২০২৩ সালের শুরুর দিকে ব্রাজিলে বড় স্বপ্ন নিয়ে পাড়ি জমান ডিফেন্ডার নাজমুল আকন্দ। ব্রাজিলিয়ানদের সংস্পর্শে নিখাদ ফুটবলার হয়ে দেশে ফিরে মাঠ মাতাবেন- এমনটি ছিল প্রত্যাশা। আপাতত সেই লক্ষ্যে ভাটা পড়েছে। বড় ফুটবলার হওয়ার চেয়ে সেখানে এখন স্থায়ীভাবে থিতু হতেই সব মনোযোগ নাজমুলের! অল্প দিনে ব্রাজিলিয়ান স্ত্রী-সন্তান নিয়ে জীবনের বাঁক বদলে দেওয়ার চেষ্টায় আছেন। ফুটবল তার কাছে এখন অনেকটাই দ্বিতীয় অধ্যায়। তাই অন্য কাজ করে সপ্তাহে একদিন ‘খেপ’ খেলে দিনাতিপাত করছেন রংপুরের পীরগঞ্জ থেকে বেড়ে ওঠা ২৩ বছর বয়সী ফুটবলার।
এই নাজমুল উঠে এসেছেন বয়সভিত্তিক জাতীয় অনূর্ধ্ব-১৭ ফুটবল থেকে। তৎকালীন ক্রীড়া মন্ত্রণালয় চার ফুটবলারকে বাছাই করে ৬ বছর আগে উন্নত প্রশিক্ষণে ব্রাজিলে পাঠিয়েছিল। নাজমুলসহ অন্যরা ব্রাজিলিয়ান ক্লাবে মাসখানেক প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে ফিরে ঘরোয়া ফুটবলে মনোযোগ দেন। ঠিক এরপরই ঢাকার আরামবাগ ক্রীড়া সংঘে কোচিং করানো ব্রাজিলিয়ান ডগলাস সিলভার সান্নিধ্যে আসেন নাজমুল। যার মাধ্যমে আবারও ব্রাজিলে পাড়ি জমান তিনি।
ডগলাসের সাও পাওলোর বাসায় বেশ কিছু দিন থেকে তার নির্দেশনায় স্থানীয় ক্লাবে অনুশীলন করার পর একপর্যায়ে খুঁজে নেন নিজের মতো ঠিকানা। মাঝে বিয়ে ও সন্তান লাভের পর জীবনের বাঁকই বদলে গেছে। বড় ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে ব্রাজিলে যাওয়া নাজমুলের ক্যারিয়ারে পরিবর্তনের ব্যাখ্যা মিলেছে। বাংলা ট্রিবিউনকে শুরুতে ডগলাসের নির্দেশনায় সাও পাওলোর ক্লাবে অনুশীলন ছেড়ে অন্য জায়গায় চলে যাওয়ার কারণ বলতে গিয়ে নাজমুল জানালেন, ‘ডগলাস শুরু থেকে আমাকে অনেক সাহায্য করেছে। তার বাসায় রেখে ক্লাবে অনুশীলন করারও ব্যবস্থা করে দিয়েছে। বেশ কিছুদিন আমি সেখানে ছিলাম। তবে কিছুদিন যাওয়ার পর বুঝলাম অনুশীলন চালিয়ে গেলেও সেখানকার ক্লাবে সুযোগ পাওয়া বেশ কঠিন। এরজন্য অনেক সময় দরকার। এদিকে জীবিকা নির্বাহের জন্য অর্থও প্রয়োজন। এছাড়া ডগলাস চাইছিলেন তার পরিবারের একজন সদস্য হয়ে যাই। যা মানা সম্ভব ছিল না। তাই সব চিন্তা করে অন্য জায়গায় পাড়ি জমাই।’
