সংসদ নির্বাচনে সিলেট ১ আসনে যে দলের প্রার্থী জয়লাভ করে সে দলই প্রতিবার সরকার গঠন করে। বহুল প্রচলিত এ কথা কতটা সত্যি, সেটি নির্বাচনের পরিসংখ্যানের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। ১৯৯১ সাল থেকে শুরু করে ২০০৮ সাল পর্যন্ত প্রতিটি সাধারণ নির্বাচনে এটি প্রমাণিত হয়েছে।
বাংলাদেশের সাধারণ নির্বাচনে সিলেট ১ একটি মর্যাদাপূর্ণ আসন হিসেবে পরিচিত। অতীতে এ আসন থেকে যে দলের প্রার্থী জয়লাভ করেছে তারা সরকারের ভেতরও গুরুত্বপূর্ণ জায়গা করে নিয়েছে। এ আসন থেকে জয়লাভ করে আওয়ামী লীগের প্রয়াত নেতা হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী জাতীয় সংসদের স্পিকার হয়েছিলেন।
সিলেট-১ আসনে প্রত্যেক দলের হেভিওয়েটরা প্রার্থী হন। রেওয়াজ আছে- এই আসনে বিজয়ী প্রার্থীর দল সরকার গঠন করে। বিজয়ী প্রার্থী পান বড় পদ। এ আসনে মনোনয়ন দৌড়ে আছেন বিএনপি চেয়ারপারসনের দুই উপদেষ্টা আরিফুল হক চৌধুরী ও খন্দকার আব্দুল মুক্তাদির। সাবেক মেয়র আরিফুল হক প্রয়াত অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানের একান্ত সহচর ছিলেন। আর খন্দকার মুক্তাদির সিলেট বিএনপির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও প্রয়াত খন্দকার আব্দুল মালিক এমপির পুত্র। প্রায় তিন দশক আগের সাইফুর-খন্দকারের দ্বন্দ্বের ধারাবাহিকতায় আরিফুল ও মুক্তাদির সিলেট বিএনপির দুই বলয়ের শীর্ষ নেতৃত্বে। সম্প্রতি মুক্তাদিরের আমেরিকা সফরের সুযোগে মাঠের দখল নিয়েছেন আরিফুল। ঢাকায় মহাসচিবের বৈঠক থেকে ফিরেই বুধবার বিরাট শোডাউন করেন আরিফুল। সমাবেশে তিনি সিলেট-১ আসনে প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দেন। একই দিনে মুক্তাদির নিউইয়র্কে প্রবাসীদের এক মতবিনিময় সভায় একই আসনে প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দেন। দু’একদিনের মধ্যেই তার দেশে ফেরার কথা। আরিফুলও কিছু দিন আগে লন্ডন সফর করেন। ঢাকায় দলের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের বৈঠকে আরিফুলকে সিলেট-৪ আসনের তালিকায় ডাকা হলে তিনি দ্বিমত পোষণ করে বলেন, সিলেট-১ দিন নতুবা মেয়র পদে নির্বাচন।
তবে ইতোমধ্যেই জামায়াত মর্যাদার এ আসনে তাদের ঘোষিত প্রার্থী বদল করেছে। সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এহসানুল মাহবুব জুবায়েরের বদলে জেলা আমির মাওলানা হাবিবুর রহমানকে সিলেট-৬ থেকে প্রত্যাহার করে আনা হয়েছে সিলেট-১ আসনে। জুবায়েরকে দেওয়া হয়েছে নির্বাচন মনিটরিংয়ের দায়িত্বে। সিলেট-২ আসনকে এখনো ‘ইলিয়াসের আসন’ বলা হচ্ছে। বিএনপির সাবেক এমপি ইলিয়াস আলী নিখোঁজ। এই আসনে বিএনপির মনোনয়ন নিয়ে তুমুল যুদ্ধ চলছে। তবে প্রার্থী পরিবর্তন এখন অনেকটা দৃশ্যমান। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা থেকে পদোন্নতি দিয়ে হুমায়ুন কবিরকে করা হয়েছে যুগ্ম মহাসচিব। বহুল আলোচিত প্রয়াত হারিছ চৌধুরী এই পদে দীর্ঘদিন ছিলেন। ইলিয়াসপত্নী তাহসিনা রুশদীর এলাকায় গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। ইলিয়াসের ইমেজের কারণে এই আসনে অন্য প্রার্থীরা সুবিধা করতে পারবেন বলে মনে হচ্ছে না। আসনটি অতীতে দুই দফা ছেড়ে দিয়েছিল শরিকদের, তারাও বিজয়ী হয়েছিলেন।
