Image description
ব্যাটসম্যান শচীন টেন্ডুলকারের মতোই প্রেমিক টেন্ডুলকার এক অবিশ্বাস্য ব্যতিক্রম। ১৭ বছর বয়সে যে নারীর প্রেমে পড়েছিলেন, এই ৫২ বছর বয়সে এসেও তাঁর সঙ্গেই সুখের সংসার। ভারত তো বটেই, বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্রিকেট তারকার খ্যাতি উপভোগ করেছেন একটা সময়, কিন্তু কখনোই অন্য কোনো নারী তাঁকে টানেনি, পারেনি টলাতে। টেন্ডুলকারের জীবনের সেই প্রথম ও শেষ প্রেমের নাম অঞ্জলি। টেন্ডুলকারের ভাষায় যার সঙ্গে হয়েছে তাঁর জীবনের সেরা জুটি! কীভাবে প্রেমে পড়েছিলেন দুজন, পাঁচ বছর কীভাবে লুকিয়ে প্রেম করেছেন, তারপর কীভাবে হলো দুজনের বিয়ে? উত্তর আছে টেন্ডুলকারের আত্মজীবনী প্লেয়িং ইট মাই ওয়ে-তে।

কী লিখেছেন টেন্ডুলকার

আমি তখন সবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিজের একটু জায়গা বানানোর চেষ্টা করছি। সেই সময়, ১৯৯০ সালের আগস্টে আমার জীবন একটা নাটকীয় মোড় নিল। অঞ্জলির সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হলো। অঞ্জলি—পরে যিনি আমার স্ত্রীও হয়েছেন। আমার জীবনের সেরা জুটিটার শুরু ওখান থেকে।

১৯৯০ সালে ইংল্যান্ড সফর থেকে ফিরছিলাম। মুম্বাই বিমানবন্দরে নেমে ব্যাগ নেওয়ার জন্য চেষ্টা করছি। হঠাৎ ভিউইং গ্যালারিতে চোখ পড়ল। অসাধারণ সুন্দরী এক মেয়ে নিচে তাকিয়ে আছে। আমার দিকেই তাকিয়ে আছে বলে মনে হচ্ছিল।

তখনো জানতাম না, এই মেয়েই পরে আমার জীবনসঙ্গী হবে। ওর এক বান্ধবী ড. অপর্ণা সন্তনমের সঙ্গে সেদিন দাঁড়িয়ে ছিল। অপর্ণা এখন মুম্বাইয়ের বিখ্যাত চর্মরোগবিশেষজ্ঞ। ক্ষণিকের জন্য চোখাচোখি হলো অঞ্জলির সঙ্গে, তারপরই সে যেন হাওয়া হয়ে গেল!

বিমানবন্দর থেকে বের হওয়ার সময় আবার দুজনকে দেখলাম। অঞ্জলি একটা কমলা রঙের টি-শার্ট আর নীল জিনস পরে গেট থেকে দৌড়ে বের হচ্ছিল। কেন জানি মনে হচ্ছিল, আমার পেছনেই ছুটে আসছে। শুধু তা–ই নয়, শুনলাম সে চিৎকার করে বলছে, ‘উফফ, কী মিষ্টি ছেলে!’

আমার অস্বস্তি লাগছিল। লজ্জায় লাল হয়ে গেলাম। কারণ, জানতাম, অজিত আর নিতিন (টেন্ডুলকারের দুই ভাই) বাইরে আমার জন্য অপেক্ষা করছে। ওরা দেখলে কী ভাববে! ছোটবেলার বন্ধু সুনীল হর্ষে আমার সঙ্গেই ছিল। ও আমার কানে ফিসফিস করে বলল, ‘খুব সুন্দরী একটা মেয়ে তোর নাম ধরে ডাকছে, তোর সঙ্গে দেখা করতে চাইছে।’
আমি তো আড়চোখে আগেই দেখেছি। মেয়েটাকে ভালোও লেগেছে। কিন্তু সুনীলকে বললাম, ‘অজিত আর নিতিন আশপাশে থাকলে আমার পক্ষে মেয়েটার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব নয়।’

