Image description

কাজী রাজীব উদ্দিন চপল, বয়স ৬১। দীর্ঘদিন ধরে ক্রীড়াঙ্গনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রয়েছেন। হ্যান্ডবল ও খো খো দিয়ে সংগঠক ক্যারিয়ারের সূচনা। এরপর বাংলাদেশে আর্চারির খেলাটির প্রতিষ্ঠা তার হাত ধরেই। তার অধীনে নেপালে ২০১৯ সালে এসএ গেমসে রেকর্ড ১০টি সোনার পদক পেয়েছে বাংলাদেশ। সফলতার পাশাপাশি সাম্প্রতিক সময়ে সমালোচনাও কম শুনছেন না। আর্চারির দুই তারকা রোমান সানা ও দিয়া সিদ্দিকী জুটি রাগ, ক্ষোভ কিংবা ভবিষ্যৎ অনিশ্চিয়তা দেখিয়ে আমেরিকায় থিতু হয়েছেন। এর আগে আরও দুজন আর্চার সেখানে পাড়ি জমিয়েছেন। এক ফেডারেশন থেকে অল্প সময়ের মধ্যে চার খেলোয়াড় বিদেশে পাঁড়ি দেওয়াটা ভীষণ দৃষ্টিকটূ। এরই মাধ্যমে ক্রীড়াঙ্গনের দৈন্যদশাটা যেন আবারও সামনে চলে এসেছে। প্রকারান্তরে সব দায় গিয়ে ঠেকেছে দুই যুগ ধরে সাধারণ সম্পাদক থাকা কাজী রাজীব উদ্দিন চপলের দুয়ারে।

এ নিয়ে বাংলা ট্রিবিউনের কাছে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরে নিজের সর্বোচ্চটা দেওয়ার পাশাপাশি অক্ষমতাও প্রকাশ করেছেন। তবে কোনও দায় স্বীকার করতে চাননি। দেশের বর্তমান ক্রীড়াঙ্গনের যা অবস্থা; তাতে করে তার পক্ষে যা কিছু করা সম্ভব তাই করেছেন বলে দাবি করেছেন। যার বিস্তারিত রয়েছে সাক্ষাৎকারে।

প্রশ্ন: পর্যায়ক্রমে চার আর্চার আমেরিকা পাঁড়ি জমিয়ে। এর মধ্যে আর্চারির দুই বড় তারকা রোমান সানা ও দিয়া সিদ্দিকী। বিষয়টি আপনার জন্য তো বিব্রতকর?

কাজী রাজীব উদ্দিন চপল: না, বিব্রতকর কেন হবে। সবার নিজের স্বাধীনতা আছে। অধিকার আছে। কে, কী করবে তা তো আমরা বলে দিতে পারবো না। ওরা ওদের জীবন নিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমাদের তো আগে কিছু বলেনি। তাই আমি বিব্রত নই।

প্রশ্ন: তাহলে আপনি কোনও দায় নিচ্ছেন না?

 

কাজী রাজীব উদ্দিন চপল: না দায় নেবো কেন। আমি বা আমাদের ফেডারেশন তো ওদের জন্য যতটুকু পেরেছে করেছে। আজ ওদের দেশবাসী চিনেছে খেলাটির কারণে। আমাকেও তাই। আজ ওরা আমেরিকায় আছে এই আর্চারি খেলার কারণে। আগে থেকে ভিসা ছিল। তা এবার নতুন করে কাজে লাগিয়েছে।

প্রশ্ন: রোমান সানা তো নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে হতাশ ছিল। আর দিয়া সিদ্দিকী টঙ্গীর জাতীয় দলের অনুশীলন কেন্দ্রকে ‘টর্চার সেল’ তকমা দিয়েছেন। এটা তাদের দেশ ছাড়ার অন্যতম কারণ। এমন অভিযোগে আপনি কী বলবেন?

কাজী রাজীব উদ্দিন চপল: রোমান সানার পারফরম্যান্স কোনভাবেই আগের মতো হচ্ছিল না। সে কারণে হয়তো একটু হতাশার মধ্যে থাকতে পারে। তাই বলে আগের জায়গায় ফিরতে হলে ওকে ওর মতো চেষ্টা করতে হবে। আর দিয়া আপনাদের অনলাইনে (বাংলা ট্রিবিউন) টর্চারসেলের কথা বলেছে। তা চোখে পড়েছে।

আমি বলবো ও আমার মেয়ের মতো। আমার কথা হলো টর্চার সেল কেন হবে? তাহলে ক্যাম্প কীভাবে চলে আসছে। ওর যদি কোনও সমস্যা হয় তাহলে আমাকে কেন বললো না? এছাড়া হেড কোচ বা অন্যরা তো আমাকে কিছু বলেনি। ওখানে যদি দিয়াকে মানসিকভাবে টর্চার করা হতো, তাহলে আমার কানে তা পৌঁছাতো না?

