জনসমর্থন এবং দলগত বিবেচনায় প্রশাসনে নিয়ন্ত্রণ থাকার কথা এখন বিএনপির। চব্বিশের গণঅভ্যূত্থান পরবর্তী পরিস্থিতি তা-ই ছিল। কিন্তু সরকারের শীর্ষ মহলের চক্রান্তে বিএনপিকে উচ্ছেদ করে জামায়াতের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা হয়। আর এই নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে জামায়াতে ইসলামী এখন মরিয়া। প্রশাসনের ওপর ভর করেই দলটি নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে চায়। নির্বাচনে তাদের ভরাডুবি হবে, এমন আশংকাই বেশি। এ কারণে নির্বাচন চাচ্ছিল না। কিন্তু নির্বাচন যেহেতু হয়েই যাচ্ছে এবং নির্বাচনে তাদের যেতে হচ্ছে- তাই প্রশাসনকে কাজে লাগেয়ে পার পেতে চায়। এ লক্ষ্যে প্রশাসন নিয়ে জামায়াতের বড় রকমের একটা প্ল্যান রয়েছে। এরই সর্বশেষ সংস্করণ হলো লটারি।
গত ১৯ নভেম্বর রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনের সম্মেলন কক্ষে ইসির সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপে জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে মাঠ প্রশাসনে পদায়নে লটারির দাবি তোলা হয়। এর পাঁচ দিন পরেই ৬৪ জেলার এসপি পদায়নে লটারির ব্যবস্থা করা হলো। কিন্তু এটি আদতে লটারি ছিল না, লটারির নামে ভাওতাবাজি হয়েছে, বলছেন সংশ্লিষ্টরা।
গত ২৪ নভেম্বর লটারির নামে নাটকটি মঞ্চস্থ হয়েছে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনায়। এর আগে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী নিজ কার্যালয়ে ঘোষণা দিয়েছিলেন সবার সামনে (সাংবাদিকসহ) লটারি করা হবে। কিন্তু লটারি করার মুহূর্তের ছবি প্রকাশ করা হয়নি। তাই অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন, লটারি বলতে যা বোঝায় তা আদৌ হয়েছে কিনা? এর কারণ হলো, পুলিশের এ রদবদলে ৬৪ জেলার মধ্যে ৩৫টি জেলায় নিয়োগ পেয়েছেন জামায়াতপন্থী হিসেবে পুলিশের কর্মরত কর্মকর্তারা। এছাড়া দুর্নীতিবাজ এবং আওয়ামী চিহ্নিত কর্মকর্তাদেরও প্রাধান্য রয়েছে এই পদায়নে, যারা ইতিমধ্যে জামায়াতে যোগ দিয়েছেন। বিএনপি বা শিক্ষাজীবনে ছাত্রদলের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন এমন পুলিশ কর্মকর্তাদের মাত্র কয়েকজনকে এসপি পদে পদায়ন দেয়া হয়েছে, তাও কম গুরুত্বপূর্ণ অর্থাৎ বি ও সি ক্যাটাগরির জেলায়। অনেককেই আবার জেলা থেকে অন্যত্র বদলি করা হয়েছে।
সরকারের তরফ থেকে বলা হয়েছে, গত ২৪ নভেম্বরের এই লটারিতে উপস্থিত ছিলেন ভারপ্রাপ্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি), ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী ছাড়াও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের প্রতিনিধিরা, যদিও বাস্তবে এই লটারির কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। তাছাড়া যাদের উপস্থিত থাকার কথা বলা হয়েছে এরা সবাই জামায়াতপন্থি হিসেবে পরিচিত। এমনকি এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসও জামায়াতকে বিশেষ সুবিধা দেওয়ার নীতি অনুসরণ করে আসছেন অন্তর্বর্তী সরকারের শুরু থেকেই।
পুলিশ বিভাগ সূত্র জানায়, দেশের ইতিহাসে এসপি পদায়নে প্রথম কোনো ম্যানুয়াল লটারি, যা প্রশাসন ও জনমনে একধরনের মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। যদিও সরকার এই প্রক্রিয়াকে বলছে স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষভাবেই করা হয়েছে। তবে সংশ্লিষ্ট মহলে উঠে আসছে নানা তথ্য। যা লটারির আড়ালে অন্য বিশেষ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। বিশেষত, গুরুত্বপূর্ণ ও আর্থ-সামাজিক দিক থেকে সুবিধাজনক জেলাগুলোর নিয়ন্ত্রণ কারা পাচ্ছেন, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। পূর্ববর্তী সরকারের আমলে সুবিধাভোগী বলে পরিচিত কিছু কর্মকর্তার পদায়ন নিয়েও আলোচনা হচ্ছে পুলিশ মহলে।
নাম প্রকাশ না করে পুলিশ সদর দপ্তরে কর্মরত ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, ২৪ ও ২৫ ব্যাচের যারা বিভিন্ন জেলায় নিয়োগ পেয়েছেন তাদের মধ্যে কেউ কেউ বিশেষ সুপারিশে নিয়োগ পেয়েছেন। অনেক কর্মকর্তা আছেন, গত সরকারের আমলে সুবিধা নিয়েছেন, দুর্নীতিবাজ এবং আওয়ামী ফ্যাসিস্ট হিসেবে চিহ্নিত। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর তারা ভোল পাল্টে এখন কৌশলে সুবিধা নিচ্ছেন। এইসব কর্মকর্তা ইতিমধ্যে জামায়াত লীগ নামে পরিচিতি পেয়েছেন। ২৭ ও ২৮ ব্যাচের কর্মকর্তাদের লটারি করা হয়েছে। জেলার এসপি নিয়োগ পেয়েছেন ২৪ ব্যাচের ২ জন ও ২৫ ব্যাচের ৪২ জন। বাকিরা ২৭ ব্যাচের।
