Image description

বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) দেশের ক্রিকেটের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থা। দেশের খেলার মান, খেলোয়াড়ের কল্যাণ এবং ক্রিকেট সংক্রান্ত প্রশাসনিক দিকগুলো নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্ব এ সংস্থার। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশ্যে এসেছে বিসিবি কর্মকর্তাদের নানা অনৈতিক কর্মকাণ্ড। বিশেষ করে নারীদের সঙ্গে আপত্তিকর সম্পর্ক, শারীরিক ও মানসিক শোষণ এবং ক্ষমতার অপব্যবহারজনিত কেলেংকারির তথ্য উঠে এসেছে একে একে।

বিসিবি ভেতরের সূত্রগুলো বলছে, কর্মকর্তারা প্রভাবশালী অবস্থার সুযোগ নিয়ে নতুন ও তরুণ নারী কর্মকর্তা, সংবাদকর্মী, কোচ ও অন্যান্য স্টাফদেরকে বিভিন্ন প্রকার অনৈতিক চাপ সৃষ্টি করছেন। অনেকেই ভয়ে মুখ খুলতে পারছেন না। তবে গণমাধ্যমে একের পর এক অভিযোগ উঠে আসায় বিষয়টি প্রকাশের পথে এসেছে।

প্রতারণা ও ক্ষমতার অপব্যবহার
তথ্য অনুসারে, বিসিবির কর্মকর্তারা প্রভাবশালী পদ ব্যবহার করে নারী স্টাফদের সঙ্গে আপত্তিকর সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করছেন। অভিযোগ রয়েছে যে, অফিসের ফাইল, সুযোগ-সুবিধা বা পদোন্নতির বিনিময়ে কিছু কর্মকর্তারা নারীদেরকে মানসিক ও শারীরিকভাবে হেনস্তা করছেন। একাধিক সূত্রে জানা গেছে, যারা রাজি হননি, তাদেরকে বিভিন্নভাবে ভয় দেখানো হয়েছে।

এক প্রাক্তন কর্মকর্তা জানান, “বিসিবি অফিসের বেশিরভাগ ঘটনায় কেউ মুখ খুলতে সাহস পায় না। নারীদের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের কাছ থেকে সুরক্ষা নেই। কেউ যদি অভিযোগ করে, তার ক্যারিয়ার ক্ষতিগ্রস্ত হয়।”

প্রকাশিত তথ্য ও অভিযোগ
গত কয়েক মাসে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা প্রকাশ পেয়েছে, যেখানে নারীদের সঙ্গে অশালীন আচরণের প্রমাণ রয়েছে। প্রথমটি ছিল, একটি নারী সাংবাদিকের অভিযোগ, যিনি সংবাদ সংগ্রহের সময় কর্মকর্তা মো. এফরানুল হক তার সঙ্গে আপত্তিকর আচরণ করেছিলেন। তিনি বলেন, “আমি শুধু সাংবাদিক হিসেবে বিষয়টি অনুসন্ধান করছিলাম, কিন্তু মো. এফরানুল হক বারবার ব্যক্তিগতভাবে আমাকে হুমকি ও অনাকাক্সিক্ষত বার্তা পাঠাতেন।”

দ্বিতীয় ঘটনাটি অন্তর্ভুক্ত করেছে নারী খেলোয়াড়দের ওপর চাপে রাখা। অভিযোগ অনুযায়ী, ক্রীড়াবিদরা তাদের প্রতিযোগিতা বা দলভিত্তিক সুযোগ সুবিধার বিনিময়ে অনৈতিক প্রস্তাব পেতেন। “আমরা জানতাম, রাজি না হলে আমাদের খেলার সুযোগ সীমিত হতে পারে। ভয়ে অনেকেই কিছু বলেনি,” এক ক্রীড়াবিদা বলেন।

তৃতীয় ঘটনা ছিল, এক উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে, যিনি নতুন নারী কর্মকর্তাদের প্রভাবিত করার জন্য অফিসিয়াল মিটিংয়ে বারবার আপত্তিকর আচরণ করেছেন। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, এমন আচরণের অনেক ভিডিও এবং চ্যাট লগও রয়েছে।

বিসিবির অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি
বিসিবি অভ্যন্তরীণ নীতিমালা অনুযায়ী, কর্মচারীদের সঙ্গে যে কোনো ধরণের অনৈতিক আচরণ কঠোরভাবে দমন করা হয়। কিন্তু অভিযোগ অনুসারে, এই নীতিমালার যথাযথ বাস্তবায়ন হয়নি। উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরুর ক্ষেত্রে দেরি করা হয়। অনেক সময় অভিযোগকারীদের চাপের মুখে চুপ থাকতে হয়।

এক প্রাক্তন স্টাফ বলেন, “আমাদের কাছে অভিযোগ গোপন রাখার চাপ দেওয়া হত। কেউ মুখ খুললে, পদোন্নতি বা বোনাস পেতে পারত না। এমনকি চাকরিচ্যুত হওয়ারও আশঙ্কা থাকত।”

