কঠিন এক সময়ে বিএনপির হাল ধরেছিলেন খালেদা জিয়া। ১৯৮১ সালে স্বামী সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর সৃষ্ট পরিস্থিতি তাকে দৃশ্যপটের বাইরে থেকে একবারে রাজনীতির ‘হাইওয়ে’তে নিয়ে আসে। নিতান্তই একজন গৃহবধূ ছিলেন খালেদা জিয়া। রাজনীতির চৌকাঠ মাড়াতে হবে কোনোদিন, সে কথা হয়ত কল্পনাতেও ছিল না।
প্রেসিডেন্ট জিয়ার মৃত্যুর পর বিচারপতি আব্দুস সাত্তার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। এক পর্যায়ে সাত্তারকে অপসারণ করে ক্ষমতা দখল করেন তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। দলে তখন কোন্দল, ভাঙনের সুর তুঙ্গে। বিএনপির সিনিয়র নেতাদের কেউ কেউ এরশাদের পক্ষে ভিড়লে পরিস্থিতি আরও কঠিন হয়।
ছত্রভঙ্গ, বিপর্যস্ত এবং দিশেহারা বিএনপি তখন নেতৃত্ব শূন্যতায় হারিয়ে যাওয়ার দ্বারপ্রান্তে। দল টিকিয়ে রাখার প্রয়োজনে তৎকালীন বিএনপির সিনিয়র কিছু নেতার অনুরোধে ১৯৮২ সালের জানুয়ারি মাসে রাজনীতিতে পা রাখেন খালেদা জিয়া।
বিএনপি নিয়ে গবেষণাধর্মী বইয়ের লেখক মহিউদ্দিন আহমেদ একবার বলেছিলেন, জিয়াউর রহমান ক্ষমতার বলয়ের ভেতরে থেকে দল তৈরি করেছেন। কিন্তু পরবর্তীতে খালেদা জিয়া সে দলকে রাজনৈতিকভাবে এগিয়ে নেন।
তার ভাষায়, ‘সেভাবে এটি রাজনৈতিক দল ছিল না, যেভাবে রাজনৈতিক দল তৈরি হয় আমাদের দেশে। বিএনপির রাজনৈতিক দল হিসেবে গড়ে উঠা এরশাদ-বিরোধী আন্দোলনের সময় খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে। আজকে আমরা যে বিএনপি দেখি, যদিও সেটার আইকন জিয়াউর রহমান কিন্তু দলটাকে এ পর্যায়ে এনেছেন খালেদা জিয়া।’
এরশাদ-বিরোধী আন্দোলনে রাজপথে সক্রিয় ছিলেন খালেদা জিয়া। এই আন্দোলন তাকে যেমন দেশব্যাপী পরিচিত এনে দেয়, তেমনি রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপিও আন্দোলন-সংগ্রামের আঁচে সিদ্ধ হয়। তার সংগ্রামী নেতৃত্বে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিশ্বাস জন্মায়, বিএনপি-ই হয়ত দেশকে সঠিক পথে ফেরাতে পারবে। গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রায় নেতৃত্ব দিতে পারবে খালেদা জিয়ার বিএনপি।
এই বিশ্বাসের স্মারক হয়ে থেকেছে এরশাদ পতনের পর ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন। বিএনপি তাতে বিপুল জনসমর্থন নিয়ে জয়লাভ করেন। রাজনীতিতে আসার এক দশকের মধ্যেই সরকারপ্রধান হন খালেদা জিয়া।
হঠাৎ করেই রাজনীতিতে উত্থান এবং প্রথমবার নির্বাচনে অংশ নিয়েই বিপুল বিজয়–রাজনীতির ময়দানে কিছুটা অনভিজ্ঞ হলেও খালেদা সিদ্ধহস্তে সব দায়িত্ব সামলেছেন। তার নেতৃত্বাধীন প্রথম সরকার ১৯৯১-৯৬ পর্যন্ত নির্ঝঞ্ঝাটেই রাষ্ট্রক্ষমতা সামলায়। সে আমলে দুর্নীতি খুব একটা বিস্তার লাভ করেনি বলেই মত পর্যবেক্ষকদের।
এছাড়া প্রথম মেয়াদে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে খালেদা জিয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন বলে মনে করেন আমেরিকার পাবলিক ইউনিভার্সিটি সিস্টেমের শিক্ষক ড. সাঈদ ইফতেখার আহমেদ। তার মতে, ‘বাংলাদেশ হচ্ছে অত্যন্ত রক্ষণশীল একটি রাষ্ট্র। সেই রক্ষণশীল রাষ্ট্রে তিনি প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হন। নারীদেরকে ঘিরে যে কিছু প্রচলিত সংস্কার ছিল, সে সংস্কারের ব্যারিয়ারগুলো উনি ভেঙে ফেলেছেন। বাংলাদেশের নারীর অগ্রযাত্রায় ওনার একটা বড় ভূমিকা রয়েছে বলে আমার সবসময় মনে হয়।’
