
বাংলাদেশ ক্রিকেটে নতুন করে আলোচনার ঝড় তুলেছে সাকিব আল হাসান ও বিসিবি পরিচালক আসিফ আহমেদের দ্বন্দ্ব। সাম্প্রতিক সময়ের এই সংঘাত শুধু প্রশাসনিক টানাপোড়েনই নয়, বরং দেশের সবচেয়ে সফল ক্রিকেটারের ক্যারিয়ারের ভবিষ্যৎ নিয়েও প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। বোর্ডের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি, সিদ্ধান্ত নিয়ে মতবিরোধ এবং সাম্প্রতিক মন্তব্যের জেরে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, সাকিবের স্পষ্টভাষী ও দৃঢ় অবস্থান অনেক সময় বোর্ডের নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে পড়ে। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। আসিফ আহমেদের সঙ্গে তর্ক-বিতর্কের ঘটনাকে কেন্দ্র করে ক্রিকেট অঙ্গনে গুঞ্জন উঠেছে- বাংলাদেশ ক্রিকেটে কি তবে সাকিব অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটতে যাচ্ছে? অনেকেই মনে করছেন, সাকিবের বিদায়ের প্রহর হয়তো এখন কেবল সময়ের অপেক্ষা—বাংলাদেশ ক্রিকেটে এক গৌরবময় অধ্যায়ের শেষ হয়তো ঘনিয়ে এসেছে।
"শুভ জন্মদিন আপা"- দিয়ে নতুন বিতর্ক শুরু
সাকিব আল হাসান ক্যারিয়ারজুড়ে মাঠে ও মাঠের বাইরে একের পর এক বিতর্ক জন্ম দিয়েছেন, কখনো গ্যালারিতে মারমুখী অবস্থায় দেখা গেছে, কখনো টিভি ক্যামেরায় অসঙ্গত অঙ্গভঙ্গি করে শাস্তি পেয়েছেন। এছাড়া নিজের কাঁকড়া ব্যবসা ক্ষেত্রে কর্মীদের বেতন না দেয়া থেকে শুরু করে শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারির মতো অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
সাকিবের বিরুদ্ধে জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে হত্যা মামলা ও দুর্নীতি দমন কমিশন- দুদকের মামলাও আছে, সম্পূরক তথ্য হচ্ছে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সাকিব আল হাসান ছিলেন দুদকের শুভেচ্ছাদূত।
এবার তিনি জন্ম দিয়েছেন নতুন এক বিতর্কের, বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্মদিনে একটি ছবি পোস্ট করে লিখেছেন, "শুভ জন্মদিন আপা"।
২০২৪ সালের জুলাই-অগাস্টে ঘটে যাওয়া গণঅভ্যুত্থান দমাতে শেখ হাসিনা মারণাস্ত্র ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছেন বলে বলছে আদালত, সরকারের পক্ষ থেকে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় যে গেজেট তৈরি করেছে, তাতে জুলাই অভ্যুত্থানে নিহতের সংখ্যা বলা হচ্ছে ৮৪৪ জন।
এমন এক পরিস্থিতিতে শেখ হাসিনার জন্মদিনে সাকিব আল হাসানের শুভেচ্ছা অনেকেই ভালোভাবে নেননি।
তাদেরই একজন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ, যিনি এক নিজের ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন। সেখানে তিনি লিখেন, "একজনকে পুনর্বাসন না করায় সহস্র গালি খেয়েছি। আমি নির্বাচন করেছিলাম, রাজনীতিতে লিপ্ত হইনি।"
আসিফ মাহমুদের পোস্টের পর সাকিবও ফেসবুকে প্রতিক্রিয়া জানান। তিনি লেখেন, "শেষমেশ কেউ একজন স্বীকার করে নিলেন, তাঁর জন্যই আমার আর বাংলাদেশের জার্সি গায়ে দেওয়া হলো না, বাংলাদেশকে খেলতে পারছিলাম না!"
