
দেশে বর্তমানে ২৩২ টিভি চ্যানেলের অনুমোদন রয়েছে। তথ্য মন্ত্রণালয় অনুমোদিত এসব টিভি চ্যানেলের মধ্যে দেশীয় ফ্রি চ্যানেল ৩৯টি। অবশিষ্ট ১৯৩টি চ্যানেলের মধ্যে ভারতের টিভি চ্যানেলের সংখ্যা দেড় শতাধিক। এর মধ্যে বেক্সিমকো গ্রুপের তত্ত্বাবধানে ডিটিএইচ ‘আকাশ’ (ডাইরেক্ট টু হোম)-এর মাধ্যমে ১৩০টির বেশি চ্যানেল চলমান। দেশে ভারতীয় টিভি চ্যানেলের এ জয়জয়কারে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন সাংস্কৃতিক ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বরা।
অ্যাসোসিয়েশন অব টেলিভিশন চ্যানেল ওনার্স (অ্যাটকো)-এর নেতারা বলেছেন, সরকারের সিদ্ধান্তহীনতা ও কঠোর নজরদারির অভাবে দেশকে ‘আকাশ অপসংস্কৃতি’ গ্রাস করেছে। ক্যাবল অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (কোয়াব) নেতারা বলেছেন, দেশে তিন কোটি টেলিভিশন গ্রাহক থাকলেও সরকারের সুষ্ঠু মনিটরিং ও সুনির্দিষ্ট নীতিমালার অভাবে দেশ শতকোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
তথ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, দেশে দুই ধরনের লাইসেন্স নিয়ে বিদেশি চ্যানেল চলছে। এর মধ্যে বেক্সিমকোর ‘আকাশ’-এর মাধ্যমে সম্প্রচারের জন্য ১২১টি চ্যানেলের লাইসেন্স তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়ার তথ্য মন্ত্রণালয়ে সংরক্ষিত আছে। তবে এখন কয়টি চ্যানেল এ প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে চলছে, তার কোনো পরিসংখ্যান মন্ত্রণালয়ের কাছে নেই।
ভারতীয় টিভি চ্যানেলের মা-বাপ বেক্সিমকো
তথ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন বেক্সিমকো গ্রুপই দেশে চলমান বিদেশি চ্যানেলগুলোর ‘মা-বাপ’। প্রতিষ্ঠানটির মালিকানায় ডিটিএইচ (আকাশ)-এর মাধ্যমে ১২১টি চ্যানেল ছাড়াও বেক্সিমকো ডিজিটাল ডিস্ট্রিবিউশন লিমিটেডের আওতায় আরো আটটি ভারতীয় চ্যানেল রয়েছে। বেক্সিমকো জানিয়েছে, তাদের আকাশ প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে বর্তমানে ১৩০টির বেশি চ্যানেল চালু রয়েছে।
সূত্র জানিয়েছে, বেক্সিমকো ডিজিটাল ডিস্ট্রিবিউশন লিমিটেডের আওতায় ভারতীয় টিভি চ্যানেলগুলোর মধ্যে স্টার ইন্ডিয়া প্রাইভেট লিমিটেডের স্টার প্লাস, স্টার ভারত, স্টার গোল্ড, ন্যাশনাল জিওগ্রাফি, এনজি ওয়াইল্ড, ফক্স লাইফ, স্টার জলসা ও জসলা মুভিস রয়েছে। আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত তাদের লাইসেন্স নবায়ন করা হয়েছে। তবে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ আপাতত বাংলাদেশে এগুলোর সম্প্রচার স্থগিত রেখেছে।
