বাংলাদেশ রাজনীতিতে গণতন্ত্র ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে আপোষহীনতার আইকন বেগম খালেদা জিয়ার জীবনাবসান; শোকের চাদরে ঢেকে দিয়েছে জনমানুষের মানচিত্র।
তার জীবন রাজনৈতিক সংগ্রামশীলতার এক উজ্জ্বল ক্যানভাস যেন। তার স্বামী রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ১৯৮১ সালে আততায়ীর হাতে নিহত হলে; বেশ অল্প বয়সে বৈধব্য নেমে আসে তার জীবনে। ব্যক্তিগত শোকে জীবনকে সীমাবদ্ধ না রেখে বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও সার্বভৌমত্ব পুনরুদ্ধারে তিনি রাজপথে নেমে আসেন। স্বৈরাচারি শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের বিরুদ্ধে গণ-অভ্যুত্থানে সফল নেতৃত্ব দেন তিনি।
১৯৭৫ সালে আততায়ীর হাতে নিহত বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনা ভারতে ছয় বছর কাটিয়ে দেশে ফিরে প্রথমে এরশাদের সঙ্গে আপোষ করলেও পরে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে যোগ দেন। ভারতের আশীর্বাদ নিয়ে সাংস্কৃতিক উপনিবেশ গড়ার কাজে মন দেন। এ কারণেই সাংস্কৃতিক ও ভৌগলিক সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে খালেদা জিয়া হয়ে ওঠেন জনমানুষের নিরাপোষ ঠিকানা।
এরশাদ পতনের পর ১৯৯১ সালে জনপ্রিয় ভোটে প্রধানমন্ত্রী হন খালেদা। রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পায় তার নেতৃত্বধীন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। বাংলাদেশের জনসংখ্যার অর্ধেকই নারী। খালেদা তাই নারী শিক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ নেন। অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত বিনাখরচে শিক্ষা ও শিক্ষাবৃত্তির মাধ্যমে কন্যাশিশুদের জন্য বিনির্মাণ করেন এক উজ্জ্বল ভবিষ্যত। বাংলাদেশের যে গার্মেন্টস শিল্প আজ দক্ষিণ এশিয়ায় একটি মডেল হিসেবে দৃশ্যমান; খালেদা এই শিল্প বিকাশের কথা প্রথম ভেবেছিলেন। গার্মেন্টস শিল্প নারী শ্রমিকদের জন্য কর্মসংস্থান তৈরি করলে অর্থনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ সুচিহ্নিত হয়।
ভারত সমর্থিত শেখ হাসিনার মধ্যে এই ধারণা দেয়া হয়েছিলো যে, যেহেতু তার পিতা বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি; সুতরাং বাংলাদেশ তার বাবার দেশ। ফলে তিনি ও তার পছন্দের সাংস্কৃতিক বলয় প্রতিদিন খালেদা জিয়ার শাসনামলের বিরুদ্ধে বয়ান তৈরি করতে থাকে। এই বয়ান শিফন শাড়ি পরা আধুনিকা প্রিয়দর্শিনী খালেদা জিয়াকে 'ইসলামপন্থী"-র তকমা দিতে থাকে। অথচ জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে খালেদার বিরুদ্ধে রাজনীতি করছিলেন শেখ হাসিনা।
ভারতের হিন্দুত্ববাদী মানসে যে ইসলাম বিদ্বেষ; খালেদা সেই প্রতিহিংসার টার্গেট হয়েছেন তার পুরো রাজনৈতিক জীবনে। হাসিনার কালচারাল উইং ফিফটি শেডস অফ ডিফেমেশন ফেরি করে ১৯৯৬ সালে তাকে ক্ষমতায় আনে। তার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেলে; ভারতের ছায়া উপনিবেশ গড়ার একুশ বছরের অপেক্ষার অবসান ঘটে। বাংলাদেশে তাদের মনপছন্দ মিডিয়া ও সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে ওঠে হিন্দুত্ববাদকেই প্রগতিশীলতা হিসেবে প্রতিপন্ন করতে।
বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বপ্রিয় জনগণ ২০০১ সালের নির্বাচনে ভূমিধস বিজয় উপহার দেয় খালেদা জিয়াকে। শেখ হাসিনা ১৯৮৬ সালে আর ৯১ থেকে ৯৬ পর্যন্ত জামায়াতের পার্টনারশিপে রাজনীতি করেছেন; কিন্তু ২০০১-এ খালেদার ইলেকশন কোয়ালিশনে জামায়াত থাকায় গেলো গেলো রব তোলে হাসিনার কালচারাল উইং। ভারতের মিডিয়া সক্রিয় হয় খালেদাকে উগ্র ইসলামপন্থী হিসেবে রাঙ্গিয়ে দিতে। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে ধর্মকে ব্যবহার করতে হাসিনা হজ্জ্ব করে ফিরে মাথায় কালো ফেটি বেঁধে নিজেকে ইসলামের সেবক হিসেবে চিত্রায়িত করেন। অথচ খালেদা জিয়া কখনোই ধর্ম প্রদর্শনে যাননি। তিনি তার ফ্যাশান ও লাইফস্টাইলের ব্যাপারেও সতত আপোষহীন থেকেছেন।
