Image description
 

রাজধানীতে দুর্বৃত্তদের গুলিতে সংকটাপন্ন অবস্থায় হাসপাতালে ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরীফ ওসমান বিন হাদি। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরদিনই ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী হাদিকে গুলি করার ঘটনা ঘটল। সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক হাদি গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনায় রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন করে আলোচনা ও উত্তাপ ছড়িয়েছে। আজ জুমার নামাজের পর রাজধানীর বিজয়নগর বক্স কালভার্ট এলাকায় মোটরসাইকেলে আসা দুই দুর্বৃত্ত চলন্ত রিকশায় বসা হাদিকে গুলি করে পালিয়ে যায়।

গুলিবিদ্ধ হাদিকে দ্রুত ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। চিকিৎসকের বরাত দিয়ে ঢামেক পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ পরিদর্শক মো. ফারুক জানিয়েছেন, ওসমান হাদিকে মাথায় ও বাম কানের নিচে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় হাসপাতালের জরুরি বিভাগে আনা হয়।

ঢামেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগের আবাসিক চিকিৎসক (আরএস) ডা. মোশকাত আহমেদ নিশ্চিত করেন, গুলিবিদ্ধ শরিফ ওসমান বিন হাদি বর্তমানে কোমায় আছেন এবং তাঁর অবস্থা অত্যন্ত গুরুতর ও আশঙ্কাজনক। প্রচুর রক্তক্ষরণের কারণে তাঁর চিকিৎসায় জটিলতা তৈরি হয়েছে। হাদির সঙ্গী ও সমর্থকেরা জরুরি ভিত্তিতে ‘বি নেগেটিভ’ রক্তের সন্ধান করছেন।

হাদির ওপর হামলার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস। সরকারপ্রধানের দপ্তর থেকে এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, প্রধান উপদেষ্টা এই সহিংস হামলাকে ‘নির্বাচনী পরিবেশে একেবারেই অগ্রহণযোগ্য’ ও ‘দেশের শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক অঙ্গনের জন্য অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। তিনি আহত ওসমান হাদির সর্বোচ্চ চিকিৎসা নিশ্চিত করতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে তদারকির নির্দেশ দিয়েছেন।

একই সঙ্গে তিনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দ্রুত ও ব্যাপক তদন্ত চালিয়ে হামলায় জড়িত সবাইকে শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনার কঠোর নির্দেশ দিয়েছেন। প্রধান উপদেষ্টা ঘটনাস্থল থেকে আলামত সংগ্রহ, প্রত্যক্ষদর্শীর তথ্য গ্রহণ, সিসিটিভি ফুটেজ পর্যালোচনা এবং হামলার পেছনে কোনো সংগঠিত পরিকল্পনা থাকলে তা উন্মোচনের জন্য তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নিতে বলেছেন।

 

হামলা ও হাদির সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড

পুলিশের রমনা বিভাগের ডিসি মাসুদ আলম জানান, জুমার নামাজের পর বেলা ২টা ২৫ মিনিটে বিজয়নগর বক্স কালভার্ট এলাকায় তিনটি মোটরসাইকেলে আসা হামলাকারীরা হাদিকে গুলি করে পালিয়ে যায়।

হাদির সহকর্মীরা জানান, জুমার নামাজের পর মসজিদে তাদের লিফলেট বিতরণ ও জনসংযোগ কর্মসূচি ছিল। এরপর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আলোচনার পরিকল্পনা ছিল। এর মধ্যেই হামলার খবর আসে।

উল্লেখ্য, গত নভেম্বরে হাদি তাঁর ফেসবুক পেজে পোস্ট দিয়ে দেশি-বিদেশি অন্তত ৩০টি ফোন নম্বর থেকে তাঁকে ও তাঁর পরিবারকে হত্যার এবং ধর্ষণের হুমকি দেওয়া হয়েছে বলে জানান। তিনি ওই পোস্টে আওয়ামী লীগের ‘খুনি’ সমর্থকদের নজরদারির অভিযোগ এনেছিলেন।

আলোচিত রাজনৈতিক মুখ ওসমান হাদি

জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে আন্দোলনের অন্যতম পরিচিত মুখ ওসমান হাদি। রাজনৈতিক অবস্থান এবং তীব্র ভাষায় বক্তব্যের জন্য তিনি সোশ্যাল মিডিয়াতে প্রায়ই আলোচনায় উঠে আসেন।

