বিএনপি সারাদেশে যে ২৩৬টি আসনে প্রার্থী ঘোষণা করেছে তার মধ্যে ‘অন্যতম কনিষ্ঠ’ শেরপুর-১ আসনের সানসিলা জেবরিন প্রিয়াঙ্কা রয়েছেন। ৩২ বছর বয়সী এই চিকিৎসক ২০১৮ সালের নির্বাচনেও ধানের শীষের প্রার্থী হিসেবে লড়েছিলেন।
এবারও দল তার উপর ভরসা রেখেছে। তিনি দিনরাত এক করে বিশাল কর্মীবাহিনী নিয়ে ভোটের মাঠ দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। তরুণ এই নেতা অন্তরিকতা, প্রতিশ্রুতি আর উন্নয়নের বার্তা দিয়ে মানুষের মন জয়ের চেষ্টা করছেন।
কিন্তু তার লড়াইয়ের পথে খুব সম্ভবত ‘বড় বাধা’ আসতে চলেছে নিজের দলের মধ্যে থেকেই। প্রিয়াঙ্কার পাশাপাশি বিএনপির মনোনয়ন চেয়েছিলেন জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক শফিকুর ইসলাম মাসুদ। মনোনয়ন ঘোষণার আগ থেকেই তিনি তার সমর্থকদের নিয়ে মাঠ সরব ছিলেন। মনোনয়ন বঞ্চিত হওয়ার পরও তিনি ‘টানেলের শেষ প্রান্তে আলোর আশায়’ মাঠে দৌড়াচ্ছেন। তার ও সমর্থকদের আশা, শেষ মুহূর্তে হয়ত বিএনপি এই আসনে মনোনয়নের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করবে। নাহলে মাসুদ স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার কথাও বলছেন নিজের কর্মী-সমর্থকদের।
বিভিন্ন সময় বিএনপি এই আসনটি জোট শরিফ জামায়াতেহ ইসলামীর প্রার্থীকে ছেড়ে দিয়েছে। এই আসন থেকে একাধিকবার জোটের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেছেন একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের দায়ে দণ্ডিত জামায়াতে ইসলামীর সাবেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামান। তিনি ২০০১ ও ২০০৮ সালের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে দ্বিতীয় স্থানে ছিলেন।
এবার এই আসনে কামারুজ্জামানের ছেলে হাসান ইমাম ওয়াফি আমার বাংলাদেশ পার্টি (এবি পার্টি) থেকে নির্বাচন করবেন বলে কর্মী-সমর্থকরা বলছেন। তিনি মাঝে মধ্যে প্রচারও চালাচ্ছেন।
আর জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী হিসেবে মাঠে রয়েছেন ইসলামী ছাত্র শিবিরের সাবেক সভাপতি হাফেজ মাওলানা রাশেদুল ইসলাম। তিনি জামায়াতের ‘ভোট ব্যাংক’ অক্ষুন্ন রাখার জন্য কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে দিনরাত গণসংযোগ ও প্রচারকাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।
এমন একটি পরিস্থিতিতে নিজ দলের ‘বিদ্রোহ’ আর সাবেক শরিক দলের ‘দূরে সরে যাওয়ার’ বিষয়টি বিএনপির প্রার্থী প্রিয়াঙ্কার নির্বাচনি লড়াইয়ে বড় ধরনের প্রভাব রাখবে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
এ ছাড়া সদর উপজেলা নিয়ে গঠিত এই আসনে ভোটের জন্য প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন এনসিপির জেলার প্রধান সমন্বয়কারী প্রকৌশলী মো. লিখন মিয়া, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের জেলা সভাপতি মাওলানা শফিকুল ইসলাম, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের জেলা সভাপতি হাফেজ মাওলানা ফারুক আহমদ, খেলাফত মজলিসের জেলা সভাপতি মাওলানা আব্দুল হালিম।