পুলিশ সদর দপ্তরসহ ইউনিটগুলোতে আলোচনা হচ্ছে- গুরুত্বপুর্ণ এমন জেলা আছে যারা নিয়োগ পেয়েছেন তারা কখনো কোন জেলায় কাজ করেননি। তারা কিভাবে পরিস্থিতি ঠিক রাখবেন তা নিয়ে সন্দিহান। আওয়ামী লীগের অনেকঘাটি আছে, ওইসব জেলাগুলোই বেশি ঝুঁকিপুর্ণ। এ প্রসঙ্গে এক কর্মকর্তা বলেন, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর পরিস্থিতি বেশি ঘোলাটে হওয়ার আশংকা আছে। আওয়ামী লীগের সমর্থন বেশির পাশাপাশি জামায়াত ইসলামীর সমর্থন আছে বেশকিছু জেলায়। আবার একাধিক জেলা আছে বিএনপির সমর্থক বেশি। প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে পরিস্থিতি বাহিরে গেলে নতুন এসপিরা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবেন না বলে আমাদের আশংকা আছে।
গোয়েন্দা রিপোর্টের তথ্যনুযায়ী- গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, শরিয়তপুর, ফরিদপুর, নারয়নগঞ্জ, নরসিংদী, টাঙ্গাইল, রাঙ্গামাটি, কিশোরগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, রাজবাড়ী, যশোর, বরিশাল, গাজীপুর, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, ঢাকা জেলা, খুলনা, বান্দরবান, পাবনা, রাজশাহী, সিরাজগঞ্জ, মাগুরা, সিলেট, বাগেরহাট, কুষ্টিয়া, খাগড়াছড়ি, মেহেরপুর, সাতক্ষীরা, চুয়াডাঙ্গা জেলাগুলো বেশি ঝুঁকিপুর্ণ। এসব জেলার সদ্য নিয়োগ পাওয়া পুলিশ সুপারদের বেশি কষ্ট করতে হবে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে পদোন্নতি ও গুরুত্বপূর্ণ পোস্টিং থেকে বঞ্চিত ছিলেন এমন অনেক কর্মকর্তা এবারের লটারির তালিকায় স্থান পাননি বলে অভিযোগ উঠেছে। বাদ পড়া ওই অংশটি ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করেছে। তাদের অভিযোগ, যোগ্য ও নিষ্ঠাবানদের বাদ দিয়ে রাজনৈতিক বিবেচনায় শুধুমাত্র ‘জামায়াত’ এবং ‘জামায়াত লীগ’কে নিয়েই ‘ফিট লিস্ট’ তৈরি করা হয়।
যদিও তথাকথিত এই লটারির দুইদিন আগে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী জানিয়েছিলেন, এসপি পদে পদায়নর জন্য প্রথমে মেধাবী ও যোগ্য কর্মকর্তাদের বাছাই করা হয়েছে। এরপর জেলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, আয়তন ও গুরুত্বের ভিত্তিতে জেলাগুলোকে ‘এ’, ‘বি’, এবং ‘সি’ তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়। তিনি জোর দিয়ে দাবি করেছেন, এই প্রক্রিয়ায় মেধাবীরা কেউ বাদ পড়েননি এবং লটারি স্বচ্ছ হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে হয়েছে উল্টো।
পুলিশ সংশ্লিষ্টরা জানায়, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পুলিশে ব্যাপক রদবদল করে বর্তমান সরকার। তাদের বদলি করা নিয়ে নানা ধরনের নাটকীয়তা হয়েছে। এখনো একই রকমের কর্মকাণ্ড চলছে। এসপি পদায়নের পরের ধাপে থানার ওসি নিয়োগও লটারির ভিত্তিতে করা হবে বলে জানানো হয়েছে। কিন্তু সেখানেও একই ধরনের জামায়াতী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হবে বলে আশংকা করা হচ্ছে। উল্লেখ্য, গত ১৯ নভেম্বর ইসির সঙ্গে সংলাপে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার দাবি জানিয়েছেন, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে লটারির মাধ্যমে জেলা প্রশাসক (ডিসি), পুলিশ সুপার (এসপি) ও ওসি বদলি করতে হবে।
ডিসি, এসপি ও ইউএনও পদে ইতিমধ্যে যাদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে তাতে প্রাধান্য পেয়েছেন সাবেক ছাত্রশিবির এবং জামায়াত সংশ্লিষ্টরা। যা নিয়ে ইতিমধ্যে বিএনপির পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দেয়া হয়েছে। এখন ডিসি নিয়োগে লটারি করা হলে তাতেও একই পরিস্থিতি দাঁড়াবে, বলছেন সংশ্লিষ্টরা। এতে আশংকা করা হচ্ছে যে, প্রশাসন নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে শেষ মুহূর্তে পরিকল্পিতভাবে গোলযোগ সৃষ্টি এবং নির্বাচন বানচালেরও ষড়যন্ত্র হতে পারে।
শীর্ষনিউজ