আসিফ মাহমুদ পরে আরেকটি ফেসবুক স্ট্যাটাসে খানিকটা শ্লেষ মাখা ভাষায় লিখেন, "ভাইয়া, আমাকে জোর করে নমিনেশন দেওয়া হয়েছিল। আমি শুধু নির্বাচনটাই করেছিলাম, আওয়ামী লীগের দলীয় রাজনীতিতে জড়িত হইনি। ইউ নো হু।"
তিনি যোগ করেন, "যার হাত ছাত্র-জনতার রক্তে রঞ্জিত, তাকে বাংলাদেশের পতাকা বহন করতে দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। বোর্ডের কর্তারা একাধিকবার রাজনৈতিক অবস্থান পরিষ্কার করতে বললেও তা না করে বরং খুনিদের এনডোর্স করা ছাড়াও শেয়ার মার্কেট কেলেঙ্কারি, মানি লন্ডারিং, ফিন্যান্সিয়াল ফ্রড করা কাউকে কেন শুধু ভালো ক্রিকেটার বলেই পুনর্বাসন করতে হবে? আইন সবার জন্য সমান, ফেস ইট।"
ঘটনার প্রেক্ষাপট কী?
অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের সময় কানাডায় ছিলেন সাকিব আল হাসান। সেখানে তিনি একটি টি-২০ লীগে অংশ নিতে গিয়েছিলেন। গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর সাকিব আর দেশে ফিরতে পারেননি।
নৌকা প্রতীকে ২০২৪ সালের বিতর্কিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি, এটাকে তখনই ভালোভাবে নেননি অনেক ক্রিকেট প্রেমী, এমনকি সাকিব আল হাসানকে পছন্দ করেন এমন অনেকেই তখন সাকিবের রাজনীতিতে জড়ানোর সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিলেন।
অভ্যুত্থানের পর আরও অনেকের মতোই সাকিবের নাম জড়িয়ে যায় হত্যা মামলায়। এছাড়া শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের মামলায়ও আছে সাকিবের বিরুদ্ধে।
গণ-অভ্যুত্থানের পর দেশের বাইরে পাকিস্তান ও ভারতের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজ খেললেও ঝামেলা শুরু হয় দেশের মাটিতে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টেস্ট সিরিজের সময়।
সময়টা সেপ্টেম্বর ২০২৪, সাকিব সংবাদ সম্মেলনে জানান তিনি দেশের মাটিতে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজ দিয়েই টেস্ট ক্যারিয়ার শেষ করতে চান।
বাংলাদেশ ক্রিকেটের ইতিহাসে সাকিব আল হাসানের বিদায়ী ম্যাচ নিয়ে যে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছিল, তা শেষ পর্যন্ত বাস্তবেই রূপ নেয়। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ঘরের মাঠে শেষ টেস্ট খেলার ইচ্ছা থাকলেও নিরাপত্তাজনিত কারণে সেটি আর সম্ভব হয়নি।
তখন সাকিব দেশে ফেরার আগে সরকারের কাছে নিশ্চয়তা চেয়েছিলেন, যেন ম্যাচ শেষে তিনি নিরাপদে যুক্তরাষ্ট্রে পরিবারে ফিরতে পারেন। তবে যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে স্পষ্ট করে দেন, "খেলোয়াড় সাকিবের নিরাপত্তা নিশ্চিত আছে। কিন্তু ফ্যাসিস্ট সরকারের সাবেক সংসদ সদস্য সাকিব আল হাসানের বিরুদ্ধে জনমনে তৈরি হওয়া ক্রোধের বিপরীতে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা চাওয়াটা অবান্তর।"
এমন অবস্থায় বিসিবির তখনকার সভাপতি ফারুক আহমেদ জানিয়ে দেন, নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ক্রিকেট বোর্ডের দায়িত্ব নয়, সরকারের কাজ। আর বিসিবি পরিচালক ও সাকিবের দীর্ঘদিনের কোচ নাজমূল আবেদীনও তখন মন্তব্য করেছিলেন, ঘরের মাঠে সাকিবের শেষ টেস্ট খেলার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।
পরে সরকার এ বিষয়ে ভিন্ন কোনো সিদ্ধান্ত না নেওয়ায়, কানপুরে ভারতের বিপক্ষে টেস্ট ম্যাচই থেকে যায় সাকিব আল হাসানের শেষ টেস্ট। দলের সঙ্গে যোগ দিতে দুবাই হয়ে ঢাকায় ফেরার পথে সরকারের অনুমতি না পাওয়ায় মাঝপথ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যেতে হয় তাঁকে।
তখনই নানা বক্তব্য ও পরিস্থিতির সূত্র ধরে ধারণা করা হয়েছিল, সাকিবকে দেশে ফেরার সুযোগ না দেওয়ার পেছনে বড় ভূমিকা ছিল ক্রীড়া উপদেষ্টার। সেই ধারণার সত্যতা কিছুটা স্পষ্ট হয়েছে সম্প্রতি আসিফ মাহমুদের ফেসবুক স্ট্যাটাসে।
তার লেখা 'একজনকে পুনর্বাসন না করা' আসলে সাকিবকেই ইঙ্গিত করে বলা।
সাকিবও যে সেটাই বুঝেছেন, তা বোঝা যায় তাঁর পাল্টা প্রতিক্রিয়ায়। বাংলাদেশ সময় রাত ১১টা ২০ মিনিটের দিকে নিজের ফেসবুক পোস্টে তিনি লেখেন, "যাক, শেষমেশ কেউ একজন স্বীকার করে নিলেন যে তাঁর জন্যই আমার আর বাংলাদেশের জার্সি গায়ে দেওয়া হলো না, বাংলাদেশের জন্য খেলতে পারলাম না!"