অঞ্জলি আর আমি ১৯৯০ থেকে ১৯৯৫—এই পাঁচ বছর প্রেম করেছি। সেই প্রেম পরে বাগ্‌দান এবং বিয়েতেও গড়িয়েছে। অথচ আমাদের দুজনের ব্যাকগ্রাউন্ড আকেবারে আলাদা ছিল। অঞ্জলি অর্ধেক গুজরাটি, অর্ধেক ইংরেজ। দক্ষিণ মুম্বাইয়ের খুব ধনী পরিবারের মেয়ে। ও সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে পড়াশোনা করেছে, তারপর জেজে হাসপাতালে ডাক্তারি পড়েছে। ওর কথা বলার ধরন খুব সুন্দর ছিল।

আমার বেড়ে ওঠা আর ওর বেড়ে ওঠা একেবারে আলাদা। ওদের পরিবারে পাশ্চাত্য পোশাক পরাটা ছিল সাধারণ ব্যাপার। আমার পরিবারের পরিস্থিতি ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। আমি তো বলতে গেলে আমার পাড়ার বাইরেই কখনো যাইনি, সব বন্ধুই ছিল ক্রিকেটজগতের।

স্ত্রী অঞ্জলির সঙ্গে শচীন টেন্ডুলকার
স্ত্রী অঞ্জলির সঙ্গে শচীন টেন্ডুলকারএক্স

কোনো দিন কাউকে ডেট করতে দেখিনি, বাড়িতে নিয়ে যাওয়া তো দূরের কথা। আমার বয়সী ছেলেরা যখন কলেজে গিয়ে মেয়েদের সঙ্গে মিশছে, আমি তখন ভারতের হয়ে খেলছি—মাত্র ১৬ বছর বয়স থেকে—তাই সে সুযোগই আসেনি।

আমি অঞ্জলিকে প্রথম মুম্বাই বিমানবন্দরে দেখলেও সে আমাকে এর কয়েক সপ্তাহ আগেই দেখেছিল। ১৪ আগস্ট ওল্ড ট্রাফোর্ডে আমার প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি করার সময়। বাবা-মায়ের সঙ্গে তখন সে ইংল্যান্ডে ছিল। ওর বাবা আনন্দ মেহতা, ভারতের সাবেক জাতীয় ব্রিজ চ্যাম্পিয়ন এবং ভীষণ ক্রিকেট অনুরাগী, তাঁকে টেলিভিশনে আমার ইনিংসটি দেখার জন্য ফোন করেছিলেন। তবে ক্রিকেটে অঞ্জলির কোনো আগ্রহ ছিল না, সে মোটেও মনোযাগ দিয়ে আমার খেলা দেখেনি। এরপর সে ভারতে ফিরে আসে।

অঞ্জলির মা অ্যানাবেল জাতিতে ইংরেজ, তবে তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে ভারতে সমাজকর্মী হিসেবে কাজ করছেন। তাঁকে আনতেই অঞ্জলি বিমানবন্দরে গিয়েছিল। সেখানেই আমাদের প্রথম দেখা। বিমানবন্দরে আমাকে দেখার পরের দিন, সে তার বন্ধু মুফি মুফাজ্জল লাকদাওয়ালাকে (যে ক্লাব ক্রিকেট খেলত এবং এখন একজন বিখ্যাত সার্জন) আমার ফোন নম্বর জোগাড় করে দিতে বলে। এটা অঞ্জলিই আমাকে পরে বলেছে। বাড়ি ফিরে সে নাকি তার বাবা-মাকে মজা করে বলেছিল, ‘আমি আমার স্বপ্নের পুরুষকে দেখেছি।’

