Image description

বান্দরবান পার্বত্য জেলার আলীকদমের পাহাড় থেকে চট্টগ্রাম শহরে পাচার হচ্ছিল বিপন্ন প্রজাতির দুটি লজ্জাবতী বানর ও একটি প্যাঁচা। বিষয়টি বনাঞ্চল রক্ষায় নিয়োজিত বন বিভাগের কেউ না জানলেও ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল পুলিশ অর্গানাইজেশন (ইন্টারপোল) থেকে খবর পৌঁছে পুলিশ সদর দফতরে। 

পুলিশ সদর দফতর থেকে অবহিত হন চট্টগ্রামের লোহাগাড়া থানার ওসি আতিকুর রহমান। দেরি না করে তিনি তাৎক্ষণিক অভিযানে নামেন। শেষমেশ চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের বার আউলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের সামনে থেকে উদ্ধার করা হয় প্যাঁচা ও লজ্জাবতী বানর দুটি। 

রোববার ওই অভিযানের বিষয়ে লোহাগাড়া থানার ওসি মোহাম্মদ আতিকুর রহমান বলেন, হেডকোয়ার্টারের মাধ্যমে ইন্টারপোল থেকে পাওয়া তথ্যে বন্য প্রাণীগুলো উদ্ধারের পাশাপাশি গ্রেফতার করা হয় চার পাচারকারীকে। জব্দ করা হয় একটি মোটরসাইকেলও। গ্রেফতারকৃতরা হলো- মোবারক হোসেন (২৭), সাদ্দাম হোসেন (২৭), মো. মহিউদ্দিন (২৪) ও মো. আজহার সিকদার (৪২)। পরে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে তাদের প্রত্যেককে ৬ মাসের কারাদণ্ড ও ৫ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়। আর অভিযানে উদ্ধার হওয়া বন্য প্রাণীগুলোকে স্থানীয় বন কর্মকর্তার কাছে হস্তান্তর করা হয়। তিনি বন্য প্রাণীগুলোকে নিরাপদ আবাসস্থলে অবমুক্ত করেন। আর দণ্ডপ্রাপ্ত চারজনকে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রেরণ করেন।

এর আগে গত ১০ নভেম্বর চুনতি অভয়ারণ্যের ফরেস্ট রেঞ্জ কর্মকর্তার কার্যালয়ের সামনে একটি যাত্রীবাহী বাস তল্লাশি করে উদ্ধার করা হয় একটি সজারু ও দুটি লজ্জাবতী বানর। এরশাদ নামের এক যুবক এসব বন্য প্রাণী কক্সবাজার থেকে ঢাকায় নিয়ে যাচ্ছিলেন। 

গত ২৭ অক্টোবর লোহাগাড়া বাসস্ট্যান্ড এলাকা থেকে উদ্ধার করা হয় একটি বনমোরগ ও তিনটি মেছোবিড়াল। বান্দরবানের আলীকদম উপজেলার গহিন বন থেকে বিপন্নপ্রায় প্রাণী চারটি ধরা হয়। গ্রেফতার করা হয় মো. এমরান ও মো. আলীম উদ্দিন নামের দুই পাচারকারীকে। জব্দ করা হয় নম্বরবিহীন একটি মোটরসাইকেল।

৮ অক্টোবর বান্দরবানের আলীকদম এলাকা থেকে চট্টগ্রাম শহরে পাচার হচ্ছিল বিপন্ন প্রজাতির একটি উল্লুক। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের চুনতি অভয়ারণ্যের ফরেস্ট রেঞ্জ কর্মকর্তার কার্যালয়ের সামনে একটি যাত্রীবাহী বাস থেকে উল্লুকটি উদ্ধার করা হয়। সঙ্গে মো. মুবিন ও মাজহারুল নামের দুই পাচারকারীকে গ্রেফতার করা হয়। পরে তাদের ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ১ বছর কারাদণ্ড ও ১০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।

ইন্টারপোল থেকে পাওয়া গোয়েন্দা তথ্য বিশ্লেষণ করে অভিযান চারটি পরিচালনা করা হয় বলে জানান লোহাগাড়া থানার ওসি আতিকুর রহমান। 

বন্য প্রাণী পাচারে আন্তর্জাতিক চক্র : ওসি আতিকুর রহমান আরও বলেন, চারটি অভিযানে গ্রেফতারকৃত পাচারকারীদের তথ্যানুযায়ী, বন্য প্রাণীগুলো চট্টগ্রাম হয়ে দেশের বাইরে পাচার করা হচ্ছিল। এসব বন্য প্রাণী পাচারে আন্তর্জাতিক চক্র জড়িত। দেশের মধ্যেই এই চক্রের একাধিক গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। 

