Image description

ডিজিটাল যুগে আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে স্মার্টফোন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের আপডেট, মেসেজ, ই-মেইল প্রতিটি নোটিফিকেশনের জন্য উন্মুখ হয়ে থাকেন অনেকেই। প্রথমে মনে হয় এটা হয়তো একধরনের স্বাভাবিক অভ্যাস। তবে প্রতিটি নোটিফিকেশনের শব্দ বা ভাইব্রেশন আসলে মনের গভীরে থাকা কিছু অজানা উদ্বেগ বাড়িয়ে তুলতে পারে। দুবাইয়ের মনোবিজ্ঞানী ইনা ব্র্যাডশা এবং তাঁর সহকর্মী অ্যানেলিস কিউর মতে, বারবার ফোন স্ক্রলিং এবং ফোন-সম্পর্কিত উদ্বেগ প্রায়শই গভীর কোনো মানসিক সমস্যাকে ঢেকে রাখে।

মনোবিদ অ্যানেলিস কিউ বলেন, ফোন বারবার চেক করার এই অভ্যাস অনেক সময় ফোমো (ফিয়ার অব মিসিং আউট) বা অন্যদের স্বীকৃতি ও নিশ্চয়তার প্রয়োজনীয়তার সংকেত দেয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই আচরণগুলো নির্দেশ করে যে, এর গভীরে কিছু আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কাজ করছে।

ফোমো

ফোমো বা ফিয়ার অব মিসিং আউট হলো একটি মানসিক অবস্থা, যেখানে কেউ মনে করে যে, তারা যদি কোনো কিছু (খবর বা ঘটনা) মিস করে বা অংশগ্রহণ না করে, তাহলে তারা সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে বা গুরুত্বপূর্ণ কিছু থেকে বঞ্চিত হবে। এটি এমন একটি ভাবনা, যখন কেউ মনে করতে শুরু করে যে, তাঁকে বাদ দিয়ে বাকি সবাই আনন্দ, উল্লাস করছে এবং সুখে আছে। এতে তাদের মানসিক চাপ বা উদ্বেগ তৈরি হয়। এটি সাধারণত সামাজিক মিডিয়া, ইভেন্ট বা যেকোনো ধরনের নতুন আপডেট বা তথ্যের ক্ষেত্রে হয়।

এ ছাড়া, বারবার ফোন চেকের অভ্যাসটি অস্থায়ীভাবে একধরনের শান্তি বা নিয়ন্ত্রণের অনুভূতি দেয়। কারণ প্রতিটি নতুন নোটিফিকেশন অন্যদের কাছ থেকে স্বীকৃতি পাওয়ার মতো। সেটা একটি পোস্টে ‘লাইক’ পাওয়া, নতুন মেসেজ বা কাজসংক্রান্ত কোনো নোটিফিকেশন হোক। এসব আমাদের মনে একধরনের নিশ্চয়তা দেয় যে, আমরা যুক্ত আছি এবং সবকিছু সম্পর্কে অবগত। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই আচরণ একটি চক্রে পরিণত হতে পারে, যা উদ্বেগ আরও বাড়িয়ে তোলে এবং নিরাপদে অনুভব করতে বারবার ফোন চেক করার প্রয়োজন তৈরি হয়। এটি উদ্বেগও বাড়াতে পারে। বারবার ফোন দেখার ফলে অন্য কাজের প্রতি মনোযোগ দেওয়া বা বর্তমান মুহূর্তে উপস্থিত থাকা কঠিন হয়ে পড়ে।

ডুম-সার্চিং

ডুম সার্চিংয়ের বিষয়ে দুবাইয়ের একজন সেলস কর্মী যোয়া হাসান নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, যখন তিনি সম্পর্কের জটিলতায় পড়েছিলেন, তখন তিনি বারবার ইন্টারনেটে এ সম্পর্কে প্রতিবেদন খুঁজতেন এবং পড়তেন। এসব প্রতিবেদনে লেখা থাকত, কীভাবে দম্পতিরা একে অপরকে ভালোবাসা বন্ধ করে দেয় এবং এ বিষয়গুলোর কী লক্ষণ হতে পারে।

যোয়া জানান, তিনি সারা রাত ধরে অসংখ্য ফোরাম পড়তেন এবং অন্যদের কাহিনি পড়ে তার উদ্বেগ আরও বেড়ে যায়।

এই প্রবণতাকে ডুম-সার্চিং বলা হয়, যেখানে আপনি বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে ইন্টারনেটে সবচেয়ে খারাপ ফলাফল বা নেতিবাচক ঘটনা খুঁজে বের করার জন্য বারবার অনুসন্ধান করেন।