তবে ২০০১-০৬ মেয়াদে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জোটভুক্ত হওয়ার বিষয়টি বিশ্লেষকদের মতে রাজনীতিতে খালেদা জিয়াকে কিছুটা ‘ব্যাকফুটে’ ঠেলে দেয়। ড. সাঈদ ইফতেখারের ভাষায়, ‘উনাকে যেন ক্রমশই আপস করতে দেখা গেছে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে। মৌলবাদী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে অতিমাত্রায় যোগাযোগ এবং আপোষের ফলে আন্তর্জাতিক যে মহল - প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্য - এ দুই জায়গা থেকে তিনি নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেন।’
খালেদা জিয়ার জীবন নিয়ে বই প্রকাশ করেছেন সাংবাদিক মাহফুজ উল্লাহ। গণতন্ত্রের প্রতি খালেদা জিয়ার অবিচল আস্থা এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে তার ক্যারিশমার ব্যাপক প্রশংসা ঝরেছে তার কণ্ঠে। কিন্তু খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবনের কিছু সিদ্ধান্ত তার মনে প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। মাহফুজ উল্লাহ বলেন, ১৯৯৬ সালে যখন আওয়ামী লীগ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি তুলেছিল তখন খালেদা জিয়ার উচিত ছিল সংসদ ভেঙে দিয়ে আগাম নির্বাচন দেয়া। এতে করে বিএনপি আরো বেশি জনপ্রিয়তা নিয়ে ক্ষমতায় ফিরে আসতো বলে তিনি মনে করেন।
২০০১-০৬ মেয়াদে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের অংশ বনে যাওয়া কিছু লোকের অপকর্মের দায় খালেদা জিয়ার ওপর পড়েছে উল্লেখ করে মাহফুজ উল্লাহ যোগ করেন, ‘এই সময়টিতে কিছু কিছু দুষ্টু লোক শাসন পদ্ধতিতে ঢুকে কিছু কিছু কাজকর্ম করেছে যেটার দায় গিয়ে তার ওপর পড়েছে। বিষয়টা তাই হয়। সে সময় যদি তিনি সরকারকে সুশাসনের পথে আরো আনতে পারতেন দৃঢ়তার সঙ্গে, তাহলে পরবর্তী পর্যায়ে যে ঘটনাগুলো ঘটেছে, সেগুলো ঐভাবে ঘটতো না।’
২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় থাকার সময় দলের সিনিয়র অনেক নেতার সঙ্গে খালেদা জিয়ার দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। রাষ্ট্রপতির পদ থেকে বিদায় নিতে হয়েছিল অধ্যাপক একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে। দল ছেড়ে গিয়েছিলেন খালেদা জিয়াকে রাজনীতিতে আনার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখা অলি আহমদ। এদিকে ২০০৭ সালে সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসার পর খালেদা জিয়া গ্রেপ্তার হওয়ার আগে তৎকালীন মহাসচিব আব্দুল মান্নান ভুঁইয়াকে দল থেকে বহিষ্কার করেন।
তবে রাজনীতিতে খালেদা জিয়ার সাফল্যের ঝুলি যে বেশ সমৃদ্ধ, তার প্রমাণ মেলে গেল ১৭ বছর স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগের আমলে। একের পর এক মিথ্যা মামলা, পরিবারের সদস্যদের হয়রানি, জেল-জুলুম, নির্যাতন–খালেদা জিয়াকে কাবু করতে, তার সম্মানহানি করতে কী না করেছে শেখ হাসিনা সরকার। কিন্তু এতকিছুর পরও খালেদা জিয়ার জনপ্রিয়তায় বিন্দুমাত্র আঁচ পড়েনি। উল্টো তার লড়াকু মানসিকতা আর জেলে থেকেও ক্যারিশমাটিক নেতৃত্বে বহুগুণে বেড়েছে তার গ্রহণযোগ্যতা।
অনেক প্রতিকূলতার মধ্যেও দলের সিনিয়র নেতাদের গাইড করেছেন, ছেলে তারেক রহমানকে বিএনপির নেতৃত্বের জন্য তৈরি করেছেন খালেদা জিয়া। অনেক প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বিএনপিকে সাংগঠনিকভাবে সুদৃঢ় রেখেছেন। যার ফলে চব্বিশের ৫ আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিএনপি দ্রুতই নির্বাচনমুখী একটি দল হিসেবে নিজেদের উপস্থাপন করতে পেরেছে। আর এসবই সম্ভব হয়েছে খালেদা জিয়ার সুযোগ্য ও দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণে। তাই দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে কিছু ‘আক্ষেপ’ সঙ্গী হলেও দিনশেষে রাজনীতিবিদ খালেদা জিয়ার জীবন সাফল্য, অনুপ্রেরণা আর সাহসের গল্প।