এরই মাঝে সাও পাওলোর এক রেস্টুরেন্টে দেখা হয়ে যায় নার্স আসমা আকন্দের সঙ্গে। পরিচয় থেকে পরিণয় হতে সময় লাগেনি। ইসলাম ধর্মের রীতিতে ব্রাজিলিয়ান তরুণীর নাম পরিবর্তন করে পরে বিয়েও করেছেন। বর্তমানে এক বছর বয়সী ছেলে হেনরি আকন্দকে নিয়ে সুখেই আছেন। এখন সাও পাওলোতে সপ্তাহে ৬দিন কাজ করেন। মাসে ভালো উপার্জনও করে থাকেন। গ্রামের বাড়িতে বাবা-মাকে সাহায্য করছেন। পাঁকা দালানও উঠেছে। আর সপ্তাহান্তে খেপ খেলে বেড়ান। সেখান থেকে প্রতি ম্যাচে ব্রাজিলিয়ান মুদ্রায় ২০০ থেকে ৭০০ রিয়েল আসে। তা দিয়েই সাও পাওলোর ঘর ভাড়া উঠে আসে। নাজমুল বলছিলেন, ‘এখানে আসমার সঙ্গে পরিচয়ের পর বিয়ে করে ফেলি। আমাদের একটি সন্তানও আছে। আমরা ভালো আছি। দিনে কাজ করি আর সপ্তাহে ছুটির দিনে এখানে খেপ খেলে থাকি। ডিমান্ডও ভালো। ব্রাজিলিয়ানরা আমাকে আপন করে নিয়েছে। বাংলাদেশ সম্পর্কে তাদের অনেক ভালো জানা শোনা। ভালোই আছি বলতে পারেন।’
তাহলে বড় ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন কি ফিকে হয়ে গেলো? নাজমুল উত্তর দিলেন, ‘ঠিক তা নয়। আমি তো দিনে কাজ করার পাশাপাশি রাতে ফুটবল নিয়ে অনুশীলন করে থাকি। সাও পাওলোর একটি তৃতীয় বিভাগের ক্লাবের সঙ্গে কথা চলছে। এখন দেখা যাক কী হয়। আসলে জীবন তো চালাতে হবে। নিজের পরিবার আছে, দেশে বাবা-মা আছে। এছাড়া হামজা আসার পর দেশের ফুটবলে নতুন করে উন্মাদনা শুরু হয়েছে। আমার যা বয়স, একসময় ঠিকই নিজেকে তৈরি করে দেশে ফিরবো ট্রায়াল দিতে। নিজের স্বপ্ন বিলীন হতে দেবো না।’
ব্রাজিলিয়ান পাসপোর্ট পেতে চেষ্টা করছেন নাজমুল। মাঝে সাও পাওলোর বাইরে গিয়ে থাকার সময় বাসায় চুরি হলে পাসপোর্ট হারিয়ে যায়। তাই নাগরিকত্ব পেতে সময় লাগছে। বেশ কিছু দিন আগে সাও পাওলোতে খেপ খেলার সময় বসুন্ধরা কিংসে খেলা রবিনিয়োর সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। খেলার মাঠে তার সঙ্গে আগের পরিচয় তুলে ধরলে রবিনিয়ো অবাক হন, শুভেচ্ছাও বিনিময় হয়।
নাজমুলের ব্রাজিলে থিতু হওয়ার চেষ্টা সম্পর্কে সেই সময়ে কোচ হয়ে যাওয়া আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, ‘আসলে সেই সময় আমরা সারাদেশ থেকে চারজনকে ব্রাজিলের জন্য বাছাই করেছিলাম। নাজমুল তাদের একজন। ও এখন সেখানে বিয়ে করে থাকছে, কাজও করছে। আসলে দেশে যদি ওর পরিচর্যাটা ঠিকমতো হতো আর আমাদের ফুটবলের অবকাঠামোটা ভালো হতো তাহলে হয়তো ওর মতো ফুটবলার স্থায়ীভাবে দেশ ছাড়ার চিন্তা কমই করতো। এটা আমাদের জন্য দুর্ভাগ্য। সরকার ঠিকই অর্থ ব্যয় করলো কিন্তু দেশের ফুটবলে তা কাজে লাগলো না।’