মনোবিদ কিউ বলেন, ‘নিরাপত্তা খোঁজার জন্য এটি একটি সহজ উপায় হিসেবে কাজ করে। তবে প্রায়ই তা উদ্বেগ, মানসিক চাপ এবং শারীরিক অস্বস্তি বাড়িয়ে তোলে।’

ফোন হারানো বা চার্জ শেষ হওয়ার সময় আতঙ্ক

ফোন হারিয়ে গেলে বা তার চার্জ শেষ হয়ে গেলে অনেকের মধ্যেই একধরনের অস্থিরতা বা আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। মনোবিদ কিউ বলছেন, সামাজিক যোগাযোগ, কাজ, বিনোদন এবং নিরাপত্তার জন্য ফোন আমাদের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই যখন ডিভাইস হারিয়ে যায় বা চার্জ শেষ হয়, তা উদ্বেগ তৈরি করে।

বিশেষ করে যারা আগে থেকে উদ্বেগের সমস্যায় ভুগছেন, তাদের ক্ষেত্রে এই প্রতিক্রিয়া আরও তীব্র হতে পারে। গুরুত্বপূর্ণ কল, জরুরি ই-মেইল বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ভয়ে চাপ আরও বেড়ে যায়। মানসিক সমস্যার ফলে ফোন ছাড়া থাকলে মানসিক অস্বস্তি এবং উদ্বেগ বোধ করেন অনেকেই। একে ‘নোমোফোবিয়া’ বলা হয়।

তাৎক্ষণিকভাবে মেসেজের উত্তর দেওয়ার প্রবণতা

ব্যস্ততার মধ্যে থাকলেও বন্ধুর মেসেজের উত্তর যত দ্রুত সম্ভব দিতে চান অনেকেই। তাৎক্ষণিকভাবে উত্তর দেওয়ার এই প্রবণতা অনেক সময় গভীর উদ্বেগের ফল। এই বাধ্যবাধকতা অপ্রতিরোধ্য হয়ে এমন একটি চক্র তৈরি করে, যেখানে স্মার্টফোনের ব্যবহার মানসিক সুস্থতার ওপর প্রভাব ফেলে। এই প্রবণতা ফোমো এবং ডিজিটাল যোগাযোগে ওপর নির্ভরতাকে আরও বাড়িয়ে দেয়।

ফোন কল এড়িয়ে চলা

মেসেজের দ্রুত উত্তর দিতে আগ্রহী হলেও অনেকেই ফোন কল এড়িয়ে চলতে চান। কারণ ফোন কলের তুলনায় টেক্সট মেসেজে চিন্তা-ভাবনা করে উত্তর দেওয়ার জন্য অনেক বেশি সময় থাকে। তবে এই অনুভূতি শুধু সেই সব মানুষের জন্য নয়, যাঁরা সামাজিক চাপের সঙ্গে লড়াই করেন বরং তাঁদের জন্যও যাঁরা মানসিক ক্লান্তি বা একধরনের বাহ্যিক চাপ অনুভব করেন। মনোবিদ ব্র্যাডশ বলেন, ফোন কলের চেয়ে টেক্সট মেসেজ অনেক সহজ। কারণ ফোন কলে তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিক্রিয়া দেওয়ার জন্য মানসিক চাপ সৃষ্টি হয়।

ফোন ব্যবহারের এই চক্র থেকে বের হতে নিচের টিপসগুলো অনুসরণ করতে পারেন—

 

সীমা নির্ধারণ করুন: সারা দিনের জন্য ফোন ব্যবহার কমিয়ে দিন। বিশেষ করে রাতে ঘুমানোর আগে।

ফোন-মুক্ত সময় নির্ধারণ করুন, বিশেষত শোয়ার আগে।

অপ্রয়োজনীয় নোটিফিকেশন বন্ধ করুন: বারবার চেক করার প্রবণতা কমাতে এটি খুবই সাহায্যকারী।

সামাজিক মিডিয়ায় সময় সীমিত করুন: অ্যাপ টাইমার ব্যবহার করে সামাজিক যোগাযোগ মিডিয়া ব্যবহারের সময় সীমিত করুন।

স্ক্রলিংয়ের বদলে মনোযোগী কাজ করুন: বই পড়ুন, জার্নাল করুন বা হাঁটতে বেরিয়ে যান।

ডিজিটাল ডিটক্সের মুহূর্ত তৈরি করুন: কিছুদিনের জন্য স্মার্টফোনের ব্যবহার বন্ধ করুন এবং এটি ছেড়ে থাকার অভ্যাস করুন।

নতুন কিছু শিখুন: ফোন চালানোর বদলে নতুন কিছু শিখতে চেষ্টা করুন—যেমন কোনো নতুন ভাষা, রান্নার রেসিপি অথবা নতুন একটি স্কিল, যেমন— ছবি আঁকা বা কোডিং।

 

তথ্যসূত্র: গালফ নিউজ