মুফি তাকে আমার নম্বর জোগাড় করে দেয়। সে ফোন করল এবং খুবই কাকতালীয় যে আমিই তার ফোন ধরলাম! তখন মোবাইল ছিল না। আমি ল্যান্ডলাইন ধরার জন্য খুব কমই বাড়িতে থাকতাম। ভাগ্যের ফেরে, সেদিন যেন সব মিলে গিয়েছিল। ও আমাকে বলল, সে বিমানবন্দরের সেই মেয়ে এবং আমরা দেখা করতে পারি কি না, জানতে চাইল। আমি খুব বেশি আগ্রহ না দেখিয়েই বললাম, ‘হ্যাঁ, মনে আছে।’ তারপর ওকে জানালাম, ‘আমি ক্রিকেট ক্লাব অব ইন্ডিয়াতে আছি, ওখানে দেখা হতে পারে।’
আমার যে ওকে মনে আছে, এটা সে প্রথমে বিশ্বাস করেনি। তাই জিজ্ঞেস করেছিল, সেদিন সে কী পরে ছিল, সেটা আমার মনে আছে কি না। যখন আমি কমলা রঙের টি-শার্ট আর নীল জিনসের কথা বললাম, ও মুগ্ধ হয়ে গেল।

 
স্ত্রী–সন্তানদের সঙ্গে শচীনএক্স

তারপর সে ক্রিকেট ক্লাব অব ইন্ডিয়াতে এল। কিন্তু এত লোকের ভিড়ে আমাদের ভালোভাবে দেখা করা বা কথা বলা সম্ভব ছিল না। আর ওই সময় আমাদের ব্যাপারটা গোপন রাখাই ভালো মনে হয়েছে। তাই আমরা শুধু নম্বর আদান–প্রদান করলাম এবং এরপর থেকে নিয়মিত ফোনে কথা বলতে শুরু করলাম। কিছুদিন পরই আমার বউদি মিনা সন্দেহ করতে শুরু করলেন, আমার কিছু একটা হয়েছে। তিনি প্রায়ই আমাকে জিজ্ঞেস করতেন, ‘যে মেয়েটা তোমাকে ফোন দেয়, সে কে?’ আমি উত্তর এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতাম। পরিবারের সঙ্গে ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে কথা বলতে আমি অভ্যস্ত ছিলাম না, খুব অস্বস্তি বোধ করতাম।

আমাদের প্রথম ভালো করে দেখা হয় আমার বাড়িতে। আমরা পরিকল্পনা করেছিলাম, অঞ্জলি একজন রিপোর্টার সেজে আমার সাক্ষাৎকার নিতে আসবে। ওটাই ছিল অঞ্জলির সাংবাদিক হওয়ার প্রথম ও শেষ চেষ্টা। এর আগে কোনো নারী রিপোর্টার আমার বাড়িতে সাক্ষাৎকার নিতে আসেনি। মিনা বউদি ঠিকই সন্দেহ করে বসলেন—ওই ফোন করা মেয়েটাই বুঝি এসেছে!

 

অঞ্জলিকে কিছু খেতে দিতে চাইছিলাম। দেখি, ইংল্যান্ড থেকে আনা চকলেট প্রায় শেষ। মাত্র দুটি ছিল, সেগুলোই কেটে সুন্দরভাবে প্লেটে সাজিয়ে দিলাম। সে বেশি সময় থাকেনি। যতটুকু চেয়েছিলাম তার চেয়ে অনেক কম।

তবু ও একটা গভীর ছাপ ফেলে গেল। ওর সঙ্গে থাকলে খুব ভালো লাগত। ঠিক কী কারণে যে ওকে এত পছন্দ হয়ে গেল, বলা মুশকিল। খুব একটা কথা বলিনি—ভয় ছিল, যদি বোকার মতো কিছু বলে ফেলি। ও-ই বেশি কথা বলত, আমি শুনে যেতাম। তখন আমার ইংরেজিও খুব ভালো ছিল না—এটা আরেকটা কারণ ছিল হয়তো। কিন্তু অঞ্জলি কখনো আমাকে অপ্রস্তুত করেনি। ও ছিল আমার জন্য একেবারে আদর্শ।