সিলেট-৩ আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা আরও তীব্র। জেলা বিএনপির সভাপতি আব্দুল কাইয়ুম চৌধুরী, যুক্তরাজ্য বিএনপির সভাপতি এম এ মালেক এবং ব্যারিস্টার এম এ সালাম দলীয় মনোনয়ন নিয়ে মুখোমুখি। কাইয়ুম তৃণমূলে বেশ জনপ্রিয়, মালেক প্রবাসী ভোটারদের মধ্যে গ্রহণযোগ্য, আর সালাম কেন্দ্রীয় পর্যায়ে খালেদা জিয়ার ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা হিসাবে শক্ত অবস্থানে রয়েছেন। এছাড়া এই আসনে সাবেক তুখোড় ছাত্রনেতা ও জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক আব্দুল আহাদ খান জামাল ও জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি এম এ হকের পুত্র ব্যারিস্টার রিয়াসাদ আজিম আদনান ও যুক্তরাজ্য বিএনপিনেতা ড. মোহাম্মদ ফয়েজ উদ্দিন এমবিই মনোনয়নপ্রত্যাশী। এখানে সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মাওলানা লোকমান আহমদকে প্রার্থী করেছে জামায়াত। আর এনসিপির প্রার্থী ব্যারিস্টার নুরুল হুদা জুনেদ।
সিলেট-৪ আসনে বিএনপির হুড়োহুড়ি সবচেয়ে বেশি। মহাসচিবের সঙ্গে বৈঠকের পর এই আসনে আরিফুল হক চৌধুরীর প্রার্থিতার গুঞ্জন উঠলেও তিনি নিজেই জানিয়েছেন, তিনি সিলেট-১ আসনেই নির্বাচন করতে চান। ফলে সাংগঠনিক সম্পাদক মিফতাহ সিদ্দিকী, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান হাকিম চৌধুরী, মহানগর বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক বদরুজ্জামান সেলিম, বিএনপি থেকে স্বেচ্ছায় অব্যাহতি নেওয়া বহুল আলোচিত বিএনপি নেতা অ্যাডভোকেট শামসুজ্জামান জামান, সাবেক এমপি দিলদার হোসেন সেলিমের সহধর্মিণী অ্যাডভোকেট জেবুন্নাহার সেলিম এবং ব্যারিস্টার কামরুজ্জামান সেলিম মনোনয়নপ্রত্যাশী। এ আসনে জামায়াতের একক প্রার্থী সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদীন। বিএনপির একঝাঁক প্রার্থী ও ভোটের মাঠে জামায়াতের জয়নাল অনেকটা আতঙ্ক।
সিলেট-৫ আসনে বিএনপির মনোনয়ন যুদ্ধে মাঠে রয়েছেন চাকসুর সাবেক নেতা মামুনুর রশীদ মামুন, প্রয়াত হারিছ চৌধুরীর ভাই সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী, সাবেক ছাত্রনেতা সিদ্দিকুর রহমান পাপলু, সংযুক্ত আরব আমিরাত বিএনপির আহ্বায়ক জাকির হোসেন এবং হারিছ চৌধুরীর মেয়ে সামিরা তানজীন চৌধুরী। জামায়াতে ইসলামী হাফিজ মাওলানা আনোয়ার হোসেন খানকে প্রার্থী করলেও এ আসন জামায়াতবিরোধী ইসলামপন্থি দলগুলোর ঘাঁটি। তাই এখানের শক্ত প্রার্থী জমিয়তের কেন্দ্রীয় সভাপতি মাওলানা ওবায়দুল্লাহ ফারুক। ভোটের প্রভাব বেশি ফুলতলীর পীরের অনুসারীদের। সর্বশেষ এই আসনে বিএনপি জমিয়তকে ছাড় দিতে পারে এমন গুঞ্জন রয়েছে।
সিলেট-৬ আসনে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী একঝাঁক। অধিকাংশই চৌধুরী বংশের। এর মধ্যে রয়েছেন কেন্দ্রীয় নেতা আবুল কাহের শামীম, ফয়সল আহমদ চৌধুরী, জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট এমরান আহমেদ চৌধুরী, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ড. এনামুল হক চৌধুরী, সাবেক এমপি ড. সৈয়দ মকবুল হোসেনের মেয়ে সৈয়দা আদিবা হোসেন, যুক্তরাজ্য বিএনপির সাবেক সভাপতি সাবিনা খান পপি, চিত্রনায়ক হেলাল খান। সম্প্রতি জামায়াতের প্রার্থী মাওলানা হাবিবুর রহমানের বদলে ছাত্রশিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি ও ঢাকা মহানগর উত্তরের আমির সেলিম উদ্দিনকে দেওয়া হয়েছে।
এ ব্যাপারে বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক মেয়র জি কে গউছ যুগান্তরকে বলেন, সিলেটের ১৯ আসনেই ধানের শীষের একক প্রার্থী দেওয়া এবং নির্বাচন করার ব্যাপারে বিএনপি প্রস্তুত। কোনো দলকে ছাড় দেওয়ার ব্যাপারে কোনো নির্দেশনা আসেনি। আর জোটে যাওয়া, জোটের জন্য আসন ছাড় দেওয়ার ব্যাপারে হাইকমান্ডের সঙ্গে আলোচনা চলছে। তবে দলের স্বার্থে সর্বোচ্চ ছাড় দিতে মাঠের নেতারা প্রস্তুত বলে বিশ্বাস করি।