েছে। বাস্তবতার সুঘ্রাণ রয়েছে। শব্দের গাঁথুনিতে নিজস্ব ঢঙ রয়েছে। তবে ব্যাকরণিক দিক দিয়ে বিশ্লেষণ করলে নিম্নের দাগযুক্ত বাক্যটিকে ত্রুটিমুক্ত বলা যায় না। বাক্যটিতে ‘সখ্যতা’ শব্দটি হয়ত অজ্ঞাতসারেই এসেছে। যা হওয়া উচিত ছিল সখ্য! কেননা, বাংলা ভাষায় সখ্যতা বলে কোন শব্দ নেই। তাঁর প্রথম কাব্য রঙিন মোড়কে সাদা কালো’ কাব্যেও এর প্রয়োগ করেছেন। এই ক্ষুদ্র ত্রুটিসত্ত্বেও এই পংক্তিদ্বয় আমাদের ভাবনার দিগন্তকে যথেষ্ট প্রসারিত করে। চিন্তনের পরিসরকে আরও ব্যপ্ত করে তোলে।
“তোমার আমার সখ্যতা সে সকলেরই জানা, চোখের সামনে
আমাদের পথচলা সেও বিরামহীন, পথের শেষে নতুন পথ”।
উৎস: কাঁটাতারের প্রাচীর, পৃষ্ঠা ২৯
ডব্লিউ এল গিলবার্ট মনে করেন, “সৌন্দর্য ধীরে ধীরে মুছে যাবে কিন্তু ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা কখনো সত্যিকারভাবে নিঃশেষ হয় না। কারণ যখনই ভাঙ্গন দেখা দেয় তখনই একে পুনরোদ্ধার করা যায়”। কবি খালেদ উদ-দীনের ক্ষেত্রেও যেন কথাটি শতভাগ সত্যি। নিজের প্রত্যেকটি কাজের প্রতিই তিনি যেমন দরদী তেমনি পরিচ্ছন্নও বটে। দর্পণে যেমন নিজের ক্ষতগুলো স্পষ্ট অবলোকন করা যায় তেমনি কবি খালেদ উদ-দীনের কবিতাতেও সমাজের ক্ষতগুলো, বিচ্যুতিগুলো শব্দ ব্যঞ্জনায় দর্পণের মতোই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
“শাদা কবুতর উড়িয়ে যখন শান্তির স্বপক্ষে শ্লোগান হচ্ছিল
কবুতরের একটা পালক তখন বক্তার উপর খসে পড়ে
আর এভাবেই ঝকঝকে আলোর পেছনে গাঢ় অন্ধকারে
প্রতিনিয়ত ঘটে যাচ্ছে মুখোশ সভ্যতার নানাবিধ নিদর্শন”।
উৎস: শাদা কবুতর: পৃষ্ঠা ৩০
তার অনেক কবিতাতেই অপ্রয়োজনীয় শব্দের বহুল ব্যবহার রয়েছে। যদিও শব্দগুলো বর্তমানে বাংলা ভাষায় বহুলভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে তথাপিও বাংলা ভাষা প্রয়োগকেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া উচিত। তাতে করে একদিকে যেমন রচনা প্রাঞ্জল হয় অপরদিকে ভাষার প্রতি প্রেম বা দরদও অক্ষুণ্ন থাকে। তাছাড়া বানানের দুর্বলতা কাব্যকে যেমন মানের দিক থেকে নিচে নামিয়ে আনে তেমনি কবিকেও সমালোচনার কাঠগড়ায় এনে দাঁড় করায়। নিচের কবিতাটিই তার প্রমাণ রাখে।
“অনেক যত্নের লেম্পপোস্ট হরেক রঙে রাঙানো ছিল
ঝলমলে জৌলুস্যে দিগ্বিদিক উড়ছিল সাহসী ফ্লেগ
ইদানিং ফিকে হয়ে যাওয়া ভৈববে চারদিক কেবল অসাঢ়”
উৎস: কে যেন ডাকে, পৃষ্ঠা ৩২
মাদক যেমন নেশার সৃষ্টি করে তেমনি দেশের সবুজ প্রকৃতি, মা ও মাটিও কবিকে কবিত্ব প্রকাশে প্রতিনিয়ত নেশার মতোই উজ্জিবিত রাখে। তিনি নিজে ঠকতে শিখেছেন কিন্তু কাউকে ঠকাতে শিখেননি। দেশের প্রতি অফুরন্ত ভালোবাসাই কবিকে নতুন থেকে নতুনতর হতে সাহায্য করে। প্রমথ চৌধুরীর কবিতার ভাষায়-
“তোমাতে আমাতে আছে মিল এই মাত্র,
ঠকিতে যদিও শিখি, শিখিনি –ঠকামি,
জীবনে জ্যাঠামি আর সাহিত্যে ন্যাকামি,
দেখে শুধু জ্বলে যায় আমাদের গাত্র,
কারো গুরু নই মোরা, প্রকৃতির ছাত্র,
আজও তাই কাঁচা আছি, শিখিনি পাকামি”।
তাঁর কবিতার পংক্তির ভাঁজে ভাঁজে দেশপ্রেমের নিটোল চিত্রই যেন স্পষ্ট ফুটে ওঠে।
“জীবন কখনো থেমে যায় না বরং থেমে থাকে ফেলে আসা দিন
জীবন কখনো পিছু হাঁটে না, বরং প্রেরণাহীন সময় পিছু হাঁটে
শরাব পাত্রের মতো বিশ্বাসী এক জন্মভূমি!”