গণঅধিকার পরিষদ এখনও তাদের প্রার্থী ঘোষণা করেনি। তবে এই দল থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশা করে প্রচারে রয়েছেন জেলার আহ্বায়ক আরিফ আহমেদ ও জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক এস এম শহিদুল ইসলাম সোহাগ। জাকের পার্টি থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশী দলের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক সম্পাদক ও জাকের পার্টি স্বেচ্ছাসেবক ফ্রন্টের জেলা সভাপতি আহসানুল হক আকন্দ রকি।
এ ছাড়া এই আসনে জাতীয় পার্টির সাংগঠনিক ‘ভিত্তি’ থাকলেও এখনও নির্বাচনের জন্য দলটির নেতাকর্মীদের বিশেষ তোড়জোড় চোখে পড়ছে না। বিশেষ করে সবশেষ দলের ভাঙনের পর সক্রিয় নেতাকর্মীদের অনেকেই নিরব হয়ে গেছেন।
তবে জেলা জাতীয় পার্টির সাবেক সভাপতি, সদর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ইলিয়াস উদ্দিন ব্যক্তিগতভাবে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি সবশেষ জি এম কাদেরের সঙ্গে ছিলেন। কিন্তু ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে ‘দলের ভাগাভাগি’ এড়াতে তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে পারেন বলে তার কর্মী-সমর্থকরা মনে করছেন।
শহরের একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলছিলেন, এই আসনে নব্বইয়ের পর থেকে বেশির ভাগ সময় আওয়ামী লীগ জয়লাভ করেছে। বিএনপি, জাতীয় পার্টিও জিতেছে। কিন্তু এবার মাঠে আওয়ামী লীগে নেই। ৫ অগাস্টের পর আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা প্রায় এলাকাছাড়া। ফলে ভোটের মাঠে এবারের সমীকরণ অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে ভিন্ন।
তিনি বলেন, আগে ভোটের মাঠের সমীকরণ ছিল- আওয়ামী লীগ বনাম বিএনপি-জামায়াত জোটের বিন্যাস নিয়ে। দুপক্ষের জয়-পরাজয়ের ব্যবধান খুব বেশি হত না। অন্তত যদি ২০০১ এবং ২০০৮ সালের নির্বাচনের ভোটের হিসাব সামনে রাখা হয়।
এখন আওয়ামী লীগ ভোট না করলেও দলটির উল্লেখযোগ্য ভোটার রয়েছে। সেই ভোট কোনদিকে যাবে- সেটা ভোটের ‘ফ্যাক্টর’ হিসেবে কাজ করতে পারে। আগে যারা এক পক্ষে থেকে ভোট করেছেন, এবার তারা বহুধা বিভক্ত হয়েছেন। ফলে সব রাজনৈতিক দল যদি এখানে ভোটে নামে, তাহলে অনেক প্রার্থী হবেন এবং এই আসনে ভোট জমে উঠতে পারে বলে মনে ওই রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
তিনি বলছিলেন, এবার এই আসনে বিএনপির সামনে একটি বড় সুযোগ এসেছে। এখানে যদি এবার বিএনপি প্রার্থী প্রিয়াঙ্কা জয়লাভ করতে পারেন; তাহলে সত্যিকার অর্থে তিনিই ‘প্রথমবারের মত’ দলকে আসনটি উপহার দিতে পারবেন। কারণ, এর আগে ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে শুধু বিএনপি জয় পেয়েছিল; যেটি ছিল একটি ‘একতরফা ও বিতর্কিত’ নির্বাচন।
