এবার সামনে এলো পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’র চকচকে প্রচারণার আড়ালে বেশুমার দুর্নীতির নানা বিবরণ। সাড়ে ১৫ বছরে আইসিটি ও টেলিকম খাতের অনিয়ম, দুর্নীতি, নীতি ভঙ্গ এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের ঘটনা অনুসন্ধানে গঠিত টাস্কফোর্সের প্রস্তুত করা শ্বেতপত্র মঙ্গলবার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের হাতে হস্তান্তর করা হয়েছে। রোববার সেটি জনসম্মুখে প্রকাশ করার কথা রয়েছে। এরই মধ্যে শ্বেতপত্রের কিছু অংশ যুগান্তরের হাতে এসেছে। এতে দেখা যায়, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ (বর্তমান নাম বাংলাদেশ স্যাটেলাইট-১) প্রকল্প অনুমোদনেই দুর্নীতির আশ্রয় নেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে যথাযথ সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়নি। অতিরিক্ত ব্যয়, অস্পষ্ট ব্যবসায়িক পরিকল্পনা এবং আয়-ব্যয়ের হিসাব নিয়ে বহু প্রশ্ন থাকলেও সেগুলো উপেক্ষা করা হয়। অডিট আপত্তিও নিষ্পত্তি করা হয়নি। টাস্কফোর্সের ভাষায়, যা ছিল ‘রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগের ওপর রাজনৈতিক প্রভাব।’ এ প্রকল্পের নাম বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ হলেও এটি ছিল মূলত শেখ হাসিনাপুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের অর্থ পাচারের প্রকল্প।
আওয়ামী সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশের দুর্নীতি ও অনিয়মের তথ্য অনুসন্ধানে প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশে ৭ মাস আগে গঠন করা হয়েছিল উচ্চপর্যায়ের পৃথক দুটি টাস্কফোর্স। টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনে আইসিটি খাতে প্রকল্পের নামে পরিকল্পিত অপচয়, একই কোম্পানিকে বারবার কাজ দেওয়া, প্রশিক্ষণের নামে রাষ্ট্রের অর্থ লোপাট ও এ-টু আই প্রকল্পে ভ্যালু ফর মানি পর্যালোচনা না করে আইসিটি খাতকে প্রকল্পভিত্তিক অর্থ বিতরণে একটি রাজনৈতিক ইকো সিস্টেমে পরিণত করা হয়। অপরদিকে, টেলিকম খাতে এসওএফ (সোশ্যাল অবলিগেশন ফান্ড) থেকে আড়াই হাজার কোটি টাকা লোপাট, টেলিকম লাইসেন্সের নীতিতে সাধারণ মানুষের জন্য এক নিয়ম এবং আওয়ামী ঘনিষ্ঠদের জন্য ছিল আরেক (ভিআইপি) নিয়ম, পছন্দের প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণে দেওয়া হয় হাজার কোটি টাকার জাতীয় ফাইবার নেটওয়ার্ক। একই সঙ্গে বিটিসিএল ও টেলিটককে করা হয় ভঙ্গুর। এভাবে টেলিকম খাতের ৪২ প্রকল্প ছিল আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের নেটওয়ার্ক। যার প্রায় প্রতিটির পেছনে ছিলেন সজীব ওয়াজেদ জয়। তাকে সহায়তা করেন দায়িত্বরত মন্ত্রী কিংবা প্রতিমন্ত্রীরা। সর্বশেষ টেলিযোগাযোগ খাতের প্রতিমন্ত্রী ছিলেন জুনায়েদ আহমেদ পলক। তাকে দিয়ে জয় ও আওয়ামী লীগের প্রভাবশালীরা তাদের সুবিধা হাসিল করে নেন। টাস্কফোর্সের ভাষায়, যার নাম ‘রাষ্ট্রীয় নৈতিক প্রভাব’। শ্বেতপত্রের বিষয়ে জানতে চাইলে তথ্য ও প্রযুক্তি বিভাগের সচিব শীষ হায়দার চৌধুরী বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে বলেন, মঙ্গলবার প্রধান উপদেষ্টার কাছে শ্বেতপত্রটি হস্তান্তর করা হয়েছে। অফিশিয়ালি বৃহস্পতিবার আমরা এটি গ্রহণ করেছি। আগামী সপ্তাহের শুরুতে একটি সম্মেলনের মাধ্যমে এটি জনসম্মুখে প্রকাশ করা হবে। শ্বেতপত্রটি অত্যন্ত নিরপেক্ষ ও পদ্ধতিগতভাবে প্রস্তুত করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