উৎস: জীবন শুধু, পৃষ্ঠা ৩৩
সাহিত্যের কাজই হচ্ছে নদীর মতো এঁকেবেঁকে চলা। নদী যেমন কিছুদূর যাওয়ার পর মোড় নেয় তেমনি সাহিত্যের ক্ষেত্রেও ঘটে। কবিরা প্রতিনিয়ত নিজেকে ভাঙ্গে এবং গড়ে। কাব্যে সে প্রভাবও কিন্তু অস্বীকার করার মতো নয়। এক সময় বাংলা কবিতায় পদ্যের ঝনঝনানি ছিল কিন্তু কালের স্রোতে তা অনেকটাই ম্লান হয়ে পড়েছে। পরিবর্তনের জয়রথ চালিয়ে কাব্যে এসেছে নতুনত্বের ধারা। কবির কবিতার পংক্তিগুলোই সে স্বাক্ষর বহন করে চলছে।
“গদ্যের নদী বয় সকালের শিশির ভেজা দূর্বায়
কবি এলে দিন মজুরের বউ
পিঠা চিরে খই নিয়ে খাড়া
যেহেতু এখন কবিতার কাল যাচ্ছে, যাচ্ছে কণ্ঠ স্রোতের তোড়”
উৎস: কাব্যালাপ, পৃষ্ঠা ৩৫
রোমান্টিক কবি সময়ের যাতাকলে পড়ে নিজে হয়েছেন ক্ষতাক্ত। অবশ্য বৈশ্বিক উষ্ণতাও এর জন্য কোন অংশে কম দায়ী নয়। জলবায়ু যেমন পরিবেশের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে তেমনি কবি প্রেয়সীও কবির ওপর প্রভাব ফেলে। প্রেয়সীর আনন্দে মনে হয় পৃথিবী আনন্দিত, মুখরিত; আর তার বেদনায় পৃথিবীকে মনে হয় মুহ্যমান। সামাজিক বিচ্যুতি দেখলে কবির ভেতর যেমন ক্ষরণ হয় তার চেয়েও অধিক ক্ষরণ হয় প্রেয়সীর অবহেলায়। রোমান্টিকতার এমন চমৎকার চিত্রকল্প অত্যন্ত দরদ দিয়ে ফুটিয়ে তোলেছেন তাঁর কবিতায়। নিচের কবিতাদ্বয় নিঃসন্দেহে তার প্রমাণ রাখে।
“যেখানে চলাচল নিরাপদ, সেখানেই যাওয়া ভালো
সময় আর তুমি আমাকে বড় অবহেলায় রেখেছ
এখন তো সবই গেল, ভেতরে শুধু পুড়ে যাওয়া হাহাকার”।
উৎস: নিরাপদ গন্তব্য: পৃষ্ঠা ৩৬
“যা ছিল আর যা ছিল না
কী আশ্চর্য- চলে গেলে! ভোগের সাগরে কাটতে সাঁতার
বড় সাধের ভালোবাসা, নিজ হাতে গড়া যত্নের শিল্পসৌধ রেখে!”