“বিএনপির প্রার্থীর সবচেয়ে বড় সম্পদ হচ্ছে তিনি তরুণ এবং নারী; সর্বোপরি একজন চিকিৎসক। এ ধরনের প্রার্থী সহজেই আন্তরিকতা দিয়ে গ্রামের মানুষদের আপন করার ক্ষমতা রাখেন। এজন্য অবশ্যই বিএনপিকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, তাদের একক প্রার্থী থাকতে হবে। কারণ, জামায়াতে ইসলামী এখানে বেশ শক্তিশালী। নাহলে দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে।”
ভোটের নির্ঘন্ট
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তথ্য অনুযায়ী, ১৪টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা নিয়ে গঠিত শেরপুর-১ আসনে মোট ভোটার চার লাখ ২৩ হাজার ৬৬৪ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার দুই লাখ ১০ হাজার ৫১৮ জন এবং নারী ভোটার দুই লাখ ১৩ হাজার ১৩৭ জন। তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার রয়েছে নয়জন।
নির্বাচনি ফলাফলের হিসেবে দেখা যাচ্ছে, এখানে ১৯৮৬, ১৯৮৮ এবং ১৯৯১ সালে জাতীয় পার্টির হয়ে শাহ রফিকুল বারী চৌধুরী তিনবার জয়লাভ করেছেন। ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে জয় পান বিএনপির নজরুল ইসলাম।
এরপর ১৯৯৬ (জুন), ২০০১, ২০০৮, ২০১৪, ২০১৮ সালের নির্বাচনে টানা জয় পান আওয়ামী লীগের আতিউর রহমান আতিক। সবশেষ ২০২৪ সালের নির্বাচনে নৌকা প্রতীকের আতিকুল ইসলাম আতিককে আওয়ামী লীগ নেতা ছানোয়ার হোসেন ছানু স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে জয়লাভ করেন।
‘তখন বাবা কারাগারে’
বিএনপি প্রার্থী সানসিলা জেবরিন প্রিয়াঙ্কা রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান। তিনি শেরপুর জেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক হযরত আলীর মেয়ে। ১৯৯৩ সালের ২২ জুন জন্ম নেওয়া প্রিয়াঙ্কা প্রথমবার প্রার্থী হন ২০১৮ সালের নির্বাচনে। তখন তিনি সবে চিকিৎসা শাস্ত্রের সনদ নিয়ে বের হয়েছেন। সেই নির্বাচনে হযরত আলীর প্রার্থী হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে থাকায় মেয়ে প্রিয়াঙ্কাকে মনোনয়ন দেয় দল। প্রথমবারের মত নির্বাচনের মাঠে নেমে সারাদেশে প্রার্থীদের মধ্যে সবচেয়ে ‘কনিষ্ঠ’ প্রিয়াঙ্কা বেশ সাড়া ফেলেন।
দলীয় নেতাকর্মীদের ভাষ্য, ২০১৮ সালের নির্বাচনে প্রিয়াঙ্কা আওয়ামী লীগ দুর্গের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের হামলা-ভাঙচুর উপেক্ষা করে তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে নির্বাচনি প্রচার চালিয়ে গেছেন। অনিয়ম, কারচুপি আর দলীয় নেতাকর্মীদের উপর হামলার অভিযোগ এনে ভোটের দিন দুপুর ১২টায় তিনি নির্বাচন বর্জন করেন। পরে ভোট গণনা শেষে দেখা যায়, তিনি ৩৫ হাজার ভোট পেয়েছেন। এখন তিনি আরও ‘পরিণত’; দলের জেলা কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক নির্বাচিত হয়েছেন। তার অভিজ্ঞতাও বেড়েছে।