প্রশ্ন: দিয়া তো দু’জন সহকারী কোচের দিকে আঙুল তুলেছেন..

কাজী রাজীব উদ্দিন চপল: দুই সহকারী কোচ হাসান ও মিলন অনেক ভদ্র ছেলে। ওরা মানসিকভাবে দিয়াকে টর্চার করতে পারে, তা আমার মনে হয় না। তবে ও যেহেতু অভিযোগ করেছে, আমি বিশদভাবে খতিয়ে দেখবো। ২৩ জানুয়ারি টঙ্গী যাবো। ওদের সঙ্গে আমি আলাদাভাবে কথা বলে সবকিছু নতুন করে জানার চেষ্টা করবো।

প্রশ্ন: দিয়া তো এমনও বলেছে- ওর বাবা নাকি ক্যাম্প থেকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল...

কাজী রাজীব উদ্দিন চপল: এটা মোটেও বিশ্বাসযোগ্য কথা নয়। ওর বাবা কখনও আমাকে বলেনি দিয়াকে ক্যাম্প থেকে নিয়ে যাবে, আর্চারি খেলতে দেবে না। ওর বাবা বরং আমার বাসায় এসেছিল অন্য একটা কারণে। আমি তা বিস্তারিত বলতে চাই না। শুধু বলছি আসার কারণ ছিল একটা সালিশকে কেন্দ্র করে।

কাজী রাজীব উদ্দিন চপলের সঙ্গে রোমান সানা।কাজী রাজীব উদ্দিন চপলের সঙ্গে রোমান সানা।প্রশ্ন: আপনি বা আপনার ফেডারেশন তো রোমান সানাকে আর জাতীয় দলে সুযোগ দেননি…

কাজী রাজীব উদ্দিন চপল: কেন দেবো বলুন? যার পারফরম্যান্স নিম্নগামী তাকে কীভাবে জাতীয় দলে সুযোগ দেবো। ওরা বললেই তো হলো না। আমরা তো নিয়মের বাইরে যেতে পারবো না। রোমান কেন লড়াই করে ফিরতে পারলো না। এটা তো ওর ব্যর্থতা।

প্রশ্ন: আপনি তো আগে রোমানকে মানসিকভাবে অসুস্থ বলেছিলেন। এছাড়া অর্থপ্রাপ্তির কথা উঠতেই তখন বলেছিলেন, রোমান খুলনাতে চারতলা বাড়ি করেছে...

কাজী রাজীব উদ্দিন চপল: ও মানসিক ডাক্তার দেখিয়েছে, এটা তো মিথ্যা নয়। আর খুলনার বাড়ির কথা আমি শুনেছি। তবে বাড়ি করেছে বলিনি, বলেছি চার তলার ফাউন্ডেশন নিয়েছে।

প্রশ্ন: কিন্তু ওরা আর্চারি থেকে যা আয় করেছে, তা কি এই সময়ে এসে ঠিকভাবে চলার মতো? ধরুন, জাতীয় দলের ক্যাম্পে ভাতা মাসে তিন হাজার টাকার মতো। এটাকে কীভাবে দেখছেন..

কাজী রাজীব উদ্দিন চপল: দেখুন, বাংলাদেশে ক্রিকেট ও ফুটবলের বাইরে অন্য খেলাগুলোর আর্থিক ভিত্তি প্রায় কাছাকাছি। ওই দুই খেলাতে অনেক টাকা রয়েছে। এখন ওদের সঙ্গে তো আর্চারিকে মেলানো যাবে না। আর্চারি খেলেই আজ ওরা রোমান সানা কিংবা দিয়া সিদ্দিকী হয়েছে। যা পেয়েছে তা এই খেলাকে কেন্দ্র করেই।

জাতীয় দলের জন্য আমরা যতটুকু পেরেছি দিয়েছি। এছাড়া ওরা বাহিনীতে চাকরি করছিল। সেই চাকরিতে যদি মাসে ৩০ হাজার টাকা কিংবা আর একটু কম বেতন পেয়ে থাকে তাহলে আমাদের কী করার আছে। এটাই বাস্তবতা। এখানে আমাদের দায় কোথায়?

