ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বগুড়া-২ (শিবগঞ্জ) আসনে বিএনপির দলীয় মনোনয়ন নিয়ে শুরু হয়েছে তীব্র দৌড়ঝাঁপ। একদিকে দীর্ঘদিনের তৃণমূল সংগঠক উপজেলা বিএনপির সভাপতি মীর শাহে আলম, অন্যদিকে জাতীয় রাজনীতিতে আলোচিত নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্নাও ভোটের মাঠে সক্রিয়।
বর্তমানে এ আসনে বিএনপি ও জামায়াতের কর্মসূচিতে রাজনৈতিক অঙ্গন উত্তপ্ত । বিএনপি কর্মীরা অপেক্ষায়—কে পাবেন ধানের শীষ প্রতীক। তবে গত কয়েকদিন থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে, শাহে আলমকে তারেক রহমানের পক্ষ থেকে সবুজ সংকেত দেওয়া হয়েছে।
খালেদা জিয়ার সাবেক অ্যাসাইনমেন্ট অফিসার ও দলের ঘনিষ্ঠজন ডা. ফিরোজ মাহমুদ ইকবালও মনোনয়নপ্রত্যাশী। সাবেক এমপি একেএম হাফিজুর রহমান ও জেলা বিএনপির সহসভাপতি এমআর ইসলাম স্বাধীনের নামও আলোচনায় রয়েছে। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী মনোনয়ন দিয়েছে অধ্যক্ষ মাওলানা শাহাদাতুজ্জামানকে।
বগুড়ার অন্য আসনগুলোর মধ্যে এই আসনটিও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এখানকার ভোটারদের রাজনৈতিক মনোভাব দীর্ঘদিন ধরে জাতীয়তাবাদী ধারায় প্রবাহিত। ১৯৯১ সালে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার পর জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী মাওলানা শাহাদাতুজ্জামান এখানে বিজয়ী হন।
তারপর থেকে এই আসনে জামায়াতের অবস্থান বেশ শক্ত হয়ে ওঠে। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে ধানের শীষের প্রার্থী হাফিজুর রহমান বিজয়ী হন।
২০০১ সালের নির্বাচনে আবারও রেজাউল বারী ডিনা জয় পান। ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নেওয়ায় আসনটি জাতীয় পার্টির হাতে চলে যায়। পরবর্তী দুটি নির্বাচনেও জাতীয় পার্টির শরিফুল ইসলাম জিন্নাহ জয়ী হন।
গত ১২টি সংসদ নির্বাচনের ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, শিবগঞ্জে বিএনপি জয় পেয়েছে পাঁচবার, জাতীয় পার্টি তিনবার এবং আওয়ামী লীগ, জামায়াত, ফ্রিডম পার্টি ও স্বতন্ত্র প্রার্থী পেয়েছেন একবার করে জয়। এই পরিসংখ্যান প্রমাণ করে, শিবগঞ্জের রাজনৈতিক মানচিত্রে বিএনপি দীর্ঘদিন ধরেই প্রভাবশালী শক্তি হিসেবে অবস্থান করেছে। সম্প্রতি সেই আধিপত্যে ভাটা পড়েছে। এ আসনে বিএনপি কয়েকটি গোত্রে বিভক্ত হয়ে পড়েছে।
মাহমুদুর রহমান মান্না এলাকায় না থাকার কারণে সাধারণ মানুষ থেকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন। এ আসন থেকেই নির্বাচন করতে চান তিনি। তবে দল ও জোটের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছেন।
