মির্জা গলিব (Mirza Galib)
এক,
যে সমস্ত বৈপ্লবিক ঘটনার মধ্য দিয়ে কোন সমাজ বা জাতির ঐতিহাসিক পরিবর্তন হয়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেইগুলো অনেক জটিল হয়, এর নানা ডাইমেনশান থাকে। সমাজে এবং একাডেমিয়াতে ভিন্ন ভিন্ন মানুষ ভিন্ন ভিন্ন দিক থেকে এই ঘটনাগুলোকে দেখে, বিশ্লেষণ করে, আলাপ আলোচনা করে। এর মধ্য দিয়েই সমাজের কালেক্টিভ আন্ডারস্ট্যান্ডিং আগায়ে যায়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধও এইরকম একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। তাই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, বয়ান নিয়া এই আলোচনা সমাজে থাকবেই। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের কোন একটি স্পেসিফিক ব্যাখ্যাকে একমাত্র ব্যাখ্যা ধরে নিয়ে এর কোন সমালোচনাই করা যাবে না - এই অবস্থান কোন সুস্থ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া না।
দুই,
ছাত্রশিবিরের প্রকাশিত মাসিক ছাত্রসংবাদের ডিসেম্বর সংখ্যার একটি লেখায় একজন লেখক মুক্তিযুদ্ধকে পুরোপুরি ইসলাম বিরোধী একটি প্রজেক্ট হিসেবে দেখিয়েছেন। তিনি লিখেছেন "সে সময় অনেক মুসলিম না বুঝে মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল। এটা তাদের ব্যর্থতা ও অদুরদর্শিতা ছিল। আল্লাহ্ তাদের ক্ষমা করেন।" এইটা লেখকের নিজস্ব বক্তব্য। প্রশ্ন হইল ছাত্র সংবাদ কি সব সময় মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এই একই ধারার লেখা ছাপায়? নাকি জামায়াত-শিবির ঘরানার মধ্যে যে ভিন্ন ভিন্ন মতামত আছে তার সব গুলোই ছাপায়? ২০২৩ সালে ছাত্রসংবাদে প্রকাশিত এক লেখায় আমি দেখলাম আরেকজন লেখক লিখেছেন "এরপর ১৯৬৬ সালের ছাত্র আন্দোলন, ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানের পর ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের চূড়ান্ত ফলাফল হিসেবে শুরু হয়েছিল বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ। শত বছরের ইতিহাসে বাংলাদেশের গণমানুষ সবচেয়ে বীরত্বপূর্ণ ও গৌরবময় অধ্যায় রচনা করেছে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে। ... ১৯৭১ সালের এ যুদ্ধ ছিল এক অসম যুদ্ধ, ভোটযুদ্ধে জয়ী শান্তিকামী নিরস্ত্র বাঙালির ওপরে যুদ্ধবাজ পাকিস্তানি সামরিক শাসকের চাপিয়ে দেওয়া একতরফা যুদ্ধ।" (লিংক কমেন্টে) কাজেই, একটা লেখাকে লেখকের নিজস্ব মতামতের বাইরে ছাত্র সংবাদের মতামত হিসেবে দেখার কি সুযোগ আছে? এইটা দুইটা মতের কোনটা শিবিরের মতামত, সেই প্রশ্নের সুরাহা তো এখান থেকে করা সম্ভব না।
তিন,
জামায়াত-শিবিরের লোকজনের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মতামত আছে। মুক্তিযুদ্ধকে আগাগোড়া একটা ভারতীয় স্পন্সরড ও ইসলাম বিরোধী প্রজেক্ট হিসেবে দেখার লোকজনও আছে। আবার মুক্তিযুদ্ধকে ভুট্টো আর ইয়াহিয়ার শোষণের বিপরীতে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংগালির মুক্তির যুদ্ধ হিসেবেও দেখার লোকজন আছে। আমি আমার রিসেন্ট বাংলাদেশ সফরের সময় একটা বক্তব্যে বলেছিলাম "১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ গনমানুষের যুদ্ধ ছিল"। যারা মুক্তিযুদ্ধকে একটা ভারতীয় স্পন্সরড ও ইসলাম বিরোধী প্রজেক্ট হিসেবে দেখেন তাদের অনেকে আমার এই বক্তব্যের সমালোচনা করেছেন। জামায়াত এবং শিবিরের স্পেইসে এই আলোচনা - সমালোচনাগুলো হওয়া উচিত। খোলামেলা আলোচনা বাদে এই বিষয়ে আমরা আমাদের স্ট্যান্ড ক্লিয়ার করতে পারব না।
চার,
আমার ব্যক্তিগত অবস্থান হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধের পরে আওয়ামীলীগের প্রযোজনায় এই দেশে একটা ইসলামোফোবিক, রেইসিস্ট, এবং ফ্যাসিট সিস্টেম তৈরি হইছিল। এর কারণ হইল মুক্তিযুদ্ধের যারা নেতৃত্ব দিয়েছিল, তাদের মধ্যে ইসলামোফোবিক লোকজন প্রভাবশালী ছিল। কিন্তু এই দেশের যে সকল গনমানুষ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল, তারা ১৯৭০ সালের নির্বাচনের ফলাফল নিয়া পশ্চিম পাকিস্তানি এস্টাবলিশমেন্টের অগণতান্ত্রিক আচরণ ও জুলুমের বিপক্ষে নিজের অধিকার আদায়ের জন্য মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী এই গনমানুষের যে চেতনা, যে মোটিভেশান ছিল, সেইটা ন্যায়ের পক্ষে, মজলুমের পক্ষে। আগামী দিনে আমাদের বাংলাদেশপন্থী যে রাজনীতি, সেই রাজনীতির এই ন্যায়বোধ ধারণ করেই আগানো উচিত।
পাঁচ,
ইন্টারেস্টিংলি দেখবেন, যে সকল মানুষ সারা সময় মত প্রকাশের স্বাধীনতার কথা বলে, তাদের একটা বিশাল অংশ মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ আসলে কোন ভিন্নমতই সহ্য করতে পারে না। এইসব সুশীলদের চেহারা আয়নায় ফ্যাসিস্টদের মতই দেখায়।