ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে নারায়ণগঞ্জের পাঁচটি আসনে শুরু হয়েছে রাজনৈতিক উত্তাপ। বিএনপি এরই মধ্যে চারটি আসনে প্রার্থী ঘোষণা করলেও প্রতিটি মনোনয়ন ঘিরে দলে চলছে তীব্র বিরোধ, অসন্তোষ ও পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি। মনোনয়নপ্রত্যাশীরা নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে মাঠে সক্রিয়, বিক্ষোভ-অবরোধ থেকে শুরু করে লিখিত আপিল পর্যন্ত জমা দিয়েছেন দলের শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে। বিপরীতে জামায়াতে ইসলামী তুলনামূলকভাবে নির্ভার। প্রার্থী চূড়ান্ত হওয়ায় প্রতিটি আসনেই তারা নিয়মিত মাঠে প্রচার চালাচ্ছেন। অন্যদিকে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ঘোষিত ১২৫ আসনের মধ্যে নারায়ণগঞ্জে দুটি প্রার্থী দিয়েছে; বাকি আসনেও মনোনয়নপ্রত্যাশীরা সক্রিয়ভাবে দলীয় প্রক্রিয়ায় অংশ নিচ্ছেন।
নারায়ণগঞ্জ-১ : ১৭৬ বর্গকিলোমিটার আয়তনের রূপগঞ্জ উপজেলাকে নিয়ে গঠিত নারায়ণগঞ্জ-১ আসনে ভোটার ৪ লাখ ৪ হাজার ৪১৫ জন। বিএনপির পক্ষ থেকে মনোনয়ন চেয়েছিলেন কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য কাজী মনিরুজ্জামান এবং নির্বাহী কমিটির অপর সদস্য ও জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক মোস্তাফিজুর রহমান ভূঁইয়া দিপু। শেষ পর্যন্ত দল দিপুকে প্রার্থী ঘোষণা করে। মনোনয়ন ঘোষণার পর ২৬ নভেম্বর ‘রূপগঞ্জের সর্বস্তরের জনগণ ও জুলাইযোদ্ধা শহীদ পরিবার’ ব্যানারে মশাল মিছিল হয়। যদিও ভিন্ন ব্যানার ব্যবহৃত হয়েছিল। স্থানীয়রা বলেছেন, এতে কেন্দ্রীয় যুবদলের সাবেক নেতা দুলালের অনুসারীরা উপস্থিত ছিলেন। মনোনয়ন বাতিলের দাবিতে সড়ক অবরোধের ঘটনাও ঘটে।
অন্যদিকে জামায়াতের আনোয়ার হোসেন মোল্লা বহু আগ থেকেই নিয়মিত প্রচারণায় মাঠে। এনসিপি এখানে এখনও প্রার্থী ঘোষণা করেনি, তবে সম্ভাব্য হিসেবে আলোচনায় আছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক আহ্বায়ক নিরব রায়হান।
নারায়ণগঞ্জ-২ : আড়াইহাজার উপজেলা নিয়ে গঠিত এ আসনে ভোটার ৩ লাখ ৫৯ হাজার ২৪৯। বিএনপি মনোনীত করেছে ঢাকা বিভাগের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক নজরুল ইসলাম আজাদকে। মনোনয়ন পাওয়া মাত্রই আজাদ ধানের শীষকে রেকর্ড ভোটে জিতিয়ে আনার ঘোষণা দেন। কিন্তু তাঁর মনোনয়নকে কেন্দ্র করে দলে বিরোধ চরমে ওঠে।
বিএনপির সহ-অর্থবিষয়ক সম্পাদক মাহমুদুর রহমান সুমন খোলাখুলিভাবে মনোনয়ন পরিবর্তনের দাবি ও নিজে থেকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দেন। ২৩ নভেম্বর আজাদের মনোনয়ন বাতিলের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল হয়। ২৯ নভেম্বর আড়াইহাজারের হাইজাদি এলাকায় খালেদা জিয়ার রোগমুক্তি কামনায় আয়োজিত দোয়ায় অংশ নিয়ে সুমন সরাসরি বলেনÑ মনোনয়ন প্রত্যাহার না হলে তিনি নির্বাচনে লড়বেন।
জামায়াতের প্রার্থী ইলিয়াস মোল্লা দলে কোনো কোন্দল না থাকায় স্বচ্ছন্দে প্রচার চালাচ্ছেন। মোটর শোভাযাত্রাসহ বিভিন্ন কর্মসূচিতে তাঁর কর্মীরা সক্রিয়। এনসিপির সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে আছেন ব্যারিস্টার কায়েস ও প্রফেসর মফিজুল ইসলাম।
