লেবাননের দক্ষিণাঞ্চলে সম্প্রতি পাওয়া অস্ত্রের ধ্বংসাবশেষের ছবিতে দেখা যাচ্ছে—ইসরায়েল আবারও ব্যবহার করেছে ক্লাস্টার মিউনিশন, যা প্রায় দুই দশক ধরে নিষিদ্ধ হিসেবে বিবেচিত। যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলগুলোতে এমন অস্ত্রের চিহ্ন দেখা গেছে ওয়াদি জিবকিন, ওয়াদি বারগুজ ও ওয়াদি দেইর সিরিয়ানের মতো বনঘেরা উপত্যকায়।
ছবিগুলো ছয়জন আন্তর্জাতিক অস্ত্র বিশ্লেষক পরীক্ষা করেছেন। তাদের মতে, দুটি ভিন্ন ধরনের ক্লাস্টার বোমার ধ্বংসাবশেষ সনাক্ত করা গেছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ১৫৫ মিমি ব্যারাক এইতান (M999 Barak Eitan) আর ২২৭ মিমি রাআম এইতান (Ra’am Eitan) মিসাইল—দুটি নতুন প্রজন্মের ক্লাস্টার মিউনিশন, যা এর আগে কখনো ব্যবহারের তথ্য পাওয়া যায়নি।
এই অস্ত্রগুলো মূলত একটি বড় বোমা, যা বিস্ফোরণের সময় বহু ছোট ‘বোমলেট’ বা সাবমিউনিশনে ছড়িয়ে পড়ে—ফুটবল মাঠের চেয়েও বড় এলাকায়। এই বোমলেটগুলোর অনেকগুলোই সঙ্গে সঙ্গে বিস্ফোরিত না হয়ে পড়ে থাকে, যা পরে দীর্ঘদিন ধরে সাধারণ মানুষের জন্য ভয়ানক বিপদ ডেকে আনে।
এখন পর্যন্ত ১২৪টি দেশ ক্লাস্টার মিউনিশনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে। এই চুক্তি অনুযায়ী, এই ধরনের অস্ত্রের ব্যবহার, উৎপাদন ও হস্তান্তর সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। তবে ইসরায়েল সেই চুক্তিতে নেই, ফলে আইনি বাধ্যবাধকতাও তাদের নেই।
তবুও, মানবাধিকার সংগঠন ‘ক্লাস্টার মিউনিশন কোয়ালিশনের’ পরিচালক তামার গ্যাবেলনিক বলেন, ‘এই অস্ত্রগুলোর ব্যাপক ধ্বংসক্ষমতা এবং বেছে বেছে লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণ না করতে পারার কারণে এগুলো আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের পরিপন্থী। বহু বছর ধরে এগুলোর অবিস্ফোরিত অংশ সাধারণ নাগরিকদের মেরে ফেলে বা পঙ্গু করে।’
ইসরায়েল এই অস্ত্র ব্যবহারের কথা সরাসরি স্বীকার বা অস্বীকার করেনি। তারা কেবল বলেছে, ‘ইসরায়েল কেবল আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় বৈধ অস্ত্রই ব্যবহার করে, আর বেসামরিক মানুষের ক্ষতি কমাতে চেষ্টা করে।’
২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে লেবাননে হিজবুল্লাহর সঙ্গে ইসরায়েলের যুদ্ধ চলে ১৩ মাস। এতে লেবানে প্রায় ৪ হাজার এবং ইসরায়েলে প্রায় ১২০ জন মারা যায়। যুদ্ধ শেষে শান্তিচুক্তি হলেও দক্ষিণ লেবানে এখনো প্রায় প্রতিদিনই ইসরায়েলি বিমান হামলা চলছে।
২০০৬ সালের যুদ্ধের সময় ইসরায়েল প্রায় ৪০ লাখ ক্লাস্টার বোমা ফেলেছিল লেবাননে, যার মধ্যে অন্তত ১০ লাখ বিস্ফোরণহীন ছিল বলে ধারণা। সেইসব অবিস্ফোরিত বোমার কারণে আজও দক্ষিণ লেবানে জীবন বিপজ্জনক। তখন থেকেই লেবাননে এই অস্ত্র ব্যবহারের বিরুদ্ধে তীব্র আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়।
বিরোধপূর্ণ বিষয় হলো, ইসরায়েল নিজে এই অস্ত্র ব্যবহার করলেও এবছর গ্রীষ্মে ইরান যখন দক্ষিণ ইসরায়েলে একই ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করে, তখন ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী কঠোর ভাষায় এর নিন্দা জানায়। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এফি ডেফরিন বলেন, ‘সন্ত্রাসী শাসনব্যবস্থা বেসামরিক মানুষদের ক্ষতি করতে চায় এবং অস্ত্র ছড়িয়ে দিয়ে সর্বোচ্চ ক্ষয়ক্ষতির চেষ্টা চালিয়েছে।’
সম্প্রতি পাওয়া দুই ধরনের অস্ত্র—এম৯৯৯ ব্যারাক এইতান এবং রাআম এইতান—নিয়ে অস্ত্রবিশেষজ্ঞদের মধ্যে মত একমত। ব্যারাক এইতান ২০১৯ সালে তৈরি হয় ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা প্রতিষ্ঠান এলবিট সিস্টেমসের মাধ্যমে। এই গোলা একবার বিস্ফোরিত হলে ১,২০০ টাংস্টেন ধাতব টুকরো ছড়িয়ে দেয়।
অন্যদিকে, রাআম এইতান একটি ২২৭ মিমি গাইডেড মিসাইল—যার প্রতিটি শেলে থাকে ৬৪টি সাবমিউনিশন। ইসরায়েলি মিডিয়ার ভাষ্যমতে, এটি বিস্ফোরণে ‘চারপাশে থাকা সবাই’ নিহত হতে পারে। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইসরায়েলি সেনারা এই অস্ত্র দিয়ে উত্তর সীমান্তে অভিযান চালিয়েছিল।
যদিও নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের দাবি—নতুন প্রজন্মের এই বোমাগুলোর ‘ডাড রেট’ অর্থাৎ অবিস্ফোরিত থাকার হার অনেক কম (রাআম এইতানের ক্ষেত্রে ০.০১%)—মানবাধিকার সংগঠনগুলোর মতে, বাস্তবে এই হার অনেক বেশি। ২০০৬ সালের যুদ্ধে ব্যবহৃত এম৮৫ বোমার ক্ষেত্রে সরকার বলেছিল, এর ডাড রেট ০.০৬%। পরে বিশ্লেষণে দেখা যায়, এটি ছিল প্রায় ১০%।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের অস্ত্র গবেষক ব্রায়ান ক্যাসনার বলেন, ‘ক্লাস্টার বোমা নিষিদ্ধ করা হয়েছে একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণে—এই অস্ত্র কোনো নির্দিষ্ট লক্ষ্য বেছে নেয় না। এতে মূল ক্ষতি হয় সাধারণ মানুষের।’
তার মতে, ‘এই অস্ত্র ব্যবহারকে আইনসম্মত বা দায়িত্বপূর্ণ করার কোনো উপায় নেই। কারণ এই অস্ত্র বহু বছর পরও প্রাণহানি ঘটাতে সক্ষম।’