এর মধ্যে পাচারকারী মোবারক হোসেন জানান, শুক্রবার বিকালে উদ্ধার হওয়া প্যাঁচা ও লজ্জাবতী বানর দুটি বান্দরবান পার্বত্য জেলার আলীকদম থেকে একটি চক্র লোহাগাড়ায় আনছিল। লোহাগাড়া থেকে চট্টগ্রাম পৌঁছে দেবে আরেকটি চক্র এবং চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় নিয়ে যাবে অন্য একটি চক্র। সর্বশেষ ঢাকা থেকে পাবনা নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল আরেকটি গ্রুপের। উল্লুক উদ্ধারের আগেও তিন গ্রুপের মধ্যে হাতবদল হয়। 

যেখানে পাচার হচ্ছে বন্য প্রাণী : সংশ্লিষ্টদের মতে, বাংলাদেশ থেকে বাঘের চামড়া, হাতির দাঁত ও শরীরের বিভিন্ন অংশ, উল্লুক, কচ্ছপ, লজ্জাবতী বানর, বনরুই, মেছোবিড়াল, কড়ি কাইট্টা, গন্ধগোকুল, তক্ষক, ব্যাঙ, সাপ ও সাপের বিষসহ বিভিন্ন বন্য প্রাণী এবং এসব প্রাণীর দেহের অংশ পাচার হয়ে থাকে। 

তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চক্র বাংলাদেশকে রুট হিসেবে ব্যবহার করছে। এ ক্ষেত্রে ভারত থেকে চীন, মিয়ানমার, ভিয়েতনাম, লাওস, কম্বোডিয়া ও আফ্রিকার কয়েকটি দেশে এসব প্রাণী পাচার হচ্ছে। আবার মিয়ানমার ও থাইল্যান্ড থেকেও বাংলাদেশের রুট ব্যবহার করে বিভিন্ন দেশে বন্যপ্রাণী পাচার হচ্ছে। 

পাচার হওয়া দেশগুলোতে ওইসব বন্য প্রাণী ও তাদের দেহ বিশেষ ওষুধ ও খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করে। অনেকে আবার খাঁচায় বন্দি করে বাসার সৌন্দর্য বাড়ানোর জন্য এসব প্রাণী ও তাদের দেহের অংশ কিনে থাকে। যদিও এতে ধ্বংস হচ্ছে বনাঞ্চল, ভেঙে পড়ছে বন্য প্রাণীদের খাদ্যশৃঙ্খল। অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশ।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউটের বন্যপ্রাণী শাখার চট্টগ্রাম বিভাগীয় কর্মকর্তা শেখ মোহাম্মদ রবিউল আলম বলেন, অর্থের লোভে পাচারকারীরা বন্য প্রাণী পাচার করছে। এতে ধীরে ধীরে বন্য প্রাণী কমে যাচ্ছে। ভারসাম্য হারাচ্ছে পরিবেশ। বন্য প্রাণী সংরক্ষণে বন্য প্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের নজরদারি ও অভিযান বাড়াতে হবে।

যা করছে বন্য প্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট : বন্য প্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা নিশ্চিতে বন্য প্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট গত জুন থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ৬ মাসে ৩০৮টি অভিযান পরিচালনা করেছে। এ ছাড়া এ সময়ে পাচারকারীদের বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন থানায় ৬টি মামলা করা হয়েছে। 

বন্য প্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের বন্য প্রাণী পরিদর্শক অসীম মল্লিক এ তথ্য নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, বন্য প্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট ২০২৩ সালের এ পর্যন্ত ৫টি অভিযান পরিচালনা করে ১২টিরও অধিক বন্য প্রাণী উদ্ধার করেছে। এ ছাড়া ২০১২-২২ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ৪২ হাজারের বেশি বন্য প্রাণী উদ্ধার করে প্রাকৃতিক পরিবেশে অবমুক্ত করেছে। 

তিনি বলেন, বন অধিদফতর, পুলিশ, র‌্যাব, কাস্টমস, প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও সারা বাংলাদেশের পাঁচশ-এর অধিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সহায়তায় এসব অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ইন্টারপোলসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা আমাদের সহায়তা করেছে। পাচারকারীরা যশোর, সাতক্ষীরাসহ ওই অঞ্চলের রুট ব্যবহার করে বলে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা জানাচ্ছে। সেই অনুযায়ী ওই এলাকাগুলোতে নজরদারি ও অভিযান পরিচালনা করছি।

বন্য প্রাণী উদ্ধারে গৃহীত কার্যক্রমের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা আরও বেশি তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করছি। পাচারের কোনো ঘটনা দেখলে সঙ্গে সঙ্গে আমাদের কন্ট্রোল রুমের নম্বরে যোগাযোগ করার জন্য সবাইকে অনুরোধ করছি। 