তথ্য মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, অঙ্গপ্রতিষ্ঠান বেক্সিমকো ডিজিটাল ডিস্ট্রিবিউশন লিমিটেড বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেডের (বিএসসিএল) সঙ্গে বাংলাদেশ (সাবেক বঙ্গবন্ধু) স্যাটেলাইট-১ ব্যবহার করে ভারতীয় এসব টিভি চ্যানেল সম্প্রচার করে আসছে।
ইন্ডিয়া কাস্ট মিডিয়া ডিস্ট্রিবিউশন প্রাইভেট লিমিটেডের তত্ত্বাবধানে চালু রয়েছে ভারতের ৯টি টিভি চ্যানেল। এশিয়া টুডে সিঙ্গাপুর প্রাইভেট লিমিটেডের তত্ত্বাবধানে রয়েছে জি গ্রুপের ৯টি টিভি চ্যানেল। সনি পিকচার নেটওয়ার্কস ইন্ডিয়া প্রাইভেট লিমিটেডের আওতায় রয়েছে সনি এন্টারটেইনমেন্টের ১৪টি টিভি চ্যানেল।
বেক্সিমকোর মাধ্যমে সম্প্রচারে থাকা বিদেশি চ্যানেলগুলোর বিষয়ে তথ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মাহবুবা ফারজানা আমার দেশকে বলেন, বেক্সিমকো নির্দিষ্ট ফি দিয়ে লাইসেন্স নবায়নের আবেদন করেছে। তথ্য মন্ত্রণালয় এখনো এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত দেয়নি। বিষয়টি পর্যালোচনার পর্যায়ে রয়েছে।
তবে মন্ত্রণালয়ের অপর একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আমার দেশকে জানিয়েছেন, বেক্সিমকোর মালিকরা এখন পলাতক। তাদের পক্ষ থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ জামানত দেওয়াসহ লাইসেন্স নবায়নের আবেদন করা হয়েছে। বিষয়টি এখনো নিষ্পত্তি হয়নি। সরকার এ বিষয়ে উভয় সংকটে রয়েছে। কারণ, আকাশ প্ল্যাটফর্ম বন্ধ করলে অনেক টিভি চ্যানেল বন্ধ হয়ে যাবে। বিকল্প কী পদ্ধতি নেওয়া যায়, মন্ত্রণালয় এখন সে বিষয়ে ভাবছে।
অনুমোদন ছাড়াও চলছে বিদেশি চ্যানেল
সালমান এফ রহমানের ডিটিএইচ প্ল্যাটফর্মের (আকাশ) মাধ্যমে বেক্সিমকো ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির আওতায় ১২১টি বিদেশি টিভি চ্যানেলের মধ্যে রয়েছেÑস্টার জলসা এইচডি, জি বাংলা, স্টার প্লাস, সনি, সনি এইচডি, জি ক্যাফে, বিবিসি নিউজ, সিএনএন, স্কাই নিউজ, স্টার গোল্ড, জি অ্যাকশন, সিনেপ্লেক্স, স্টার গোল্ড, স্টার স্পোর্টস, স্টার স্পোর্টস সিলেক্ট, সনি স্পোর্টস টেন, এমটিভি ইনডিয়া, এমটিভি বিটস, সংগীত বাংলা, মিউজিক ইন্ডিয়া, ন্যাশনাল জিওগ্রাফি, ডিসকভারি সায়েন্স, ডিসকভারি টারবো, অ্যানিমেল প্লানেট, ফুড এক্সপি, এনডিটিভি গুড টাইমস, ফক্স লাইফ, সনিক, জি ক্লাসিক, জি নিউজ, জি বিজনেস, জি স্মাইল, বিগ ম্যাজিক, লাইফ ওকে, ফক্স ট্রাভেলার, তারা টিভি, কিউটিভি, পিটিভি ওয়ার্ল্ড, ডিডি বাংলা, ডিডি ন্যাশনাল, সিনেমাকি ড্রামা, সিনেমাকি রোমান্স, হেলথ অ্যান্ড ওয়েলনেস প্রভৃতি।