স্ট্যাটাসের শেষে তিনি যোগ করেন, "ফিরব হয়তো কোনো দিন আপন মাতৃভূমিতে, ভালোবাসি বাংলাদেশ।"
সম্পদের তথ্য গোপনেও ‘নাম্বার ওয়ান’
ব্যাংকের এফডিআর, শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ, আমানতের সুদ থেকে আয় কিংবা দেশ-বিদেশে যেসব ক্রিকেট লিগে অংশ নিয়েছেন সেসব থেকে আয়ের তথ্যও গোপন করেছেন সাকিব। এখন পর্যন্ত ১০৬ কোটি টাকার বেশি জ্ঞাত আয়বহির্ভূত অর্থের সন্ধান পেয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আয়কর তদন্ত গোয়েন্দা ইউনিট। এর মধ্যে কর ফাঁকির পরিমাণ ৩০ কোটি টাকার বেশি।
আয়কর নথি অনুযায়ী সাকিবের আয়ের খাত বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) চুক্তিবদ্ধ খেলোয়াড় হিসেবে মাসিক বেতন, বিজ্ঞাপনী আয় আর ব্যাংকের কিছু স্থিতি। এছাড়া একমাত্র ইন্ডিয়ান ক্রিকেট লিগ (আইপিএল) থেকে আয় দেখানো হয় শুধু ২০১৭-১৮ করবর্ষে। যদিও তিনি ২০০৮ সালে আইপিএল শুরুর বছর থেকেই অংশ নিচ্ছেন।
তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, আইপিএল ছাড়াও বিশ্বের প্রায় সব টি-২০ লিগে অংশ নিয়েছেন সাকিব। এর মধ্যে ২০১১ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত (২০১৩ সাল ব্যতীত) তিনি বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে (বিপিএল) খেলেছেন। পাকিস্তান সুপার লিগে (পিএসএল) ২০১৫-১৬, ২০১৬-১৭, ২০২২-২৩ ও ২০২৫ মৌসুমে খেলেন। এলপিএলে ২০২৩ সালে, ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার লিগে (সিপিএল) ২০১৩, ২০১৬, ২০১৭, ২০১৯ ও ২০২২ মৌসুমে, বিগ ব্যাশ লিগে ২০১৩-১৪ ও ২০১৪-১৫ মৌসুমে, চ্যাম্পিয়ন লিগ টি-২০তে ২০১১-১২ ও ২০১২-১৩ মৌসুমে, মেজর লিগ ক্রিকেটে (এমএলসি) ২০২৪ সালে খেলেন। কিন্তু এসব লিগ থেকে উপার্জিত আয়ের কোনো তথ্যই আয়কর নথিতে দেখাননি তিনি। বিভিন্ন সময়ে ম্যান অব দ্য ম্যাচ কিংবা ম্যান অব দ্য সিরিজ হিসেবে পুরস্কারের অর্থও গোপন করেছেন সাকিব।
গোয়েন্দারা সাকিবের আয়কর নথি পর্যালোচনা করে এসব তথ্য পেয়েছেন। তবে এ বিষয়ে অধিকতর তদন্তের প্রয়োজন হতে পারে বলে মনে করছেন তারা। বিশেষ করে ২০২১-২২ আয়কর বছর থেকে সাকিবের এফডিআরের পরিমাণ কমতে শুরু করে। গোয়েন্দারা ধারণা করছেন, সাকিব তার জমানো অর্থ উত্তোলন করে দেশের বাইরে নিয়ে গেছেন।
আমেরিকার নিউ ইয়র্কে তার বাড়ি থাকার তথ্য বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে। বাংলাদেশের ক্রিকেট খেলোয়াড়রা ২০২৩ সালের নভেম্বর মাসে টি-২০ বিশ্বকাপ প্রস্তুতির জন্য দেশটিতে সফরে গেলে সাকিবের বাসায় আতিথ্য গ্রহণ করার খবর বহুলভাবে প্রচারিত হয়। তিনি নিজেও ইনস্ট্রাগ্রাম স্টোরিতে সেটির ছবি ও ভিডিও আপলোড করেন। এতে দেশের বাইরে সাকিবের আরো সম্পদের খোঁজ মিলতে পারে বলে আয়কর গোয়েন্দারা ধারণা করছেন।