এ আসন থেকে মীর শাহে আলমকে মনোনয়ন দিলে জামায়াতে ইসলামীর জন্য বিজয় বেশ কঠিন হয়ে পড়বে। উপজেলা থেকে ওয়ার্ড কমিটি তার হাতে গড়া। তবে মীর শাহে আলমকে নিয়ে বেশ বিতর্কও রয়েছে। জীবনের প্রথম ইউনিয়ন জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছিলেন প্রতারণা করে। অর্থাৎ নির্বাচন কমিশনের নিয়মকে তোয়াক্কা না করে প্রভাব খাটিয়ে পূর্ণ বয়স না হতেই ইউপি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ওই ঘটনা নিয়ে আদালতে দীর্ঘদিন মামলা চলমান ছিল। তাকে বিএনপির সবুজ সংকেত দেওয়ার কথা চললেও এখানে মাহমুদুর রহমান মান্নাকে জোটের মনোনয়ন দেওয়ার সম্ভাবনা বেশি বলে জানিয়েছেন দলীয় নেতারা।
মাওলানা শাহাদাতুজ্জামান একটি মাদরাসার সাবেক অধ্যক্ষ। ১৯৯১ সালে শাহাদাতুজ্জামান এই আসন থেকে বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়েছিলেন। আওয়ামী শাসনামলে এই অঞ্চলের জামায়াতের নেতাকর্মীদের নানাভাবে হেনস্তা করার কারণে সাধারণ মানুষের সহানুভূতি অর্জন করেছেন বলে স্থানীয়রা মনে করছেন। প্রায় প্রতিদিনই গ্রামেগঞ্জে হাটবাজারে তিনি দাঁড়িপাল্লা মার্কায় ভোট চেয়ে সমাবেশ ও গণসংযোগ করছেন। তিনি আমার দেশকে বলেন, ইনশাল্লাহ আমার বিজয় সুনিশ্চিত। এই অবহেলিত অঞ্চলকে নতুন করে সাজাতে চাই। বেকার ও শিক্ষিত যুবকদের নিয়ে কাজ করতে চাই। শিল্পাঞ্চল তৈরি করতে চাই।
জেলা বিএনপির সহসভাপতি এমআর ইসলাম স্বাধীন পরিচ্ছন্ন রাজনীতিক হিসেবে পরিচিত। তরুণ ভোটারদের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। রাজনীতির পাশাপাশি সামাজিক কর্মকাণ্ডেও সক্রিয় থাকায় এলাকায় জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন তিনি। তিনি বলেন, আমি মানুষের চাহিদা বুঝে প্রার্থী হয়েছি। জনগণ পরিবর্তনের জন্য নতুন মুখ দেখতে চায়। সেই চাহিদা পূরণের লক্ষ্য নিয়েই ভোটের মাঠে নেমেছি।
এলাকায় ডা. ফিরোজ মাহমুদ ইকবালেরও বেশ সুনাম রয়েছে। ভোটের মাঠেও তার উপস্থিতি রয়েছে। তিনি বলেন, আমি গ্রামের মানুষ, সেখানকার মাটি আমাকে টানে। এখন যোগ্যতার মাপকাঠিতে দলই মূল্যায়ন করবে। দল যা সিদ্ধান্ত দেবে আমি তা মেনে নেব।
সাবেক সংসদ সদস্য হাফিজুর রহমান নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন দুবার। অভিজ্ঞ ও সিনিয়র রাজনীতিক হিসেবে তার হাইকমান্ডে তিনি বেশ সুপরিচিত। তবে বয়স ও শারীরিক অবস্থার কারণে প্রচারে গতি কম বলে দলের একটি অংশ মনে করে। হাফিজুর রহমান আমার দেশকে বলেন, আমি খালেদা জিয়ার পরীক্ষিত সৈনিক। অতীতের মতো এবারো মনোনয়ন চাইব এবং দলের জয় নিশ্চিত করতে মাঠে থাকব।
স্থানীয় পর্যবেক্ষকরা বলছেন, দীর্ঘদিন বিএনপি এ আসনে শক্তিশালী থাকলেও এবার তাদের জন্য চ্যালেঞ্জ অনেক। এর প্রধান কারণ মনোনয়ন ঘিরে দলের একাধিক নেতার লড়াই। এটা তৃণমূলের একতা নষ্ট করতে পারে, যা শেষ পর্যন্ত ভোটের মাঠে বিভাজন তৈরি করবে বলেই মনে করা হচ্ছে।
জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী অধ্যক্ষ শাহাদাতুজ্জামান এখনো ভোটব্যাংক ধরে রেখেছেন। এমন পরিস্থিতিতে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে হলেও একাধিক শক্তিশালী প্রার্থীর উপস্থিতিতে ভোটের সমীকরণ জটিল হতে পারে।