শরীফ ওসমান বিন হাদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ২০১০-২০১১ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। ২০২৪ সালের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ভূমিকার জন্য তিনি পরিচিতি পান।

হাদির গ্রামের বাড়ি ঝালকাঠির নলছিটিতে। বাবা ছিলেন মাদ্রাসার শিক্ষক। নেছারাবাদ কামিল মাদ্রাসায় হাদির শিক্ষাজীবন শুরু। পরে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।

এক সময় ইংরেজি শেখার কোচিং সেন্টার সাইফুর’স এ শিক্ষকতা করেছেন হাদি। বর্তমানে ইউনিভার্সিটি অব স্কলারস নামে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি শিক্ষকতা করেন বলেও জানা যায়।

মাদ্রাসায় পড়ালেখা করায় এবং ভাষা ও পোশাকের কারণে শিবির বা হিজবুত তাহরীরের কর্মী সন্দেহে ক্যাম্পাস, শ্রেণিকক্ষসহ বিভিন্ন স্থানে তাঁকে সন্দেহ ও হেনস্তার শিকার হতে হয়েছে বলে একাধিকবার বলেছেন হাদি।

তবে তিনি ও তাঁর সহকর্মীদের দাবি, জুলাই অভ্যুত্থানের আগে কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না হাদি; তিনি সাংস্কৃতিক অঙ্গনে কাজ করতেন, একাধিক বইও লিখেছেন।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর ওসমান হাদির হাত ধরে গড়ে ওঠে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম ‘ইনকিলাব মঞ্চ’। ‘সব ধরনের আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও ইনসাফভিত্তিক রাষ্ট্র বিনির্মাণ’ সংগঠনটির ঘোষিত লক্ষ্য।

এবারের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে শিবির নেতৃত্বাধীন প্যানেল থেকে ভোট করে ইনকিলাব মঞ্চের ফাতিমা তাসনিম জুমা মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনবিষয়ক সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন।

আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে সোচ্চার ওসমান হাদি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ডের রায়ের পর বলেন, ‘এই রায় পুরো পৃথিবীর জন্য নজির স্থাপন করেছে।’

গত জুলাইয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হাদি বলেছিলেন, বিএনপি যদি ‘পুরোনো ধারায়’ রাজনীতি করে ক্ষমতায় আসে, তবে তারা দুই বছরও ক্ষমতায় টিকতে পারবে না।

বিভিন্ন সময়ে সেনাবাহিনীরও সমালোচনা করেছেন হাদি। এর বাইরে তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের দুর্বলতা, সংস্কার প্রশ্নে সমঝোতামূলক মনোভাব এবং দৃশ্যত পরিবর্তনের ঘাটতির সমালোচনা করে একটি জাতীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব করেছিলেন।

চলতি বছর জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) ডাকা ‘মার্চ টু গোপালগঞ্জ’ কর্মসূচিতে হামলার পর হাদি গোপালগঞ্জ জেলা ভেঙে দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তীব্র ভাষায় বক্তব্য দেন। তাঁর বক্তব্যের ভাষা ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়। বিতর্কের মুখে তিনি তাঁর শব্দচয়নকে ‘মুক্তির মহাকাব্য’ হিসেবে বর্ণনা করেন এবং কেউ কষ্ট পেয়ে থাকলে তাঁদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করেন।

গত নভেম্বরে হাদি নিজের ফেসবুক পেজে পোস্ট দিয়ে বলেন, দেশি-বিদেশি অন্তত ৩০টি ফোন নম্বর থেকে তাঁকে ফোন এবং মেসেজ পাঠিয়ে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে, তাঁর বাড়িতে আগুন দেওয়া ও তাঁর মা, বোন ও স্ত্রীকে ধর্ষণের হুমকি দেওয়া হয়েছে।

ওই পোস্টে তিনি লেখেন, আওয়ামী লীগের ‘খুনি’ সমর্থকেরা তাঁকে সর্বক্ষণ নজরদারিতে রাখছে। ‘জীবননাশের আশঙ্কা’ সত্ত্বেও তিনি ‘ইনসাফের লড়াই’ থেকে পিছিয়ে যাবেন না।

মতিঝিল, শাহজাহানপুর, পল্টন, রমনা ও শাহবাগ থানা এলাকা নিয়ে গঠিত ঢাকা-৮ আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ঘোষণা দিয়েছেন হাদি। সম্প্রতি ব্যাপক প্রচার-প্রচারণায় তৎপর হয়েছিলেন তিনি। প্রতি শুক্রবারে জনসংযোগ করতেন।