সানসিলা জেবরিন প্রিয়াঙ্কা বলছিলেন, “২০১৮ সালে বাবা কারাগারে থাকায় আমাকে দল প্রার্থী করেছিল। সেই নির্বাচনে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করলেও তৎকালীন ফ্যাসিস্ট সরকার আওয়ামী লীগের প্রার্থী আতিউর রহমান আতিক ভোট ডাকাতি করে আমার বিজয় ছিনিয়ে নিয়েছেন। ৫ অগাস্টের পর থেকে আমি প্রতিটি ইউনিয়নের গ্রাম, শহরের বিভিন্ন মহল্লায় পথসভা, নারী সমাবেশ, ৩১ দফা বাস্তবায়নের প্রচারপত্র বিতরণ, বাড়ি বাড়ি গিয়ে উঠান বৈঠক ও ভোটারদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলেছি। এখনও বলছি। আশাতীত সাড়া পাচ্ছি। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষ আমাকে আপন করে নিয়েছে।”
তিনি বলেন, “আমি চরাঞ্চলের সন্তান। এলাকার সবাই আমার চাচা-চাচি, খালা-খালু, ফুফু-ফুফা ও ভাইবোন। এখানের সব ধর্ম-বর্ণের মানুষ আমার প্রাণের মানুষ। আমি সবার ভালোবাসা পেতে চাই। তাই আমি তাদের খুব কাছ থেকে দেখছি, চিনছি এবং বুঝতে চেষ্টা করছি।
“আমি মাটি ও মানুষের সঙ্গে মিশে যেতে চাই। আমি চিকিৎসা সেবার পাশাপাশি মানুষের সব সরকারি সেবা নিশ্চিত করতে চাই। বিশেষ করে নারীদের ক্ষমতায়ন, স্বাবলম্বী করতে যা যা প্রয়োজন তাই করব ইনশাআল্লাহ।”
অন্যরা যা বলছেন
নির্বাচন যত এগিয়ে আসছে গ্রাম-শহরে ভোটের আমেজ তীব্র হচ্ছে। পাড়া-মহল্লা থেকে শুরু করে চায়ের দোকান- সবখানে ভোটের কথা। প্রার্থীর পাশাপাশি কর্মী-সমর্থকদের ব্যস্ততা বাড়তে দিন দিন। সকাল বেলায় ভোটের প্রচারে বেরিয়ে গভীর রাতে বাড়ি ফিরছেন তারা। প্রচারের পথেই কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে খাবার-দাবার ও নাস্তা ছাড়ছেন নেতারা।
তারা অংশ নিচ্ছেন সভা-সমাবেশসহ বিভিন্ন কর্মসুচিতে। বাড়ি, হাট-বাজার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে কুশল বিনিময় করছেন, দোয়া চাইছেন। বিয়ে, জানাজা-সৎকারের মতো সামাজিক অনুষ্ঠানে হাজির হচ্ছেন তারা। এ ছাড়া ধর্মীয়, খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজনেও পৃষ্ঠপোষকতায় এগিয়ে আসছেন।
মনোনয়ন বঞ্চিত জেলা যুবদলের সাবেক সভাপতি শফিকুল ইসলাম মাসুদ বলছিলেন, দল থেকে প্রার্থী মনোনয়ন পুর্নবিবেচনা ‘ইঙ্গিত’ তিনি পেয়েছেন। এ কারণেই বিএনপির তৃণমূলের নেতাকর্মীদের নিয়ে দিনরাত প্রচার চালাচ্ছেন।
“দল যদি মনোনয়ন না দেয় তাহলে এলাকার মানুষের সমর্থন নিয়ে ‘স্বতন্ত্র’ প্রার্থী হয়ে ভোট যুদ্ধে নামব।”
প্রচারে পিছিয়ে নেই জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী হাফেজ রাশেদুল ইসলামও। আগে থেকেই এলাকায় দলটির শক্তিশালী অবস্থান রয়েছে। ফলে সফল হতে কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে নিয়ে তিনি প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন।
জামায়াতের একাধিক নেতাকর্মী মনে করেন, এই আসনে জামায়াতের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। যে কারণে তাদের প্রার্থীও মরিয়া হয়ে প্রচার চালাচ্ছেন। সুষ্ঠু ভোট হলে এই আসনে জামায়াত চমক দেখাবে।
জাতীয় পার্টির জেলা কমিটির সাবেক সভাপতি ইলিয়াস উদ্দিন বলেন, “দলে বিভক্তির পর নেতাকর্মীরা একটু ছন্নছাড়া। সবার সঙ্গে আমার ভাল সম্পর্ক রয়েছে। তাই এবার স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনের চিন্তা করছি। সেভাবেই প্রস্তুতি নিচ্ছি।”