শচীন টেন্ডুলকার যখন ক্রিকেটার
শচীন টেন্ডুলকার যখন ক্রিকেটারএএফপি

আমাদের দেখা হতো খুব কম। মাঝেমধ্যে প্ল্যান করতাম রাত সাড়ে আটটায় গাড়িতে ঘুরতে যাব। কিন্তু দেখা গেল, ওর বাবা-মা ওকে নিয়ে বসে টিভি দেখছেন। তখন সে বেরোতে পারত না। ওর বাবা-মা তখনো কিছু জানতেন না। আমি বান্দ্রা থেকে ওয়ার্ডেন রোড পর্যন্ত প্রায় ৪০ মিনিট ড্রাইভ করে যেতাম, গাড়িতেই বসে থাকতাম। কখনো কখনো ওকে না দেখেই ফিরে যেতে হতো। ওই এলাকায় পাবলিক ফোন থেকে ফোন করতে পারতাম না। কেউ যদি দেখে ফেলে, চিনে ফেলে! তাই আবার বান্দ্রা ফিরে গিয়ে ফোন করে বলতাম, ‘আবার চেষ্টা করো।’ আবার যেতাম। বুঝতে পারছেন, কেন আমি মোবাইল ফোনের বড় ভক্ত!

একবার অঞ্জলি বলল, ওকে বাড়ি থেকে গিয়ে নিয়ে আসতে। আমরা ওর মারুতি ৮০০—যেটা তখন ভারতের সবচেয়ে সাশ্রয়ী গাড়ি—নিয়ে ঘুরতে বের হলাম। মেরিন ড্রাইভে গিয়ে সে ডাব খেতে চাইল। জীবনে প্রথম ও শেষবারের মতো আমরা এয়ার ইন্ডিয়া বিল্ডিংয়ের সামনে বসে ডাব খেলাম। ওর খুশির কথা ভেবেই রাজি হয়েছিলাম। যদিও জানতাম, কেউ কেউ আমাকে চিনে ফেলতে পারে।

ইংল্যান্ডে সেঞ্চুরি করার পর আমি একটু বিখ্যাত হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু ওকে কিছু বলিনি। চাইনি ও আমাকে অহংকারী ভাবুক। ও তো ক্রিকেট বোঝেই না। জানতও না, ভারতে একজন ক্রিকেটারের কী খ্যাতি আর সেই সঙ্গে কত কম গোপনীয়তা থাকে! ফলে সিনেমা দেখা, ফুটপাতে দাঁড়িয়ে খাওয়া বা সমুদ্রের ধারে হাঁটার মতো সাধারণ কাজও আমি করতে পারতাম না। আমাদের সম্পর্কের শুরুতেই এই রকম কিছু সমঝোতা করে নিতে হয়েছিল।

একবার আমরা সেই নিয়ম ভাঙার চেষ্টা করেছিলাম। ১৯৯৩ সালে, ‘রোজা’ সিনেমাটা দেখতে গিয়েছিলাম ওর বাবা আনন্দ ও কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে, ওরলির এক সিনেমা হলে। খুব পরিকল্পনা করে গিয়েছিলাম—আমি ছদ্মবেশ নিয়েছিলাম—পরচুলা, নকল গোঁফ আর চশমা পরে। কিন্তু বিরতির সময় চশমা ভেঙে যায়। বন্ধুরা বলল, ভাঙা চশমা পরিস না, চোখে লাগতে পারে। এরপর গোঁফ খুলে যেতেই লোকজন চিনে ফেলল। অস্বস্তিকর পরিস্থিতি, সিনেমা ছেড়ে বেরিয়ে আসতে হয়েছিল।