যেভাবে নজরদারি করছে ইন্টারপোল : বিশ্বব্যাপী বিশেষ অভিযানের বিষয়ে ইন্টারপোলের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বৈশি^ক নিরাপত্তার জন্য থান্ডার অপারেশনগুলো গুরুত্বপূর্ণ। কারণ কাঠ ও বন্য প্রাণী শুধু সংরক্ষণের বিষয় নয়, এগুলো প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার পাশাপাশি মানুষের জীবনচক্রের সঙ্গেও জড়িত। অনৈতিকভাবে বড় আর্থিক লাভের আশায় গুরুতর এই সংঘবদ্ধ অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলের পুলিশ সদর দফতরের সহকারী মহাপরিদর্শক (ইন্টারপোল) শরীফ মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আপনি আমাদের মিডিয়া সেলের সঙ্গে কথা বলুন। যা বলার মিডিয়া সেল থেকে বলবে। এটাই আমাদের নিয়ম। আর মিডিয়া সেল থেকে বলা হয়, অভিযানের অংশ হিসেবে ইন্টারপোল বাংলাদেশের বনাঞ্চলে নজরদারি চালাচ্ছে। তাদের গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে বেশকিছু সফল অভিযানও পরিচালনা করেছে পুলিশ। একই সঙ্গে উদ্ধার করেছে বিপন্ন প্রজাতির বিভিন্ন প্রাণী। তবে অভিযান চলমান থাকায় কী পরিমাণ প্রাণী এবং প্রাণীর শরীরের অংশ উদ্ধার হয়েছে তার হিসাব করেনি পুলিশ সদর দফতর।

মিডিয়া সেল থেকে আরও বলা হয়, বিভিন্ন সময় বাংলাদেশ থেকে পাচার হচ্ছে বিপন্নপ্রায় উল্লুক, কখনও লজ্জাবতী বানর। সজারুর সঙ্গে ধরা পড়ছে বনমোরগ, মেছোবিড়ালও। কক্সবাজার ও বান্দরবানের গহিন বনাঞ্চল থেকে বিপন্নপ্রায় এসব প্রাণী পাচার করছে একটি আন্তর্জাতিক চক্র। পাচারের পথ হিসেবে তারা ব্যবহার করছে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার ও ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক। এই পথ ব্যবহার করে পাচারকারীরা এসব বন্য প্রাণী পৌঁছে দিচ্ছে মূল চক্রের হাতে।

এদিকে ইন্টারপোলের ওয়েবসাইট ঘেঁটে জানা যায়, বন্য প্রাণী সংরক্ষণের জন্য সারা বিশে^ থান্ডার-২০২২ শিরোনামে অভিযান পরিচালনা করে সংস্থাটি। অভিযানে সর্বোচ্চ ১২৫ দেশের শুল্ক, পুলিশ, আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট, বন্যপ্রাণী ও বনাঞ্চল সংরক্ষণে জড়িত সংস্থা অংশ নেয়। ষষ্ঠবারের অভিযানে অবৈধ ব্যবসা, প্রক্রিয়াকরণ, রফতানি, সুরক্ষিত বন্য প্রাণী ও বনজপণ্য আমদানির সঙ্গে জড়িত ১৪১ প্রতিষ্ঠান ও ৯৩৪ জনকে শনাক্ত করা হয়। 

আটক করা হয় বিপন্নপ্রায় বিভিন্ন প্রজাতির ১১৯টি বিড়াল, ৩৪টি স্তন্যপায়ী প্রাণী, ২৫টি গণ্ডারের শিং, ৩৪টি প্রাইমেট, ১৩৬টি প্রাইমেট শরীরের অঙ্গ, ৯টি প্যাঙ্গোলিন, ৩৮৯ কেজি প্যাঙ্গোলিনের খুলি, ৭৫০টি পাখি, ৪৫০টিরও বেশি পাখির অংশ, প্রায় ৭৮০ কেজি ও ৫১৬ টুকরো হাতির দাঁত, ২৭টি হাতির শরীরের অঙ্গ, ১৭৯৫টি সরীসৃপ এবং প্রায় ৫০০ কেজি সরীসৃপের অংশ এবং ১১৯০টি কচ্ছপসহ বিভিন্ন প্রাণীর অংশবিশেষ। উদ্ধার করা হয় বিপুল পরিমাণ কাঠ।

বন সংরক্ষণ কর্মকর্তার বক্তব্য : বন্য প্রাণী রক্ষায় ইন্টারপোলের নজরদারির বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম অঞ্চলের বন সংরক্ষক বিপুল কৃষ্ণ দাস বলেন, আসলে ওদের যে প্রযুক্তি ও সক্ষমতা রয়েছে তা কি আমাদের আছে? তবে তারা যে নজরদারি করছে তা তো সবার জন্য কল্যাণকর। তাদের কারণে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বন অধিদফতরসহ সব সংস্থা একসঙ্গে কাজ করতে পারছে।