
বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে ভুয়া তথ্য ছড়ানোর প্রবণতা। তবে এবারে ছবির জায়গা দখল করে নিচ্ছে ভিডিও—তাও আবার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় (এআই) তৈরি ভিডিও। চলতি বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে ভুয়া তথ্য ছড়ানোর হার বেড়েছে ১৭ শতাংশ, যেখানে রাজনৈতিক বিষয়ক গুজবই সর্বাধিক—৪৪ শতাংশ।
নির্বাচন কমিশনও নির্বাচনে এআই-এর অপব্যবহারকে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছে। গুগলের নতুন ভিডিও টুল ভিও থ্রি ব্যবহার করে তৈরি ভিডিওগুলো এখন কেবল গুজব নয়, সরাসরি নির্বাচনী প্রচারেও ব্যবহৃত হচ্ছে।
ডিপফেইক ও ভুয়া সাক্ষাৎকারে ছড়ানো হচ্ছে বিভ্রান্তি
গবেষণা সংস্থা ডিসমিসল্যাব জানায়, তারা এপ্রিল-জুন সময়ে ৮টি ফ্যাক্টচেক সংস্থার ১ হাজার ৩৬১ টি যাচাইকৃত প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করেছে। এ থেকে ১ হাজার ১৩টি স্বতন্ত্র ভুয়া তথ্য চিহ্নিত হয়েছে। এর মধ্যে অনেকগুলোই ছিল ভুয়া ভিডিও—যেখানে রাজনৈতিক নেতা, এমনকি বিদেশি রাষ্ট্রপতিদের মুখ ব্যবহার করে ভুয়া বক্তব্য তৈরি করা হয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ, একটি ভিডিওতে দেখানো হয়েছে নির্বাচন না হলে বিএনপি আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট গঠন করে আন্দোলনে যাবে—যা সালাহউদ্দিন আহমেদের নামে মিথ্যা প্রচার। আরেকটি ভুয়া ভিডিওতে দাবি করা হয়, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বিএনপিকে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে বলেছেন।
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নামেও ছড়ানো হয়েছে একাধিক ভুয়া দাবি—যেমন, তিনি নাকি নির্বাচন তারিখ ঘোষণা করে দিয়েছেন বা পদত্যাগ করেছেন। এমনকি একটি ভুয়া ভিডিওতে তাঁকে প্রশংসা করছেন ট্রাম্প, এমন দৃশ্যও বানানো হয়েছে।
ভুয়া তথ্যের ছড়াছড়ি
২০২৫ সালের প্রথম প্রান্তিকে যেখানে আন্তর্জাতিক বিষয়ে ভুয়া তথ্যের হার ছিল মাত্র ১ শতাংশ, দ্বিতীয় প্রান্তিকে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৯ শতাংশে।
কাশ্মীরের পাহেলগামে সন্ত্রাসী হামলা এবং ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধকে ঘিরে ব্যাপকভাবে ছড়িয়েছে ভুয়া ভিডিও ও ছবি। যেমন, পুরনো ভিডিও ব্যবহার করে দাবি করা হয় ভারত পাকিস্তানের সামরিক ঘাঁটিতে হামলা করেছে বা পাকিস্তান পাল্টা আঘাতে ভারতকে ধ্বংস করেছে।
ইরান-ইসরায়েল সংঘর্ষের সময় ছড়ানো হয় একাধিক ভুয়া ভিডিও, যাতে দেখা যায় ইরান নাকি তেল আবিব ধ্বংস করেছে বা মোসাদের সদর দপ্তরে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে। এমনকি এক ভিডিওতে দেখানো হয়, ইসরায়েলি সৈনিক ও সাধারণ নাগরিকরা ইরানের কাছে যুদ্ধ বন্ধের আবেদন জানাচ্ছে।
নারী রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে অশ্লীল গুজব
নতুন গঠিত ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টির (এনসিপি) নারী নেত্রীদের বিরুদ্ধে চরিত্র হননের উদ্দেশ্যে ছড়ানো হয়েছে বিকৃত ভিডিও ও ছবি। কোটাবিরোধী আন্দোলনের নেত্রী নাফসিন মেহনাজ ও এনসিপি নেত্রী অর্পিতা শ্যামা দেবের নামে ছড়ানো হয়েছে ভুয়া অশ্লীল ভিডিও—যেগুলোর কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই।
সংবাদমাধ্যমের নামে বানানো ভুয়া গ্রাফিকস
এআই-এর পাশাপাশি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে ফেক ফটোকার্ড—যা সংবাদমাধ্যমের গ্রাফিকসের মতো করে বানানো হয়। দ্বিতীয় প্রান্তিকে এ ধরনের ১৭৬টি ঘটনা শনাক্ত হয়েছে, যার ৮৫ শতাংশই রাজনৈতিক।
নির্বাচন ঘিরে ভুয়া তথ্য ৮ গুণ বৃদ্ধি
জাতীয় নির্বাচন নিয়ে গুজব বেড়েছে সর্বাধিক। প্রথম প্রান্তিকে যেখানে মাত্র ৭টি নির্বাচনসংক্রান্ত ভুয়া তথ্য পাওয়া গিয়েছিল, দ্বিতীয় প্রান্তিকে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে অন্তত ৫৫ টিতে। বিশেষ করে বিএনপি নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণে সবচেয়ে সোচ্চার হওয়ায়, তাদের নেতারাই গুজবের প্রধান লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছেন।
সতর্কতা জরুরি
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগামি জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে ভোটারদের বিভ্রান্ত করতে এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করে ভুয়া তথ্য ছড়ানোর প্রবণতা আরও বাড়বে। তাই জনগণকে সচেতন থাকা এবং সংবাদ যাচাইয়ের প্রতি মনোযোগী হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তারা।