 
শচীন ও অঞ্জলিএক্স

বহু বছর পর ছেলেমেয়েদের নিয়ে বেড়াতে গিয়ে সুইজারল্যান্ডেও এ রকম হয়েছিল। একদিন ইন্টারলাকেনে ঘুরতে গিয়েছিলাম, যেটা এখন ‘দিলওয়ালে দুলহনিয়া লে জায়েঙ্গে’র লোকেশন হিসেবে ভারতীয় পর্যটকদের কাছে খুব জনপ্রিয়। ঘুরতে যাওয়ার আগে এক বন্ধুরা বলেছিল, চিনে ফেলতে পারে, সাবধানে যেয়ো। তাই ঘোড়ার গাড়ি ভাড়া করলাম। কিন্তু যেই না রওনা দিয়েছি, কয়েকজন ভারতীয় পর্যটক দেখে ফেললেন। আমাদের তাড়া করতে লাগলেন। চালককে বললাম, দ্রুত চালাও! শেষমেশ তাঁরা হাল ছেড়েছিলেন।

এসব কারণে অঞ্জলি আর আমার পক্ষে একসঙ্গে বাইরে দেখা করা প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছিল। আমরা হয় তার বন্ধুর বাড়িতে দেখা করতাম, নয়তো সে আসত আমাদের বাড়িতে, কিংবা দেখা হতো কারও গাড়ির ভেতর। খুব গোপনীয়তা রেখে আমাদের সম্পর্কটা এগোতে হয়েছে। তবে এই কঠিন সময়টাই আমাদের সম্পর্ককে আরও মজবুত করেছে। আমাদের প্রেম আসলে খুব সাদামাটা ছিল। একে অন্যকে জানতাম, বুঝতাম। আমার তখন কোনো ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ছিল না। ভাবতাম, যা হওয়ার হোক, দেখা যাবে।

 

আমাদের দ্বিতীয় দেখার পর প্রায় ছয় মাস আমাদের কোনো যোগাযোগ ছিল না। আমি ট্যুরে ছিলাম, আর অঞ্জলি তার ডাক্তারি ফাইনালের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত ছিল। আমি জানতাম সে কতটা পরিশ্রম করেছে। নিশ্চিত ছিলাম, সে পরীক্ষায় ভালো করবে। পরীক্ষার দিন আমি অস্ট্রেলিয়া থেকে খুব ভোরে তাকে ফোন করে শুভকামনা জানাই। অনেক দিন পর ওর গলা শুনে আমি খুব খুশি হয়েছিলাম।

ও খুব নার্ভাস বোধ করছিল, ভয় পাচ্ছিল যদি পরীক্ষায় ফেল করে! আমি জানতাম, এ রকম কখনোই হবে না। ওকে বললাম, যদি তুমি পরীক্ষায় ফেল করো, তাহলে মুম্বাইয়ের সবাই ফেল করবে। সে সব সময় প্রথম হতো এবং এবারও অন্য কিছু হওয়ার কোনো সম্ভাবনা ছিল না। আমি ওকে বলেছিলাম, ‘তুমি এক দিনে যত ঘণ্টা পড়াশোনা করো, আমি সারা মাসেও তত ঘণ্টা পড়াশোনা করি না।’ পরে সে আমাকে বলেছিল, আমার সেদিনের ফোন কলটা তার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

অঞ্জলি পরীক্ষায় প্রথমই হয়েছিল। এরপর শিশুচিকিৎসায় এমডি করার সিদ্ধান্ত নেয়। ইন্টার্ন হিসেবে সে মুম্বাইয়ের উপকণ্ঠে পালঘরের একটা হাসপাতালে পোস্টিং পায়। সৌভাগ্যবশত, তার বন্ধু মুফিও একই হাসপাতালে পোস্টিং পেয়েছিল। পালঘর এত ছোট শহর ছিল যে আমাকে ফোন করার জন্য অঞ্জলির ২০ মিনিট দূরের বোইসারে ট্রেনে যেতে হতো এবং মুফি ছিল তার এই ভ্রমণের সঙ্গী।

এমডি পড়ার সময় অঞ্জলি ক্রিকেটের প্রতি কিছুটা আগ্রহী হতে শুরু করে। আমরা ফোনে খেলা নিয়ে কথা বলা শুরু করলাম। এমনকি সে ক্রিকেটের নিয়মকানুনের একটা বইও কিনেছিল। মাঝেমধ্যে সে প্রশ্ন করত, ‘কাউ কর্নার কোথায়?’ বা ‘উইকেটকিপার ডানহাতি না বাঁহাতি?’