সূত্রমতে, ২০০৯ থেকে ২০২৪ সময়কালে (সাড়ে ১৫ বছর) আইসিটি খাতকে প্রকল্পভিত্তিক অর্থ বিতরণের একটি রাজনৈতিক ইকোসিস্টেমে পরিণত করা হয়েছিল। নিয়ন্ত্রক সংস্থার পচন, বাজার দখলদার গোষ্ঠীর প্রভাব, রাষ্ট্রীয় সম্পদের বাণিজ্যিকীকরণের অনেক কিছু উন্মোচন করেছে শ্বেতপত্র কমিটি।
এই শ্বেতপত্রে উন্মোচিত হয়েছে, ‘ডিজিটালাইজেশনের নামে কীভাবে ধ্বংস করা হয়েছে নীতি, শাসনব্যবস্থা ও জনস্বার্থ।’ শুধু তথ্যপ্রযুক্তি (আইসিটি) খাতের ৬৫০ পৃষ্ঠার শ্বেতপত্রে অনিয়ম, পরিকল্পিত পদ্ধতিগত অপচয় আর দুর্নীতির প্রমাণ তুলে ধরা হযেছে। এতে ডিজিটাল কানেকটিভিটি, হাইটেক পার্ক, এ-টু আই, প্রশিক্ষণ প্রকল্প সব খানেই কেস স্টাডিভিত্তিক দুর্নীতির চিত্র উঠে আসে। এ খাতে টাস্কফোর্সের নেতৃত্ব দিয়েছেন আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত উন্নয়ন অর্থনীতিবিদ ড. এম. নিয়াজ আসাদুল্লাহ। সহযোগী ছিলেন অধ্যাপক রেজওয়ান খান, অধ্যাপক চৌধুরী মফিজুর রহমান ও অধ্যাপক রিফাত শাহরিয়ার।
আইসিটি শ্বেতপত্রে দেখানো হয়েছে, আইসিটি খাতের প্রায় সব প্রকল্পেই আওয়ামী সরকার ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে উপস্থাপন করা হতো। একই কোম্পানি বারবার ভিন্ন নামে টেন্ডার পেত। প্রশিক্ষণের নামে কোটি কোটি টাকা গেছে নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছে। হাইটেক পার্কে জমি বরাদ্দ ও নির্মাণ ব্যয়ে ক্ষমতাসীনদের দৌরাত্ম্য ছিল লাগামহীন। এ-টু আই প্রকল্পে ভ্যালু ফর মানি পর্যালোচনা করা হয়নি কখনোই।
অন্যদিকে টেলিকম খাত নিয়ে প্রস্তুতকৃত আড়াই হাজার পৃষ্ঠার শ্বেতপত্রটি আরও বিস্ফোরক। ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর ৪২টি প্রকল্প পর্যালোচনা করে দেখানো হয়েছে, প্রায় অর্ধেক প্রকল্পেই গুরুতর অনিয়ম, অদক্ষতা ও স্বার্থসংঘাতের দৃষ্টান্ত পাওয়া গেছে। সবচেয়ে আলোচিত বিষয়, সোশ্যাল অবলিগেশন ফান্ড (এসওএফ)। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য সাশ্রয়ী ইন্টারনেট নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে ৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকার তহবিল গঠন করা হলেও এর মধ্যে ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকার ৭টি প্রকল্প অনুমোদনে চরম অনিয়ম পাওয়া গেছে। প্রকল্প অনুমোদনের মানদণ্ড না মানা, অযোগ্য প্রতিষ্ঠানকে বিশেষ সুবিধা দেওয়া, প্রাথমিক সম্ভাব্যতা যাচাই না করা, এসব অভিযোগ শ্বেতপত্রে স্পষ্টভাবে লেখা রয়েছে। টেলিকম খাত পর্যালোচনাকারী কমিটির মন্তব্য, ‘এসওএফ ফান্ড কার্যত রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক সিন্ডিকেটের হাতে চলে গিয়েছিল।’