সাকিবের অর্থ কেলেঙ্কারি নিয়ে তদন্ত এখনো চলমান আছে। বর্তমানে ‘সাকিব আল হাসান ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট’ ও ‘সাকিব আল হাসান ক্যানসার ফাউন্ডেশন’ নামে দুটি দাতব্য প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আয়কর ফাঁকির ঘটনা ঘটেছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
আয়কর গোয়েন্দা ও তদন্ত ইউনিটের কমিশনার আবদুর রকিব আমার দেশকে বলেন, সাকিবের কর ফাঁকির বিষয়ে তদন্ত চলমান আছে। ইতোমধ্যে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের খোঁজ মিলেছে। এসব সম্পদের বিপরীতে সরকারের রাজস্ব আদায়ে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ২৩ ডিসেম্বর আয়কর গোয়েন্দা ও তদন্ত ইউনিটের কার্যক্রম শুরু হয়। মূলত ব্যক্তি পর্যায়ে আয়ের তথ্য গোপন করে রাজস্ব ফাঁকি উদঘাটন ও আদায়ে এই ইউনিট গঠন করা হয়। তদন্ত ইউনিট তাদের প্রথম ফাইলটি ওপেন করে সাকিবের নামেই। এখানেও তিনি ‘নাম্বার ওয়ান’।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮-১৯ করবর্ষে ২৭ কোটি ৮৫ লাখ টাকা আয়কর দেখানো হয়। ওই বছরে ছয় কোটি ৫৭ লাখ টাকা এফডিআর এবং সুদ বাবদ এক কোটি ৯২ লাখ টাকা আয় গোপনের তথ্য মিলেছে। শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের তথ্যও দেখানো হয়নি। ২০২১-২২ করবর্ষে শেয়ার ব্যবসায় বিনিয়োগ দেখানো হয়েছে ছয় কোটি ৫৭ লাখ টাকা।
এসবিএল ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট নামে একটি সিকিউরিটিজ হাউস থেকে যে তথ্য পাওয়া গেছে, তাতে দেখা যায় সাকিবের বিনিয়োগের পরিমাণ ২১ লাখ ৮৮ লাখ টাকা। র্যাংকন থেকে ২০ কোটি ৫০ লাখ টাকা দামের একটি ফ্ল্যাট কেনেন, যা ২০২৩ সালে তার নামে হস্তান্তর করা হয়েছে সেটিও আয়কর নথিতে নেই। এভাবে ২০১৮-১৯ থেকে ২০২২-২৩ করবর্ষ পর্যন্ত সাকিবের আয়বহির্ভূত ব্যাংক হিসাবে পাওয়া গেছে ১০৬ কোটি টাকা।
বিতর্কের বরপুত্র সাকিব
বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব শৃঙ্খলাভঙ্গ, রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা, ব্যবসায়িক কেলেঙ্কারি ও ব্যক্তিগত আচরণে হয়ে উঠেছেন বিতর্কের বরপুত্র। তার ক্যারিয়ারের প্রতিটি অধ্যায়ে অসংখ্য প্রশ্নবিদ্ধ কর্মকাণ্ড। আজকের সাকিবকে বোঝা মানে শুধু বর্তমান নয়, ভবিষ্যতের দিকেও তাকানো- কারণ তার প্রতিটি পদক্ষেপই বাংলাদেশের ক্রিকেট ও সামাজিক জীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলছে।
রাজনীতি ও সংসদ সদস্য হওয়া
২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে সাকিব আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়ে মাগুরা থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। রাজনৈতিক প্রার্থিতা গ্রহণের মাধ্যমে তিনি ক্রিকেট থেকে মনোযোগ সরিয়ে নেন।
শৃঙ্খলাভঙ্গ ও মাঠের ঘটনা