তখন মোবাইল ফোন বা টেক্সট মেসেজ না থাকায়, অঞ্জলি আর আমি একে অন্যকে অনেক চিঠি লিখতাম।

খুব তাড়াতাড়ি সে খেলাটা শিখে ফেলল। টেলিভিশনে প্রথম যে টুর্নামেন্টটা ও দেখেছিল, সেটা ছিল ১৯৯২ বিশ্বকাপ। কার্টলি অ্যামব্রোসের বলে ক্যাচ দিয়ে আমি অল্প রানে আউট হয়ে যাওয়ার পর সে খুবই ভেঙে পড়ল। মুফি ওকে সান্ত্বনা দিল এই বলে যে অ্যামব্রোসের বলটা এত ভালো ছিল যে অন্য কেউ কাছেও ঘেঁষতে পারত না। আমি খুব ভালো ব্যাটসম্যান বলেই কোনোভাবে ক্যাচ দিয়েছি! যদি কথাটা সত্যি হতো!

তখন মোবাইল ফোন বা টেক্সট মেসেজ না থাকায়, অঞ্জলি আর আমি একে অন্যকে অনেক চিঠি লিখতাম। আমি ট্যুরে গেলে তো কোনো নির্দিষ্ট শহরে কয়েক দিনের বেশি থাকতাম না। অঞ্জলিকে তাই দুই-তিন সপ্তাহ পরে আমি কোথায় থাকব, সেটা অনুমান করে চিঠি পাঠাতে হতো। আমার চেয়ে ওর হাতের লেখা অনেক সুন্দর ছিল। আমি তো কী লিখব, কী লিখলে সে খুশি হবে, সেটা ভেবেই কূল পেতাম না।

১৯৯২ সালের মার্চে, বিশ্বকাপ থেকে ফিরে আমি প্রথমবার অঞ্জলিদের বাড়িতে যাই। মুফি সেবারও খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। অঞ্জলির বাবা-মাকে সে বলেছিল, ওটাই হবে আমাদের প্রথম দেখা এবং সেই এই সাক্ষাতের ব্যবস্থা করেছে। সে খুব সাবধানে প্ল্যানটা করেছিল। আমাদের কিছুটা অভিনয় করতে হয়েছিল। পরে আমরা যখন বাগ্‌দানের সিদ্ধান্ত নিই, তখন অঞ্জলির বাবা-মাকে আসল গল্পটা বলেছিলাম। মুফি সব সময় এত সাহায্য করেছে, ওর কাছে আমরা খুব কৃতজ্ঞ

আমরা সম্পর্কটা আর গোপন রাখতে চাইছিলাম না। মনে হলো, সময় এসেছে দুই পরিবারকে জানিয়ে দেওয়ার যে আমরা একে অন্যকে নিয়ে সত্যিই সিরিয়াস। আমি তাই আমার ছোটবেলার বন্ধু সুনীল হর্ষেকে অনুরোধ করলাম আমার বড় ভাই অজিতের সঙ্গে অঞ্জলির দেখা করিয়ে দেওয়ার জন্য। শেষ পর্যন্ত ওরা তিনজন সাউথ মুম্বাইয়ের উইলিংডন ক্লাবে দেখা করতে গেল। বাড়িতে বসে আমি অস্থির হয়ে অপেক্ষা করছি। ঠিক অজিতের অনুমোদনের জন্য বলা যাবে না, মনে মনে চাইছিলাম আমার বন্ধু এবং পরিবারও যেন অঞ্জলিকে আমার মতোই পছন্দ করে। আমার মনে হচ্ছিল, সময় যেন থেমে গেছে।

অবশেষে যখন সুনীল আর অজিত ফিরল, তখন দেখি সুনীল এক ধাপ পিছিয়ে হাঁটছে। পেছন থেকেই আমাকে একবার ‘থাম্বস আপ’ দেখিয়ে বুঝিয়ে দিল—এভরিথিং ফাইন। আমি খুশিতে যেন উড়ে যাচ্ছিলাম!