কেলেংকারি ইস্যুতে সরব নারী ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন
দেশের ক্রীড়াঙ্গনে আলোচনার তুঙ্গে নারী ক্রিকেট। বাংলাদেশ জাতীয় নারী ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক ও পেসার জাহানারা আলমের যৌন হয়রানির অভিযোগে টালমাটাল চারপাশ। এবার নারী ক্রিকেটে নিরাপদ পরিবেশ ও ন্যায়বিচার নিশ্চিতের আহ্বান জানালেন নারী ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিনিধি সাথিরা জাকির জেসি।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নিজের ব্যক্তিগত আইডিতে এক পোস্টে জেসি লিখেন, 'আমরা, বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন, গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছি- নারী ক্রিকেটে যৌন হয়রানির অভিযোগ নিয়ে সাম্প্রতিক আলোচনাগুলো। বিশেষ করে জাহানারা আলমকে ঘিরে যে বিষয়টি উঠে এসেছে, তা পুরো নারী ক্রিকেট ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অংশগ্রহণকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে।'

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) নিকট কয়েকটি দাবি জানিয়েছে নারী ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো- এ বিষয়ে দ্রুত, নিরপেক্ষ ও ভিকটিম-কেন্দ্রিক তদন্ত, নারী সদস্য ও সেফগার্ডিং বিশেষজ্ঞসহ স্বাধীন তদন্ত কমিটি, বাধ্যতামূলক অ্যান্টি-হ্যারাসমেন্ট ও জেন্ডার-সেন্সিটাইজেশন প্রশিক্ষণ এবং তদন্তের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা।

সামাজিক ও মানসিক প্রভাব
নারীদের ওপর এই ধরনের কেলেংকারি শুধু ব্যক্তিগত নয়, সামাজিকভাবে প্রভাব ফেলে। যারা মুখ খোলেন, তারা মানসিক চাপ ও সামাজিক কলঙ্কের শিকার হন। এক নারী কর্মকর্তা বলেন, “আমি নিজের পরিবারকে বিষয়টি জানাইনি। ভয়ে, এ নিয়ে কিছু বলার সাহস নেই।”

অভিভাবকরাসহ অনেকেই বলছেন, অফিসের ক্ষমতার অপব্যবহার ও শোষণ নারীদের আত্মসম্মানহানি, মানসিক চাপ এবং পেশাগত হতাশা তৈরি করে। “যেসব প্রতিষ্ঠান এই ধরনের কেলেংকারি প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয় না, সেগুলোতে আরও গুরুতর মানসিক ও সামাজিক সমস্যা দেখা দেয়।

প্রতিক্রিয়া ও পদক্ষেপ
বিসিবির কর্মকর্তাদের অনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে সংবাদ প্রকাশের পর, বিসিবি প্রধান ও কর্মকর্তারা মোলায়েম ভাষায় নিন্দা জানিয়েছেন। তবে কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যায়নি। বোর্ডের এক কর্মকর্তার ভাষ্য, “আমরা বিষয়টি গুরুত্বসহকারে দেখছি। তবে সঠিক প্রমাণ না পাওয়া পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না।”

স্থানীয় সাংবাদিকরা বলছেন, “এই ধরনের অভিযোগগুলো প্রকাশিত হওয়ার পরও দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ দমনের চেষ্টা করছে। সাংবাদিকদের চাপ দেয়া হচ্ছে বিষয়টি প্রকাশ না করতে।”

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও সতর্কতা
সংবাদমাধ্যমের পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, এখন বিসিবিতে কিছু নারী কর্মকর্তারা অজ্ঞাতনামা অভিযোগ দিচ্ছেন, যাতে তাদের নাম প্রকাশ না হয়। তারা চাইছেন, বিষয়টি স্বাধীন তদন্তের মাধ্যমে সমাধান হোক

সাইবার আইনি বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলছেন, অনৈতিক আচরণ বা নারীদের শোষণ আইনগতভাবে অপরাধ। যারা এমন কর্মকাণ্ডে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে।

বিসিবি কর্মকর্তাদের নারী কেলেংকারি এবং দুর্নীতি শুধু ব্যক্তিগত নয়, এটি প্রতিষ্ঠানের নৈতিকতা ও দেশের ক্রীড়াঙ্গনের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। একের পর এক অভিযোগ প্রকাশিত হলেও কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে, ভবিষ্যতে আরও গুরুতর পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বিসিবির উচিত একটি স্বতন্ত্র তদন্ত কমিটি গঠন করা, যেখানে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সাথে নারীদের অভিযোগের বিষয়গুলো স্বাধীনভাবে যাচাই করা হবে। এছাড়া সচেতনতা বৃদ্ধি, প্রশিক্ষণ ও নীতিমালা কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।

একটি প্রতিষ্ঠানের স্বাস্থ্য ও নৈতিকতার মান নির্ভর করে তার কর্মকর্তাদের আচরণে। বিসিবি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নারীদের সঙ্গে কেলেংকারি ও দুর্নীতির অভিযোগ প্রকাশ হওয়া দেশের ক্রিকেট ও সমাজের জন্য আশঙ্কাজনক সংকেত। সময় এসেছে, বিষয়টি গোপন না রেখে স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও কার্যকর তদন্তের মাধ্যমে সমাধান করা হোক। নাহলে শুধু ব্যক্তিগত ক্ষতি নয়, বিসিবি ও দেশের ক্রীড়াঙ্গনও দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
শীর্ষনিউজ