সাকিবের ইমেজের বড় সমস্যা হলো তার মাঠের আচরণ। আম্পায়ারের সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ হয়ে স্টাম্প ভাঙা, ভক্তকে মারধরের চেষ্টা, খেলোয়া- সুলভ আচরণের অভাব— এসব ঘটনা বারবার পুনরাবৃত্ত হয়েছে। ফলে ভক্তরা তাকে ভালোবাসলেও তার প্রতি আস্থা হারিয়েছেন অনেকেই।
বিতর্কের কারণ: কেন সাকিব সবসময় আলোচনায়
অহংকার ও আত্মকেন্দ্রিকতা: সাকিবকে অনেকেই অহংকারী ও আত্মকেন্দ্রিক বলে আখ্যা দেন। তিনি মাঠে এবং বাইরে অনেক সময় এমন আচরণ করেন, যা ভক্ত-সমর্থকদের হতাশ করে।
ব্যবসায়িক কেলেঙ্কারি: শেয়ার মার্কেটে অনিয়ম, প্রতারণামূলক ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড এবং অবৈধ বিজ্ঞাপন তার ভাবমূর্তিকে ক্ষুণ্ন করেছে।
ধর্মীয় বিতর্ক: কালীপূজার মঞ্চে যাওয়া কিংবা বিতর্কিত অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার কারণে অনেক মুসলিম ভক্ত ক্ষুব্ধ হয়েছেন।
বিসিবির সঙ্গে দ্বন্দ্ব
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সঙ্গে তার সম্পর্ক সব সময় টানাপোড়েনের ছিল। বোর্ডের সিদ্ধান্তে অসন্তুষ্ট হয়ে তিনি বারবার প্রকাশ্যে সমালোচনা করেছেন।
সাকিবের ভবিষ্যৎ: সম্ভাবনা নাকি সমাপ্তি? ক্রিকেটে প্রত্যাবর্তনের প্রশ্ন- বর্তমানে সাকিবকে ঘিরে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো- তিনি কি আবার জাতীয় দলে খেলতে পারবেন? বিসিবি এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি।
তবে ক্রীড়া উপদেষ্টার মন্তব্যে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে যে, তাকে আর ফিরিয়ে আনা হবে না। যদি তিনি রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা থেকে বের হতে না পারেন, তাহলে তার ক্রিকেট ক্যারিয়ার কার্যত সমাপ্ত হতে পারে।
আন্তর্জাতিক ইমেজ
বিশ্ব ক্রিকেটে সাকিব এখনো একজন মহাতারকা। তবে রাজনৈতিক বিতর্ক ও শৃঙ্খলাজনিত কারণে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট সংস্থাগুলোও তার প্রতি আস্থা রাখতে দ্বিধাগ্রস্ত হতে পারে। আইসিসির নজরে তিনি আগে থেকেই ছিলেন; ভবিষ্যতে আবারও শাস্তির মুখে পড়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
প্রসঙ্গত, ভবিষ্যতে তিনি কি আবার বাংলাদেশের জার্সি গায়ে দিতে পারবেন, নাকি রাজনীতির অঙ্গনে স্থায়ী হয়ে যাবেন- তা এখনো অনিশ্চিত। তবে নিশ্চিত একটি বিষয় হলো, তার প্রতিটি পদক্ষেপই আলোচনার জন্ম দেবে, কারণ তিনি শুধু একজন ক্রিকেটার নন, তিনি এখন এক বিতর্কিত ব্র্যান্ড। বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে সাকিব আল হাসান হয়তো সর্বশ্রেষ্ঠ খেলোয়াড় হিসেবে থাকবেন, কিন্তু সেই ইতিহাসের পাতায় তার নামের পাশে থাকবে অনেক প্রশ্ন, অনেক সমালোচনা, আর এক অবিস্মরণীয় উপাধি— “বিতর্কের বরপুত্র”।
শীর্ষনিউজ