Image description

নকল নোটের কারবার বা প্রবণতা বেড়েই চলেছে। বিশেষ করে মৌসুমভিত্তিক এই অপতৎপরতা ব্যাপক হারে দেখা দিচ্ছে। এবারও কুরবানির ঈদ সামনে রেখে ফের চাঙ্গা হচ্ছে জাল নোট চক্রগুলো। এখন তাদের মূল টার্গেট পশুর হাট এবং মার্কেট-শপিং মল। এ ছাড়াও নতুন কৌশল হিসেবে খুচরা পর্যায়েও নানা ধরনের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কেনার মাধ্যমে নকল টাকার নোট ছড়াচ্ছে তারা। জাল নোটের তৎপরতা চালাতে গিয়ে সম্প্রতি একাধিক গ্রুপের বেশ কয়েকজন গ্রেফতারও হয়েছে। যারা কি না এর আগেও কয়েকবার একই অপরাধে গ্রেফতার হয়।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তা এবং আইনজীবীরা বলছেন, জাল নোট প্রতিরোধের সুনির্দিষ্ট কোনো আইন না থাকায় জড়িত আসামিরা নানা সুযোগ নিয়ে দুর্বল শাস্তি বা বারবার জামিন পাচ্ছে। কঠোর শাস্তি না থাকার পাশাপাশি বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ নানা প্রযুক্তির সাহায্যে সহজপন্থায় অর্থ কামানোর লোভে জাল নোট চক্রে জড়ানোর প্রবণতা বাড়ছে। তবে ঈদ সামনে রেখে ‘অনলাইন-অফলাইনে’ মনিটরিং বাড়ানো হয়েছে বলেও জানিয়েছেন র‌্যাব ও ডিবি পুলিশের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা।

এ প্রসঙ্গে র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখার পরিচালক লে. কর্নেল মশিউর রহমান জুয়েল সময়ের আলোকে বলেন, জাল নোট চক্র তাদের প্রতারণার জন্য সবসময়ই নতুন নতুন পন্থা বের করার চেষ্টা করে থাকে। বিশেষ করে কুরবানির ঈদ এলে পশুরহাট ও মার্কেট-শপিং মলে তারা জাল নোট ছড়ানোর জন্য টার্গেট নিয়ে কাজ করে। ইতিমধ্যেই তারা তৎপরতা বাড়িয়েছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। সে লক্ষ্যে আগে থেকেই এই অপকর্মের বিরুদ্ধে মনিটরিং শুরু করা হয়েছে। 

জাল টাকার কারবারের প্রবণতা বৃদ্ধির কারণ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে লে. কর্নেল মশিউর রহমান বলেন, এই চক্রগুলো প্রযুক্তির উন্নয়ন বা উৎকর্ষকে বর্তমানে বেশি কাজে লাগাচ্ছে। অনলাইন নানা মাধ্যমে তারা বেশ তৎপর। পাশাপাশি সহজপন্থায় আয় বৃদ্ধির লোভেও এই জাল টাকার কারবারে অনেকে জড়িয়ে যায়। 

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জাল টাকার অন্যতম প্রধান হোতা হিসেবে পুলিশের কাছে অত্যন্ত পরিচিত একটি নাম- মো. কাওসার। এ পর্যন্ত অন্তত ৯ বার এই অপকর্মে গ্রেফতার হয়েছে সে। গত ৯ এপ্রিল ঢাকার ধলপুরে জীর্ণ একটি বাসায় অভিযান চালিয়ে জাল টাকার কারখানা থেকে সরঞ্জামসহ নবমবারের মতো তাকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। গ্রেফতারের পর কাওসারের দেওয়া বক্তব্য এখন নেট দুনিয়ায় ভাইরাল। 

কাওসার তাতে বলেছে, ‘প্রায় ১০ বছর ধরে এই কারবার করছি। ৭-৮ বছর ধরে জেল খেটে আমি নিঃস্ব। এখন কী করব বলেন? যখনই এগুলা (জাল কারবার) গোছায়ে আনি, তখনই আমি গ্রেফতার হই। এই ব্যবসা আর আমারে ‘শুট’ করে না। আর এই ব্যবসা (জাল টাকার কারবার) করব না।’

র‌্যাব ও পুলিশের কর্মকর্তাদের ভাষ্য মতে, কেবল এই কাওসার নন, লিটন, সগির. কামাল, হুমায়ুন কবির, নজরুল এবং মিনারুলদের মতো আরও অনেক জাল টাকার হোতাই একইভাবে বারবার গ্রেফতার হয়ে এক কথাই বলে থাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে। বর্তমানে ফেসবুক এবং ম্যাসেঞ্জারসহ নানা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সুযোগ নিয়ে জাল নোট চক্রগুলো সক্রিয়ভাবে এই অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। চক্রের সদস্যরা এর আগে ফেসবুকে পেজ খুলে নকল টাকা সরবরাহের বিজ্ঞাপন দিয়ে অপতৎপরতা চালিয়েছে। তাদের কেউ কেউ গ্রেফতারও হয়েছে। 