শ্বেতপত্রে ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত লাইসেন্সিং প্রক্রিয়ার যে চিত্র তুলে ধরা হয়েছে, তা পুরো খাতের নীতি ও শাসনব্যবস্থার ভয়াবহ ভাঙনকে স্পষ্ট করে। নথিতে বলা হয়েছে, ক্ষমতাসীনদের ঘনিষ্ঠ কয়েকটি কোম্পানি লাইসেন্স পেয়েছে অস্বাভাবিক দ্রুত সময়ে। অথচ একই শর্তে থাকা অন্যান্য আবেদনকারীকে বছরের পর বছর অপেক্ষায় থাকতে হয়েছে। একাধিক ক্ষেত্রে নীতিমালা উপেক্ষা করে নিয়মবহির্ভূতভাবে লাইসেন্স ইস্যু করা হয়েছে। এমনকি রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী উদ্যোক্তাদের সুবিধা দিতে বিশেষ শর্তও বাতিল করে দেওয়া হয়।
রাষ্ট্রের হাজার কোটি টাকার সম্পদ জাতীয় ফাইবার নেটওয়ার্ককে বেসরকারি কোম্পানির আধিপত্যে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। জাতীয় নেটওয়ার্ক-নিরাপত্তাকেও ঝুঁকির মুখে ফেলেছে। এই প্রেক্ষাপটে সামিট কমিউনিকেশনস ও ফাইবার অ্যাটহোম নামের দুটি প্রতিষ্ঠান কিভাবে বাজার দখলদারিত্ব, নিয়ন্ত্রক সংস্থার ওপর প্রভাব এবং নীতিভিত্তিক অসমতা তৈরি করেছে সে তথ্যও উঠে এসেছে এতে।
শ্বেতপত্রে বিটিআরসির বিষয়ে বলা হয়েছে, প্রতিষ্ঠানটি বছরের পর বছর ধরে অনিয়মিত নিয়োগ, যোগ্যতা-অযোগ্যতার ইচ্ছাকৃত ব্যতিক্রম এবং নিয়ম পরিবর্তনের মাধ্যমে নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের জন্য বিশেষ সুবিধা তৈরির সংস্কৃতি গড়ে তুলে। প্রয়োজনীয় যোগ্যতা ছাড়াই বিশেষ ব্যক্তিদের নিয়োগ, বয়সসীমা অতিক্রম করা প্রার্থীদের জন্য নিয়ম পরিবর্তন, অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের পুনরায় নিয়োগের মাধ্যমে স্বার্থসংঘাত ও পক্ষপাত সৃষ্টি, এমনকি প্রকল্পভিত্তিক কর্মীদের আইনবহির্ভূতভাবে স্থায়ী করার মতো গুরুতর অনিয়মের অভিযোগও শ্বেতপত্রে উঠে এসেছে। এর পাশাপাশি বড় বড় বেসরকারি কোম্পানির সঙ্গে বিটিআরসির ‘অস্বাভাবিক ঘনিষ্ঠতা’ পুরো লাইসেন্সিং ও নিয়ন্ত্রণ কাঠামোকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। কমিটির ভাষায়, ‘বিটিআরসি নিজেই নিয়ম ভাঙার সংস্কৃতি’ তৈরি করেছে।
রাষ্ট্রীয় দুই অপারেটর-বিটিসিএল ও টেলিটকসংক্রান্ত পর্যবেক্ষণ আরও হতাশাজনক। শ্বেতপত্রে উঠে এসেছে, রাজনৈতিক সুপারিশে অদক্ষ ব্যক্তিদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, এমনকি ভুয়া সনদ ব্যবহার করে চাকরি পাওয়ার ঘটনাও উপেক্ষিত হয়েছে। চুক্তিভিত্তিক কর্মীদের ‘বিশেষ সুবিধায়’ স্থায়ী করার মতো নীতিবহির্ভূত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। অডিট ছাড়াই টেন্ডার সম্পন্ন হয়েছে, আর বহু প্রকল্প বিশেষ করে হটস্পট ও টাওয়ার অবকাঠামো দীর্ঘদিন ধরে অচল অবস্থায় পড়ে আছে।
শ্বেতপত্রের বিশ্লেষণে দেখা যায়, সাড়ে ১৫ বছরে খাতটির নীতিনির্ধারণ, নিয়ন্ত্রণ ও বাস্তবায়নের প্রতিটি স্তরেই অদক্ষতা ও স্বজনপ্রীতি তৈরি হয়েছে। ফলে, গ্রামীণ ও দরিদ্র জনগোষ্ঠী সাশ্রয়ী ইন্টারনেটের সুবিধা পায়নি। লিজিং খরচ বেড়ে গেছে। বড় কোম্পানির বাজার দখল বেড়েছে। সরকারি নেটওয়ার্ক বেসরকারি হাতে চলে গেছে। প্রকল্পের নামে হাজার হাজার কোটি টাকার অপচয় হয়েছে। ভোক্তারা উচ্চমূল্যের ইন্টারনেট ব্যবহার করতে বাধ্য হয়েছে। টাস্কফোর্সের একটি সারসংক্ষেপ মন্তব্য পুরো চিত্রটা পরিষ্কার করে, ‘অপারেশনাল বিশৃঙ্খলা এবং শাসনব্যবস্থার ভাঙন দেশের ডিজিটাল রূপান্তরকে পিছিয়ে দিয়েছে অন্তত এক দশক।