কোয়াব সূত্র জানিয়েছে, এগুলোর মধ্যে বেক্সিমকো গ্রুপ ডিজনি, ডিজনি এক্সডি, ডিজনি জেআর, ডিজনি ইন্টারন্যাশনাল, টিএলসি, ফুড এক্সপি, অ্যানিমেল প্লানেট, ডিসকভারি, ডিসকভারি সায়েন্স ও ডিসকভারি টারবোসহ বেশকিছু বিদেশি চ্যানেলের অনুমোদন ছাড়াই সম্প্রচার করছে।
মিডিয়া কেয়ার লিমিটেডের আওতায় ৩৫ বিদেশি চ্যানেল
তথ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, ‘মিডিয়া কেয়ার লিমিটেড’-এর তত্ত্বাবধানে রয়েছে ৩৫টি বিদেশি টিভি চ্যানেল। এর মধ্যে এশিয়া টুডে সিঙ্গাপুর প্রাইভেট লিমিটেডের ৯টি চ্যানেলের মধ্যে রয়েছেÑজি টিভি অ্যাপেক, জি সিনেমা, জি বাংলা ইন্টারন্যাশনাল, জি অ্যাকশন, জি বলিউড, পিকচার্স টিভি, ডব্লিআইওএন টিভি এবং জি বাংলা সিনেমা।
মিডিয়া কেয়ার লিমিটেডের সনি পিকচার্স নেটওয়ার্ক ও ইন্ডিয়া প্রাইভেট লিমিটেডের অধীন ১৪টি বিদেশি টিভি চ্যানেলের মধ্যে রয়েছেÑসনি এন্টারটেইনমেন্ট টেলিভিশন, সনি এসডি অ্যান্ড এইচডি, সনি বিবিসি আর্থ এসডি অ্যান্ড এইচডি, সনি পিএএল এসডি, সনি ওয়াইএওয়াইএসডি, সনি ম্যাক্স ২ এসডি, সনি ডব্লিউএএইচএসডি, সনি এএটিএইচ, সনি ম্যাক্স এসডি, সনি পিক্স, সনি টেন ১, সনি টেন ২, সনি টেন ৩, সনি সিক্স।
মিডিয়া কেয়ার লিমিটেডের ডিসকভারি নেটওয়ার্ক এশিয়া প্যাসিফিক প্রাইভেট লিমিটেডের আটটি টিভি চ্যানেলের মধ্যে রয়েছেÑডিসকভারি এসডি, অ্যানিমেল প্লানেট এসডি, টিএলসি এসডি, ইউরো স্পোর্টস এসডি, ইনভেস্টিগেশন ডিসকভারি এসডি, টারবো এসডি, সায়েন্স এসডি ও কাইডস এসডি।
ভালো নেই অনুমোদিত বিদেশি চ্যানেলগুলো
তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে বিদেশি পে-চ্যানেলের আওতায় ‘ওয়ান অ্যালান্স লিমিটেড’ নামে ডিস্ট্রিবিউটশন কোম্পানির অধীন ইন্ডিয়া কাস্ট মিডিয়া ডিস্ট্রিবিউশন প্রাইভেট লিমিটেডের ৯টি চ্যানেলের মধ্যে রয়েছেÑকালারস টিভি, এমটিভি ইন্ডিয়া, নাইক টিভি, সনিক নাইকেলোডিয়ান, কালারস বাংলা টিভি, কমেডি সেন্ট্রাল, এইট টিভি, হিস্ট্রি টিভি ও নাইক জেআর টিভি।
এছাড়া প্রি টু এয়ারের আওতায় তথ্য মন্ত্রণালয়ে তালিকাভুক্ত আছে আরো ১০টি বিদেশি টিভি চ্যানেল। এর মধ্যে রয়েছেÑজিং, হাম মাসালা, আস সুন্নাহ, সাউদিয়া-১, সাউদিয়া-২, সিটিভিএন একেডি, ধুম মিউজিক, রাশিয়া টুডে এবং এআরআই ডিজিটাল।
কোয়াবের আওতাভুক্ত ১৫টি বিদেশি চ্যানেল হলোÑআলজাজিরা, কিউটিভি, পিটিভি ওয়ার্ল্ড, জিও টিভি, ভয়েস অব আমেরিকা (ভোয়া), ডিডব্লিউ, অ্যারিরেঙ্গ, এনএইচকে ওয়ার্ল্ড, ডিডি ন্যাশনাল, ডিডি বাংলা, ডিডি স্পোর্টস, জি স্মাইল, জি মিউজিক, টিভিএস মনডে ও জুম টিভি।