গোয়েন্দাদের তথ্য মতে, রাজধানী ঢাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিশেষ নজরদারির কারণে জাল টাকা চক্রের তৎপরতা ঢাকার বাইরেই বেশি হচ্ছে। বিশেষ করে জাল টাকার কারখানা বা আস্তানা গড়া হচ্ছে এমন কিছু এলাকার বাসা-বাড়িতে যেদিকে সন্দেহ বা নজরদারি একেবারেই কম। বর্তমানে খুলনা, বাগেরহাট, মানিকগঞ্জ ও গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকায় জাল নোট চক্রের তৎপরতা বেশি বলেও জানান গোয়েন্দারা।

এ প্রসঙ্গে জাল টাকাবিরোধী বহু অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের লালবাগ বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মশিউর রহমান সময়ের আলোকে বলেন, জাল টাকা চক্রের পুরোনোরা অধিকাংশই এখন রাজধানীর বাইরে তৎপরতা চালাচ্ছে বলে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। একবার যে এই চক্রে জড়িয়েছে সে আর বের হতে পারেনি। এ কারণে ঘুরেফিরে তারা বারবার অপকর্ম করে, বারবার গ্রেফতার হয়। তবে আগের চেয়ে তাদের তৎপরতা এবং যোগাযোগের ধরন পাল্টে সবচেয়ে বেশি ‘অনলাইন’ মাধ্যমে সক্রিয় থাকছে। এই অনলাইন মাধ্যমে আবার জাল টাকা নিয়েই প্রতারণামূলক কর্মকা-ও চলছে। তবে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ, ‘অনলাইন-অফলাইনে’ সমান হারে নজরদারি করে যাচ্ছে। 

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ফেসবুক-ম্যাসেঞ্জারের মাধ্যমে জাল টাকার কারবার বা নকল নোটের ব্যবসা নিয়েও প্রতারণা শুরু হয়েছে। যেন ‘চোরের ওপর বাটপারি’র মতো অবস্থা। গত ৪ মে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকা থেকে সিফাত শেখ নামের এমনই এক প্রতারককে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের লালবাগ বিভাগ। এই সিফাত ‘জাল টাকা (বিক্রি করি)’ নামে ফেসবুকে পেজ খুলেও অভিনব প্রতারণা করে যাচ্ছিল। এই প্রতারক চক্র ১ হাজার টাকার ১০০টি জাল নোটের জন্য ১০ হাজার টাকা, ৫০০ টাকার জাল ১০০টি নোটের জন্য ১২ হাজার টাকা, ১০০ ও ২০০ টাকার ১ লাখ জাল নোটের জন্য ২০ হাজার টাকা নিয়ে থাকে। এই টাকা বিকাশ/রকেট/ নগদের মাধ্যমে নেওয়ার পর তারা যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। 

তবে সিফাত প্রতারণা করলেও জাল টাকার ব্যবসায়ীরাও প্রায় একই হারে টাকা নিয়ে নকল নোট সরবরাহ করে থাকে বলে জানা যায়। এর আগে গত ২৪ এপ্রিল রাজধানীর খিলগাঁও থেকে জাল টাকা তৈরির পর ফেসবুক গ্রুপের মাধ্যমে বিক্রির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে দুজনকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। তার আগে গত ২৩ মার্চ বাগেরহাট জেলা শহরে একটি আবাসিক হোটেল থেকে জাল টাকা তৈরির একটি চক্রের প্রধান মোশারেফ হোসেন মৃধাকে (৪২) গ্রেফতার করে জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।

জাল নোট-সংক্রান্ত আইন প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মোহাম্মদ গাফফার হোসেন ইমন রোববার মোবাইল ফোনে সময়ের আলোকে বলেন, জাল নোট প্রতিরোধের সুনির্দিষ্ট কোনো আইন এখনও নেই। বর্তমানে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিশেষ ক্ষমতা আইন-১৯৭৪-এর ২৫ (ক) ধারা অনুযায়ী এ সংক্রান্ত অপরাধের মামলা ও বিচার হয়। একই অপরাধে বারবার গ্রেফতার করা হলেও তাতে শাস্তি বাড়ানোর ধারা নেই এই বিধিগুলোতে। এর ফলে বারবার গ্রেফতার হলেও সহজেই জামিনে মুক্তি বা স্বল্প সাজার ঘটনা ঘটছে।

সরকারি ওয়েবসাইট থেকে পাওয়া ‘প্রস্তাবিত জাল মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ আইন ২০২১’ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, প্রস্তাবিত জাল নোট প্রতিরোধ আইনের খসড়া পর্যায়ে কাজ চলছে। প্রস্তাবিত আইনে জাল টাকার যেকোনো মূল্যমানের নোটের পরিমাণ এবং প্রথমবার, দ্বিতীয়বার বা আরও একাধিকবার একই অপরাধে গ্রেফতার হলে সাজা ও জরিমানার পরিমাণও সে হারে বাড়তে থাকবে।