নারায়ণগঞ্জ-৩ : আগে শুধু সোনারগাঁও নিয়ে থাকলেও এবার সিদ্ধিরগঞ্জ যুক্ত হওয়ায় নারায়ণগঞ্জ-৩ আসনে ভোটার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৮৬ হাজার ৯৬৩ জন। বিএনপি মনোনয়ন দিয়েছে জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও সোনারগাঁও উপজেলা সভাপতি আজহারুল ইসলাম মান্নানকে।
কিন্তু এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে দলের শক্তিশালী একাংশ। সাবেক প্রতিমন্ত্রী রেজাউল করিম, সাবেক এমপি গিয়াস উদ্দিন, জেলা আহ্বায়ক অধ্যাপক মামুন মাহমুদসহ মনোনয়নপ্রত্যাশী সাত নেতা মান্নানের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ এনে তারেক রহমানের কাছে লিখিত আপিল করেন। জামায়াতের ড. ইকবাল হোসেন ভূঁইয়া এরই মধ্যে গণমিছিল, লিফলেট বিতরণ ও সমাবেশের মাধ্যমে প্রচারণা জোরদার করেছেন। এনসিপিতে মনোনয়ন সংগ্রহ করেছেন জাবেদ আলম ও তুহিন মাহমুদ; জুলাই-আগস্টের ঘটনাকে স্মরণীয় করার প্রতীকী কর্মসূচি করে জাবেদ মনোযোগ কেড়েছেন।
নারায়ণগঞ্জ-৪ : ফতুল্লা থানা নিয়ে গঠিত এই আসনে ভোটার ৫ লাখ ৩৫ হাজার ৩২৭ জন। বিএনপি এখনও প্রার্থী ঘোষণা করেনি। গুঞ্জন আছে, এ আসন জোটের সঙ্গীদের জন্য খোলা রাখা হতে পারে; তবে জেলা নেতারা এ বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি নন। মনোনয়নপ্রত্যাশীদের তালিকায় রয়েছেন মোহাম্মদ আলী, শাহ আলম, মাসুকুল ইসলাম রাজীব ও মশিউর রহমান রনি।
জোটের প্রার্থী হলে জমিয়তের মনির হোসেন কাশেমীর নামটিই সবচেয়ে আলোচিত। ২০১৮ সালে তিনি শামীম ওসমানের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ৭৪ হাজার ৪৮ ভোট পেয়েছিলেন। জামায়াতের প্রার্থী মাওলানা আব্দুল জব্বার আগে থেকেই প্রচারে সক্রিয়। এনসিপি এখানে কেন্দ্রীয় যুগ্ম সদস্য সচিব আব্দুল্লাহ আল আমিনকে প্রার্থী ঘোষণা করেছে।
নারায়ণগঞ্জ-৫ : নারায়ণগঞ্জ সদর ও বন্দর উপজেলা মিলে গঠিত এ আসনে ভোটার ৪ লাখ ৮০ হাজার ২৮২ জন। বিএনপি মনোনীত করেছে ব্যবসায়ী ও সদ্য দলে যোগ দেওয়া মাসুদুজ্জামানকে। এতে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে দীর্ঘদিনের দলীয় নেতাস্থানীয় কাঠামোর শীর্ষ পর্যায়ে থাকা মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে।
মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক সাখাওয়াত হোসেন খান, সাবেক এমপি আবুল কালাম, তাঁর ছেলে আবুল কাউছার আশাÑ সবাই মিলে দফায় দফায় প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেন মনোনয়ন বাতিলের দাবিতে। পরে মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব আবু আল ইউসুফ খান দলের সিদ্ধান্ত মেনে নিলেও বাকি নেতারা তাঁদের আন্দোলন অব্যাহত রেখেছেন।
জামায়াতের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ও সাবেক মহানগর আমির মাওলানা মাঈন উদ্দিন আগস্টের পর থেকেই মাঠে সক্রিয়। এনসিপির প্রার্থী আহমেদুর রহমান তনুর নাম গত মঙ্গলবার আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হয়।