ব্রডকাস্ট ওয়ার্ল্ডওয়াইডের অধীন চলছে দুটি টিভি চ্যানেল। এগুলো হলো তারা নিউজ ও তারা টিভি। অস্ট্রেলিয়ান অ্যাম্বাসির আওতায় চলছে অস্ট্রেলিয়া নেটওয়ার্ক ও অস্ট্রেলিয়া ক্যাবল। ইরান অ্যাম্বাসির আওতায় জম ই জম-৩ চ্যানেল চলছে।
চায়না অ্যাম্বাসির তত্ত্ববধানে চলছে চারটি চ্যানেল। এগুলো হলোÑএন্টারটেইনমেন্ট, সিসিটিভি-৯ ইংলিশ, সিসিটিভি-৪ চাইনিজ এবং ফনিক্স চাইনিজ টিভি।
তথ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিয়ে চললেও ভালো নেই এসব চ্যানেলের প্রোভাইডাররা। সরকারের সুষ্ঠু তদারক, ব্যবস্থাপনা ও নীতির অভাবে এ খাতে বর্তমানে বিভীষিকাময় অবস্থা বিরাজ করছে।
কোয়াবের সাংগঠনিক সম্পাদক মাহমুদুল মামুন আমার দেশকে বলেন, আমরা চাই বিদেশি চ্যানেলগুলো একটি সুষ্ঠু নীতিমালার আওতায় আসুক। আমরাও সরকারকে শতভাগ সহযোগিতা করতে প্রস্তুত। বর্তমানে এ খাত নিয়ে কেউ ভাবছে বলে মনে হচ্ছে না।
তথ্য বলছে, দেশে টিভি গ্রাহকের সংখ্যা তিন কোটির বেশি। টিভি অনুষ্ঠানমালার প্রতি মানুষের আগ্রহের কমতি নেই। এ খাতে সরকারকে আরো যত্মশীল হওয়ারও আহ্বান জানিয়েছেন ক্যাবল অপারেটরদের নেতা মাহমুদুল। ক্যাবল টিভির সঙ্গে প্রায় ১০ লাখ মানুষের ভাগ্য জড়িত দাবি করে তিনি বলেন, ‘খাতটি বিপর্যয়ের মধ্যে পড়লে ১০ লাখ পরিবার ক্ষতির মুখে পড়বে।’
নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না তথ্য মন্ত্রণালয়
তথ্য মন্ত্রণালয়ের টিভি শাখার এক কর্মকর্তা আমার দেশকে বলেন, দেশে যেসব বিদেশি চ্যানেল আছে, আইন অনুযায়ী তারা ক্লিন ফিড (বিজ্ঞাপন ছাড়া) চালাতে বাধ্য। কিন্তু তাগাদা দেওয়া সত্ত্বেও এসব চ্যানেল ক্লিন ফিড করে পাঠাচ্ছে না। আইন অনুযায়ী ক্লিন ফিড ছাড়া বিদেশি চ্যানেল আমাদের এখানে সম্প্রচার করতে পারে না। এছাড়া ক্যাবল অপারেটররা অনেক সময় সিনেমা দেখায়, বিজ্ঞাপন দেখায়, অনুষ্ঠান দেখায়। এগুলো আইনের ব্যত্যয়।
তথ্য মন্ত্রণালয়ের সীমাবদ্ধতার কথা উল্লেখ করে অপর এক কর্মকর্তা জানান, যারা ইন্টারনেট সংযোগ দিচ্ছে ও সেসব সার্ভিস প্রোভাইডার ইন্টারনেটের মাধ্যমে ভিডিও স্ট্রিমিং করে টেলিভিশনে দেখাচ্ছে, তারাও স্পষ্টভাবে আইন লঙ্ঘন করছে। তিনি বলেন, ভিডিও স্ট্রিমিংয়ের মাধ্যমে আইপি টিভি দেখানো হচ্ছে বলে আমরা অসংখ্য অভিযোগ পাচ্ছি। একজনের ডোমেইনের মধ্যে আরেকজন প্রবেশ করছে। এসব বিষয় তথ্য মন্ত্রণালয়ের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণে নেই। এর সঙ্গে টেলিকম বিভাগ ও আইসিটি বিভাগও যুক্ত। সব বিভাগের সঙ্গে সমন্বয় না হওয়ায় এসব বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না বলেও জানান তিনি।