প্রশ্ন: ওরা তো দেশের জন্য অনেক পদক নিয়ে এসেছে। কিন্তু রাষ্ট্রীয়ভাবে ভবিষ্যৎ খেলাকে সুন্দরভাবে চালিয়ে নেওয়ার জন্য সেভাবে স্থায়ী কিছু পায়নি। যেখানে শুটার শাকিল আহমেদ, শারমিন আক্তার কিংবা শিরিন আক্তাররা ফ্ল্যাট কিংবা আর্থিকভাবে বড় সুবিধা পেয়েছে। এছাড়া আপনার সঙ্গে সরকারের ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের সুসম্পর্ক আছে। ইচ্ছে করলেই তো আপনি বা আপনারা কিছু একটা করতে পারতেন...

কাজী রাজীব উদ্দিন চপল: আমাদের প্রত্যাশা ছিল তারাও পাবে। কিন্তু এটা তারা ঠিকমতো হয়তো তুলে ধরতে পারেনি। একদিন ওদের একজন বললো মায়ের চিকিৎসা দরকার। সেটাই আমরা প্রশাসনের কাছে তুলে ধরেছিলাম। সেটাতে সহায়তা পেয়েছে। আর মাঠ কিন্তু আমরা পারফরম্যান্সের কারণে পেয়েছি। আমরা চেয়েছি আর্চারদের ভালো সুবিধা দেওয়ার জন্য। এখন ফ্ল্যাট কিংবা স্থায়ী আবাসনের কথা প্রথম শুনলাম। ওদের মুখে কখনও এটার কথা শুনিনি। এছাড়া ওরা আর্চারি খেলে আর্থিকভাবে লাভবান কম হয়নি।

প্রশ্ন: আপনার কি মনে হয় আর্চারদের সঙ্গে ব্যক্তি রাজীব উদ্দিন চপলের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব আছে? ওরা খেলোয়াড় হিসেবে তারকা। আর আপনি তারকা খেলোয়াড়দের সংগঠক। কেউ কারও কাছে ‘হার’ মানতে চাইতেন না...

কাজী রাজীব উদ্দিন চপল: তা হবে কেন। কোনও দ্বন্দ্বই ছিল না। ওদের আমি নিজের ছেলে ও মেয়ের মতো দেখতাম। খেলার বাইরে একজন সংগঠকের যা করার দরকার তাই বলতাম। মাঠের খেলাতে কোচ হলো সর্বেসর্বা। তবে হ্যাঁ, আগে বাবার মতো সবার সঙ্গে মিশতাম। এখন সবকিছু পেশাদার ভিত্তিতে হবে। ওদের বেতন ভাতা বাড়নোর প্রস্তুতি চলছে। অন্য সুবিধাও। এখন থেকে যা হবে তা পুরোপুরি পেশাদার ভিত্তিতে।

প্রশ্ন: বাংলাদেশে আর্চারির প্রতিষ্ঠাতা আপনি। মাঠের বাইরে আপনার নেতৃত্বে এসএ গেমস ছাড়াও বিশ্বের অন্য আসরে বাংলাদেশ পদক পেয়েছে। দীর্ঘ ২৫ বছর দায়িত্বে থেকে এখন কি নিজেকে  ‘স্বৈরশাসক’ মনে হয়?

কাজী রাজীব উদ্দিন চপল: স্বৈরশাসক কেন মনে হবে। আমার একার ইচ্ছাতে সবকিছু হয় না। আমার একজন সভাপতি আছে। নির্বাহী কমিটিতে সবকিছু সিদ্ধান্ত হয়। এছাড়া আমি কখনও হিরো হতে চাইতাম না। তারকা হবে খেলোয়াড়রা।

প্রশ্ন: চারজন চলে গেছে। আর্চারিতে কি শূন্যতা নেমে এলো না?

কাজী রাজীব উদ্দিন চপল: দেখুন কারও জন্য কোন কিছু থেমে থাকে না। ওরা চলে গেছে, অন্যরা আসবে। রোমানের পর সাগর ইসলাম সরাসরি অলিম্পিকে খেলেছে। সুতরাং কারও জায়গা শূন্য থাকে না। এমনকি আমি চপল চলে গেলেও শূন্য থাকবে না। কেউ না কেউ উঠে আসবেই।

প্রশ্ন: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

কাজী রাজীব উদ্দিন চপল: আপনাকেও ধন্যবাদ।