ভারতের প্রয়াত রাজনীতিক প্রণব মুখার্জি তার আত্মজৈবনিক কোয়ালিশন ইয়ারস গ্রন্থে লিখেছেন, কিভাবে তিনি ২০০৭-৮ সালে বাংলাদেশের সেনাসমর্থিত ওয়ান ইলেভেন সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করে শেখ হাসিনাকে রাষ্ট্রক্ষমতায় আনেন। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসেই শেখ হাসিনা তার ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে খালেদা জিয়া ও তার রাজনৈতিক দলের ওপর দমন পীড়ন শুরু করেন। ২০০৯ সালে পিলখানা হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে সেনাবাহিনীর প্রতিশ্রুতিশীল কর্মকর্তাদের হত্যা করা হয়। এতে প্রতিবেশী দেশের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ সাম্প্রতিক এক তদন্ত রিপোর্টে প্রকাশিত হয়েছে।
ভারতের ছায়া উপনিবেশ বাংলাদেশের সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দাসংস্থায় প্রভাব বলয় তৈরি করলে; খালেদাকে ছলেবলেকৌশলে দূরে রেখে ২০১৪, ২০১৮, ২০২৪ সালের তিনটি একপেশে নির্বাচনের মাধ্যমে হাসিনা একদলীয় শাসন ব্যবস্থা সূচিত করেন। খালেদা জিয়াকে তার নিজস্ব বাসভবন থেকে উচ্ছেদ, গোয়েন্দা সংস্থা, মিডিয়া ও কালচারাল উইং-এর বর্ণনা অযোগ্য ডিফেমেশন, তার প্রয়াত স্বামী মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমানকে 'পাকিস্তানের চর' বলে তকমা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের কৃতিত্বকে হাসিনার পৈতৃক সম্পত্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার পাশাপাশি সাজানো মামলায় খালেদাকে কারাগারে পাঠানোর নৈরাজ্য চলতে থাকে। ভারত ও হাসিনার যৌথ প্রকল্প হিসেবে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ইসলামপন্থী সন্ত্রাসী তকমা দিয়ে চলে গুম, খুন, ক্রসফায়ার, কারাগার ও ইন্টেরোগেশন সেল "আয়নাঘর"-এর নিপীড়ন। এরকম ভীতিপ্রদ ফ্যাসিস্ট শাসন ও সার্বভৌমত্বহীন পরিবেশে পুরো রাষ্ট্র যখন "প্যালেস্টাইন ল্যাবরেটরি"-র মতো ধুঁকছে; খালেদা জিয়া তখন বলেন, বাংলাদেশ আমার একমাত্র ঠিকানা। তিনি সার্বভৌমত্ব ফিরে পেতে আকুল আহবান জানান, টেক ব্যাক বাংলাদেশ।
২০২৪ -এর জুলাই বিপ্লবে হঠাত আলোর ঝলকানির মতো উপস্থিত হয় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের তরুণ মুক্তি নায়কেরা। বাংলাদেশকে ফ্যাসিস্ট মুক্ত করতে আর এর সার্বভৌমত্ব পুনরুদ্ধারে ছাত্র-জনতার রক্ত-ত্যাগ আর অসম সাহসিকতায় সার্বভৌমত্ববিরোধী শক্তি হাসিনা ও তার মানবতাবিরোধী অপরাধের দোসরেরা ভারত পালিয়ে গেলে; দীর্ঘ নির্যাতন ও নিপীড়নে অসুস্থ আপোষহীন নেত্রী জুলাই বিপ্লবী তরুণদের সঙ্গে মুক্তির হাসি হাসেন। সশস্ত্র বাহিনী দিবসে সার্বভৌমত্বের মা খালেদাকে ঘিরে শপথ নেয় নতুন প্রজন্ম; একটি গণতান্ত্রিক আর স্বকীয় সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয়ের বাংলাদেশের।
সম্প্রতি আগ্রাসনবিরোধী সাংস্কৃতিক আন্দোলনের নেতা ওসমান হাদি আততায়ীর হাতে নিহত হয়েছে। প্রতিবেশী দেশে বসে তাকে হত্যা পরিকল্পনা করা হয়েছে , তার নিহত হবার খবরে হিন্দুত্ববাদীদের উল্লাস সোশ্যাল মিডিয়ায় দৃষ্টিগোচর হয়েছে। ভারতের মিডিয়া নিহত হবার পরেও হাদিকে উগ্র ইসলামপন্থী বলে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। এই পুনরাবৃত্তিকর বয়ানের বিরুদ্ধে তরুণেরা আবার সংগঠিত হয়েছে। ঢাকার প্রাণকেন্দ্র হাদি চত্বরে লাগাতার বিক্ষোভ চলছে এই ইন্ডিয়ান হেজিমনির বিরুদ্ধে।
এরকম লড়াইয়ের সময়, বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের মা খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে থমকে গেছে কোলাহল। কিন্তু খালেদার মৃত্যু থেমে থাকা নয়; গণতন্ত্র, সার্বভৌমত্ব ও সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠার মাঝেই রয়েছে এই আপোষহীন নেত্রীকে সম্মান জানানোর শ্রেষ্ঠ উপায়।
-মাসকাওয়াথ আহসান
সাংবাদিক, লেখক ও শিক্ষক