কোয়াবের সভাপতি এবিএম সাইফুল হোসেন সোহেল আমার দেশকে বলেন, দেশে বেক্সিমকোর অধীনেই বেশিরভাগ বিদেশি টিভি চ্যানেল চলছে আর ক্যাবলের মাধ্যমে আমরা দেশি-বিদেশি ১০০টির মতো চ্যানেল সম্প্রচার করে আসছি। এর মধ্যে বিবিসি, সিএনএন ও আলজাজিরার মতো চ্যানেলও রয়েছে। তবে বর্তমানে খাতটি নাজুক পরিস্থিতিতে রয়েছে বলে জানান ক্যাবল অপারেটরদের এই নেতা।
ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশীয় টিভি চ্যানেল
সিনিয়র সাংবাদিক ও গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রধান কামাল আহমেদ আমার দেশকে বলেন, ‘আমরা গণমাধ্যমের সংস্কার নিয়ে খুব অল্প সময় কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। আমরা সংস্কারের পর্যালোচনায় যেসব বিষয় এনেছি, তার মধ্যে বিদেশি গণমাধ্যম ছিল না। এটি অনেক বড় একটি বিষয়। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, বাংলাদেশে যেসব বিদেশি গণমাধ্যম বা টিভি চ্যানেল চলছে, তার জন্য একটি নীতিমালা থাকা খুবই জরুরি। প্রায় দুই দশক ধরে আমরা এটা শুনে আসছি এবং বিভিন্ন পর্যায় থেকে দাবিও আছে। একটি স্বচ্ছ নীতিমালা তৈরির বিষয়ে কিন্তু বর্তমান সরকারের সময়ও এটি হয়নি।’
বাংলাদেশে ভারতীয় টিভি চ্যানেলের অবাধ সম্প্রচার উদ্বেগের কারণ উল্লেখ করে এ সিনিয়র সাংবাদিক বলেন, ‘ব্যক্তিগতভাবে আমি অবাধ তথ্যপ্রবাহে বিশ্বাসী। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছেÑযেভাবে আমাদের দেশে ভারতীয় টিভি চ্যানেলগুলো অবাধে সম্প্রচারের সুযোগ পাচ্ছে, আমরা কি তার ছিটেফোঁটাও পাচ্ছি? না, আমরা সেটা পাচ্ছি না। কারণ, ভারতকে আমরা যতটুকু সুবিধা দিচ্ছি, তাদের কাছ থেকে ততটুকু আদায় করে নিতে পারছি না। আমরাই সব দেব, বিনিময়ে কিছুই পাব নাÑএটা হতে পারে না।’
কামাল আহমেদ আরো বলেন, ‘আমাদের দেশের টিভি চ্যানেলগুলোর মালিকদের তীব্র আন্দোলনে ক্লিন ফিড ভারতীয় টিভি চ্যানেল সম্প্রচারের ব্যবস্থা নেওয়া হলেও এখন সেটাও কার্যকর নেই বলে শুনেছি। এক্ষেত্রে আমাদের ব্যর্থতা রয়েছে।’
ভারতীয় চ্যানেলের একচ্ছত্র সম্প্রচারে ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে
দেশে ভারতীয় টিভি চ্যানেলের একচ্ছত্র সম্প্রচারে ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে বলে মনে করছেন বাংলাদেশের টেলিভিশন মালিকদের সংগঠন অ্যাটকোর সাবেক সভাপতি ও এনটিভির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মোসাদ্দেক আলী। আমার দেশকে তিনি বলেন, ‘আমাদের সামাজিক রীতিনীতি ও সাংকৃতিক ঐতিহ্যের নিজস্বতা আছে। বিশ্বে সমাদৃত এ রীতিনীতির ওপর বিদেশি আকাশ সংস্কৃতির নেতিবাচক প্রভাব বর্তমানে প্রকট আকার ধারণ করেছে। বিদেশি বিনোদন, পোশাক, খাদ্যাভ্যাস এমনকি ভাষার ব্যবহারেও আকাশ সংস্কৃতির প্রভাব বেড়েই চলেছে। মাতৃভাষা বিকৃত হচ্ছে, অন্য ভাষার প্রভাব বাড়ছে। যদি তা ইতিবাচক হতো, তবে সমস্যা ছিল না। যা দেখছি, তার বেশিরভাগই নেতিবাচক।’
অ্যাটকোর সাবেক সভাপতি আরো বলেন, আকাশ সংস্কৃতির প্রভাবে ঘরে ঘরে ভিনদেশীয় উৎসবের বাড়াবাড়ি আমাদের জাতীয় সংস্কৃতি ও মূল্যবোধকে দুর্বল করে দিচ্ছে। প্রতিটি ক্ষেত্রে নিজস্ব রুচিবোধ পাল্টে গিয়ে সেখানে যা হচ্ছে, তাতে সামাজিকভাবে ব্যক্তিত্বে দুর্বোধ্যতা তৈরি হচ্ছে; দেখা দিচ্ছে দুর্বলতা। ফলে মানুষ হৃদ্যতা ভুলে যাচ্ছে।
অ্যাটকোর সাবেক সভাপতি ভারতীয় টিভি চ্যানেলের প্রাধান্যকে ‘আকাশ অপসংস্কৃতি’ নামে অভিহিত করে বলেন, এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য দরকার সম্মিলিত প্রয়াস। পরিবার থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কর্মস্থল থেকে শুরু করে রাজনৈতিক মাঠÑসবখানে আমাদের কথা বলায়, চলায়, পোশাকে, খাবারে, আচরণে সচেতন থাকতে হবে। নিয়মিত সাংস্কৃতিক চর্চা করতে হবে। এজন্য এখনই আমাদের শিকড়ের দিকে ফিরে তাকানো দরকার বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
যা বলছে আকাশ ডিজিটাল ও বিটিভি
ভারতসহ বিদেশি চ্যানলেগুলো বাংলাদেশে এখন কীভাবে ও কোন পদ্ধতিতে চলছেÑএ বিষয়ে বেক্সিমকো নিয়ন্ত্রণাধীন আকাশ ডিজিটালের পক্ষ থেকে লিখিতভাবে বলা হয়েছে, ‘আকাশ ডিজিটাল টিভি বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় কর্তৃক লাইসেন্সপ্রাপ্ত একটি পে-টিভি অপারেটর। ডিরেক্ট টু হোম (ডিটিএইচ) প্রতিষ্ঠানটি সারা দেশে ১০ লাখের বেশি পরিবার, ৫০ লাখের বেশি দর্শককে সেরা মানের ছবি ও শব্দসংবলিত ১৩০টির বেশি দেশি-বিদেশি চ্যানেল প্রদর্শনের মাধ্যমে অনন্য সেবা দিয়ে যাচ্ছে।’
গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব ও বাংলাদেশ টেলিভিশনের মহাপরিচালক মো. মাহবুবুল আলমের কাছে দেশে ভারতীয় চ্যানেলের আধিপত্য ও সে দেশে বিটিভির সম্প্রচারের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বিদেশি চ্যানেলের সম্প্রচারের বিষয়টি দেখভালের জন্য পৃথক অথরিটি রয়েছে। ভারতে বিটিভির সম্প্রচারের বিষয়টি আমাকে জেনে জানাতে হবে।’