আসন্ন জাতীয় নির্বাচন ঘিরে জোট গঠন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে চলছে নানা সমীকরণ। আসন নিয়ে বড় দলগুলোর সঙ্গে ছোট দলগুলোর দর-কষাকষি চলছে। ভোটের মাঠে প্রভাব না থাকলেও এসব দলগুলোকে নিজের জোটে ভিড়াতে চাইছে বড় দলগুলো। আবার কয়েকটি ছোট দল নিজেরাই গড়তে চাইছে জোট। তবে সমীকরণ মেলাতে পারছে না তারা। ফলে জোট গঠন নিয়ে এখনো সিদ্ধান্তহীনতায় রয়েছে এসব দল।
এদিকে, অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি’র সঙ্গে এনসিপি’র আসন সমঝোতার আলোচনা ভেস্তে গেছে বলে সূত্র জানিয়েছে। ইতিমধ্যে ঢাকায় এনসিপি’র নেতাদের চাওয়া আসনগুলোতে দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করেছে বিএনপি। জোটে অংশ নেয়া একাধিক নেতা মানবজমিনকে জানিয়েছেন, জোটের শরিকদের সঙ্গে আলোচনা না করেই আসন চূড়ান্ত করছে বিএনপি। ফলে মনস্তাত্ত্বিকভাবেই জোটের শরিকদের দূরে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। যা ভালো বার্তা দিচ্ছে না। ওদিকে এনসিপিসহ চারদলীয় জোট গঠন অনিশ্চয়তায় পড়েছে। শেষ মুহূর্তে স্থগিত করা হয়েছে আত্মপ্রকাশ।
এনসিপি’র কৌশলগত তিন দিক: জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পটভূমিতে গঠিত তরুণ নেতৃত্বের দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এখন জোট রাজনীতিতে আলোচনার কেন্দ্রে। দলটির ভেতরেই তিনটি কৌশল নিয়ে চলছে নানা আলোচনা। বিএনপি’র সঙ্গে আসন সমঝোতা, জামায়াতের সঙ্গে জোট, এককভাবে ৩০০ আসনে লড়াই। এনসিপি’র একাধিক সূত্র জানায়, বিএনপি ও জামায়াত উভয়পক্ষের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা চলছে। আসন সমঝোতায়ও কথাবার্তা বেশ এগিয়েছে। তবে, দলটি এখনো আনুষ্ঠানিক অবস্থান জানায়নি। একাংশ মধ্যপন্থি পরিচয় ধরে রেখে নতুন জোট চাইলেও আরেক পক্ষ বিএনপি’র সঙ্গে দ্রুত আলোচনা চূড়ান্ত করতে তাগিদ দিচ্ছে।
এবি পার্টি, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন, আপ বাংলাদেশ ও এনসিপিকে নিয়ে গঠিত ‘গণতান্ত্রিক সংস্কার জোট’ শেষ মুহূর্তে স্থগিত হয়েছে আপ বাংলাদেশকে ঘিরে মতবিরোধের কারণে।
এনসিপি’র যুগ্ম সদস্য সচিব মুশফিক উস সালেহীন মানবজমিনকে বলেন, আমরা ৩০০ আসনেই একক নির্বাচন করার প্রস্তুতি নিয়ে এগোচ্ছি। প্রাথমিকভাবে একটি প্রার্থী তালিকা দ্রুত সময়ের মধ্যেই ঘোষণা করা হবে। রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যোগাযোগ থাকেই। এখন পর্যন্ত এককভাবে নির্বাচন করার প্রস্তুতি নিচ্ছি। ভবিষ্যতে যদি কখনো আলোচনা ফলপ্রসূ হয়, সেটা সবাইকে জানানো হবে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, যেসব আসনে এখনো প্রার্থী ঘোষণা করা হয়নি, সেগুলো মূলত জোটের জন্য রাখা হয়েছে। এ ছাড়া বাকি এক-দুইটি আসনে প্রয়োজন হলে পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত নেয়া হতে পারে।
অন্যদিকে, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীসহ আট ইসলামী দল সমঝোতার মাধ্যমে একক প্রার্থী দেয়ার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করছে। এই সমঝোতায় রয়েছে- ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, খেলাফত মজলিস, নেজামে ইসলাম পার্টি, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টি ও জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি।
জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ বলেছেন, আট দল সমঝোতার ভিত্তিতে আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেবে। অন্য দলের জন্যও জোটের দরজা উন্মুক্ত রয়েছে।
বামপন্থিদের ‘গণতান্ত্রিক যুক্তফ্রন্ট’: বাম গণতান্ত্রিক জোট ও বাংলাদেশ জাসদের উদ্যোগে গঠিত হয়েছে ৯ দলের নতুন জোট ‘গণতান্ত্রিক যুক্তফ্রন্ট’। ৯ দলে রয়েছে- বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাসদ, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টি, বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগ, সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন, বাসদ (মার্কসবাদী), বাংলাদেশ জাসদ, ঐক্য ন্যাপ, বাসদ (মাহবুব)।
এ বিষয়ে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)’র সাধারণ সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল কাফি রতন মানবজমিনকে বলেন, গত ২৯শে নভেম্বর আমাদের জোট গঠন সম্পন্ন হয়েছে। আগামী ১০, ১১, ১২, ১৩ই ডিসেম্বর এই চারদিন সারা দেশে বিশেষ করে বৃহত্তর জেলাগুলোতে জোটের মতবিনিময় সভা হবে।
তিনি বলেন, আমাদের জোট ‘গণতান্ত্রিক যুক্তফ্রন্ট’ এটার পক্ষ থেকে সব আসনে প্রার্থী দেবো। নির্বাচনে আমরা অংশ নেবো। আমাদের বক্তব্যগুলো জনগণের সামনে পরিষ্কারভাবে তুলে ধরবো। জনগণের সম্মতি থাকলে আমরা সংসদে যাবো।
১৬ দল নিয়ে নতুন জোট, মঞ্জু-আনিসের উদ্যোগ: জাতীয় পার্টির (জেপি) চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জু ও জাতীয় পার্টির (জাপা) একাংশের চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদের নেতৃত্বে নতুন ১৬ দলীয় ‘জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক জোট’ গঠনের উদ্যোগ চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। শিগগিরই এর আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসতে পারে।
বিএনপি’র সঙ্গে জোট, বামপন্থিদের ঐক্য, ইসলামী দলের সমঝোতা, মধ্যপন্থি নতুন জোটের প্রস্তুতি ও এনসিপি’র কৌশলগত অবস্থান- ফলে নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে চলছে নানা সমীকরণ ও আসনের দরকষাকষি।
এসব বিষয়ে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক মানবজমিনকে বলেন, নির্দিষ্ট করে আলোচনা হয়নি। সর্বশেষ আলোচনা হয়েছে অনেকদিন আগে। উনারা (বিএনপি) দুই দফা যে প্রার্থী ঘোষণা করেছেন সেটা এককভাবেই। মঞ্চের শরিক কোনো দলের সঙ্গে আলোচনা করেছে এমন তথ্য আমার জানা নেই। ফলে এটা নিয়ে এক ধরনের মানসিক দূরত্ব তৈরি হয়েছে গণতন্ত্র মঞ্চের অধিকাংশ শরিকদের সঙ্গে। বিএনপি তার প্রাচ্যের মিত্রদের এর মধ্যদিয়ে দূরে ঠেলে দিচ্ছে- এ রকম একটি বার্তাই পাবলিকলি যাচ্ছে। এটা কোনো ভালো বার্তা দিচ্ছে না।
গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান মানবজমিনকে বলেন, এখনো পর্যন্ত জোটের ব্যাপারে কোনো দলের সঙ্গে চূড়ান্তভাবে আলোচনা হয়নি। এমনিতে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা আছে। ২০০ আসনে আমাদের প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে। আমাদের প্রার্থীরা এখনো মাঠে যাচ্ছে, গণসংযোগ করছে। মাঠ সার্ভে করছে। খুব শিগগিরই ১০০ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করবো। তফসিল ঘোষণার পর আমরা কার সঙ্গে জোটে যাবো, সেটা জানাবো।