এদিকে অঞ্জলির ক্রিকেটে আগ্রহ বাড়ছিল। ১৯৯৪ সালে আমি যখন নিউজিল্যান্ড সফরে যাই, তখন সে ক্রিকেটের অনেক খুঁটিনাটি বিষয়ও ভালোভাবে বুঝতে শুরু করেছে। নিউজিল্যান্ড সফরের শেষে আমাদের সম্পর্কেরও চার বছর পূর্ণ হলো। মনে হলো, এবার সম্পর্কটাকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নেওয়ার সময় এসেছে। ওই সময়েই একদিন ফোনালাপের সময় অঞ্জলি এনগেজমেন্টের প্রসঙ্গ তোলে এবং আমি সঙ্গে সঙ্গেই রাজি হয়ে যাই।

আমি ওকে বলেছিলাম, আমি তো তৈরিই। তবে যদি ও আমার এবং ওর বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলে তাহলে ভালো হয়। কথা বলাটা আমার কখনোই বড় শক্তির জায়গা ছিল না।

শুরুতে অঞ্জলি একটু দ্বিধায় ছিল। তবে শেষ পর্যন্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও দায়িত্বটা গ্রহণ করে। পরে অঞ্জলি আমাকে বলেছিল, প্রথমে তারও একটু অস্বস্তি লেগেছিল আমার বাবা-মাকে গিয়ে এনগেজমেন্টের কথা বলতে। তবে আমার বাবা-মা আমাকে এতটাই ভালোভাবে চিনতেন যে বুঝে গিয়েছিলেন, কেন অঞ্জলিই দুজনের হয়ে কথা বলছে। তাঁরা সত্যিই আনন্দিত হয়েছিলেন।

একই ঘটনা ঘটেছিল এক বছর পরে, যখন আমাদের বিয়ের পরিকল্পনার কথাও অঞ্জলিই দুই পরিবারকে জানিয়েছিল। আসলে এসব ব্যাপারে অঞ্জলি আমার চেয়ে অনেক দক্ষ। ওর হাতে দায়িত্বটা ছেড়ে দিয়ে আমি হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছিলাম।
আমাদের বাগ্‌দান হলো ২৪ এপ্রিল, ১৯৯৪ সালে। আমার ২১তম জন্মদিন ছিল সেটা। এর প্রায় এক বছর পর ১৯৯৫ সালের ২৫ মে আমরা ভালোবাসার বন্ধনে চিরদিনের জন্য আবদ্ধ হলাম।

পাঠকের জন্য তথ্য: 

আসছে ২৫ মে টেন্ডুলকার-অঞ্জলির ৩০তম বিবাহবার্ষিকী। বিয়ের পর সংসার সামলানোর জন্য অঞ্জলি নিজের ডাক্তারি ক্যারিয়ার বিসর্জন দিয়েছেন। এই দম্পতির দুই সন্তান। কন্যা সারা টেন্ডুলকারের জন্ম ১৯৯৭ সালে, পুত্র অর্জুনের বয়স এখন ২৫। ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন থেকে বায়োমেডিকেল সায়েন্সে স্নাতক সারা টুকটাক মডেলিং করেছেন, কাজ করেন পুষ্টিবিদ হিসেবেও। অর্জুন টেন্ডুলকার বাবার মতোই ক্রিকেট বেছে নিয়েছেন, তবে বাবার মতো বড় ক্রিকেটার হতে পারেননি। মূলত বাঁহাতি পেসার অর্জুন রঞ্জিতে মুম্বাইয়ের হয়ে খেলেছেন, আইপিএলে মুম্বাই ইন্ডিয়ানসের হয়ে। ভারত দলে এখনো ডাক পাননি, পাওয়ার মতো কিছু আসলে এখনো করতেও পারেননি।