উৎস: জীবন শুধু: পৃষ্ঠা ৪০
কবি তাঁর কবিতাতে নিজস্ব ঢঙ্গের প্রলেপ দিয়ে কাব্যে এনেছেন নতুনত্ব। তাছাড়া তাঁর কাব্যে অনেক দার্শনিক পদবাচ্যও লক্ষ্য করা যায়- যা অনেক কবির কাব্যেই বিরল! যেমন-
“সুখে থাকার চেয়ে সুখী মানুষ দেখার আত্মবোধ
সব সময়ই বড় আনন্দের। বড় বেশি তুপ্তির আমার নিজস্বতা, আর অর্জিত সকল সত্যে-
তোমাকে বারবার করি নমস্কার”।
উৎস: তোমার চলে যাবার পর: পৃষ্ঠা ৪৫
তিনি তার কাব্যে বর্জন চিহ্নের বহুল ব্যবহার করেছেন যা কাব্যটিকে নতুন ব্যঞ্জনা দিয়েছে আর সেই সাথে কাব্যটিকে করেছে প্রশ্নবিদ্ধ। কবির কাজ সত্য ও সুন্দর প্রকাশ করা, কোন কিছু গোপন রাখা নয়।
কবি খালেদ উদ-দীন সমকালীন জীবনধারা ও জীবনবোধকে তাঁর কাব্যে তোলে ধরার চেষ্টা করেছেন নিজের মতো করে। তার মনে হয়েছে কবিতার জগৎ সুবর্ণ সময় পার করছে। কবির কবিতাতে এমনই চিত্র ধরা পড়ে-
“কবিতার আকাশে এখন পায়রা উড়ছে
কবিতা হয়ে উঠছে পায়রাগুলো
যেখানে জলপরীরাও বাড়িয়ে রেখেছে মুখ।
---------------------------------
এইসব কবিতার মতো। কবিতা হয়ে হয়ে...”।
উৎস: এইসব দিন রাত্রি, পৃষ্ঠা ৪৮
আধুনিক অনেক কবিরাই বিরাম চিহ্ন প্রয়োগের ক্ষেত্রে উদার। কিন্তু সেদিক থেকে কবি খালেদ উদ-দীন ব্যতিক্রম। কবি শামসুর রাহমানের মতো কবি খালেদ উদ-দীনও সমকালীন বাস্তবতাকে নিজের মতো করে তার কাব্যে তোলে ধরার চেষ্টা করেছেন।
দেশের পটভূমি থেকে তিনি উপাদান গ্রহণ করতেন। অতঃপর নিজের কাব্যশক্তির রঙে তা আরও রঙিন করে তোলতেন। তাঁর ‘ভাঙ্গা ঘর নীরব সমুদ্র’ কাব্য চিত্রকল্প সাজাতে তিনি সত্যিকার অর্থেই দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন।
তবে ভাষার সরলীকরণের কারণে পাঠক যে তাঁর কাব্য পাঠে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পড়ে আরামবোধ করবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। কাব্যে অনেক কবিই দর্শন চর্চা করে থাকেন। তবে তা যেমন প্রত্যাশিত নয় তেমনি কোন কাব্যে তার ব্যহার থাকলেও তা অনভিপ্রেত নয়।
কবি খালেদ উদ-দীনের কাব্যে সময়ের বন্দনা রয়েছে। রয়েছে নান্দনিকতার সৌকর্যবোধ। অতি মাত্রায় ভাবের প্রবাহ থেকেও তিনি নিজেকে মুক্ত রাখার চেষ্টা করেছেন। ফলে তার কবিতাগুলো হয়ে উঠেছে বাস্ত ঘেঁষা।
কবি খালেদ উদ-দীনের কবিতায় স্ববিরোধী কথা না থাকলেও বিন্যাস ও প্রকরণে যে তা গতানুগতিক এটা খুবই স্পষ্ট। উপমা ব্যবহারে যদিও তিনি সিদ্ধহস্থ তথাপি এ কাব্যে এর সফল প্রয়োগে অনেকটাই ঘাটতি লক্ষণীয় । তাঁর কাব্যে সমকালীন কবিদের ঈষৎ প্রভাব থাকলেও তা উদাহরণ হিশেবে টানার মতো নয়। সত্য ও সুন্দর প্রকাশের ক্ষেত্রে তার কাব্য নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে। কালের যাত্রায় সত্য ও সুন্দরের জয় হোক।
-------------------
উৎসঃ সামহোয়ারইনব্লগ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন