
ভাষা আন্দোলন, ৬৯ এর গণ অভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ বাংলাদেশের সব ঐতিহাসিক মুহূর্তে বামপন্থি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত আছেন এমন অনেকেরই নেতৃত্ব ও অংশীদারিত্ব ছিল। এ সময়গুলোতে বাম রাজনীতিবিদদের গ্রহণযোগ্যতাও ছিল বেশ। তবে সময়ের ব্যবধানে সেই সমৃদ্ধ ইতিহাস ও ঐতিহ্য যেন ফিকে হয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে অস্তিত্ব সংকটে পড়ে কোনোমতে টিকে থাকার চেষ্টা করছে ঐতিহ্যবাহী এ বাম দলগুলো, বিশেষ করে এ ঘরনার ছাত্রসংগঠনগুলোর দশা বেশ শোচনীয়।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে তাদের কার্যক্রম বা কর্মসূচির অধিকাংশই প্রতিবাদমুখী হলেও অন্যান্য সংগঠনের তুলনায় শিক্ষার্থীদের কাছে তারা কতটুকু যেতে পেরেছে, সেটা নিয়ে উঠছে প্রশ্ন। এরই মধ্যে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ঢাবি ও জাবির ছাত্র সংসদ নির্বাচনে একসময়ের দাপুটে ও প্রগতিশীল পরিচিত এ বাম সংগঠনগুলোর ভরাডুবি হয়েছে। যা নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা হচ্ছে। একইসাথে প্রশ্ন উঠছে, তাহলে কি ছাত্র রাজনীতিতে গুরুত্ব হারাচ্ছে তারা?
এছাড়া, বর্তমানে বাম সংগঠনগুলোর বিভিন্ন কর্মসূচি, এমনকি জাতীয় কাউন্সিলেও নেতাকর্মীদের উপস্থিতি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে দেখা যায় না। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে তাদের কর্মী সংকটও রয়েছে। সাধারণ শিক্ষার্থীদেরকেও তাদের সঙ্গে খুব একটা যুক্ত হতে দেখা যাচ্ছে না। উল্টো তাদেরকে ‘শাহবাগী’ ট্যাগ দিয়ে আওয়ামী লীগের সাথে মিলিয়ে ফেলার প্রবণতাও দেখা যাচ্ছে। আর তারা ইসলামী ছাত্রশিবিরকে ‘স্বাধীনতাবিরোধী’ শক্তি হিসেবে পরিচিত করে দেওয়ার চেষ্টা করলেও শিক্ষার্থীদের কাছে শিবিরেরই জনপ্রিয়তা বাড়ছে।
বিষয়টি নিয়ে বামপন্থি সংশ্লিষ্টদের মাঝেও উদ্বেগের ছাপ দেখা যাচ্ছে। কারণ, এক সময় বাম সংগঠনগুলো কোনো মিছিল বা কর্মসূচির ডাক দিলে হাজারো শিক্ষার্থী তাদের সঙ্গে যুক্ত হত। কিন্তু এখন আর সেই জনপ্রিয়তা এসব সংগঠনের নেই। এছাড়া, তাদের নিজেদের মধ্যকার বিভাজনও প্রকাশ্যে এসেছে।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, শিক্ষার্থীদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কর্মসূচি থেকে দূরে থাকা; অভ্যন্তরীণ বিভাজন; সেকেলে কাঠামো ও কর্মসূচি; ধর্মবিশ্বাসে গুরুত্ব না দেওয়া এবং শিক্ষার্থীবান্ধব ও যুগোপযোগী কর্মকাণ্ড পরিচালনা না করার কারণে বাম সংগঠনগুলোর জনপ্রিয়তা হারাতে হচ্ছে।
“সেকেলে কাঠামো, রাজনৈতিক কর্মসূচি ও স্লোগান সংস্কার হয়নি। আর বাংলাদেশের মানুষ শতভাগ রিলিজিয়ন প্র্যাকটিসিং না হলেও ধর্মপ্রাণ। ধর্মবিশ্বাসকে গুরুত্ব না দেওয়া এবং ধর্ম নিয়ে কটূক্তি হলে বাম সংগঠনগুলোর চুপ থাকার কারণে তাদের জনপ্রিয়তা কমছে” - জামাল রুহানী, শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
অন্যদিকে, ক্ষমতাসীন বা বড় দলগুলোর সঙ্গে এসব সংগঠনের মাদার পার্টির আঁতাত; আদর্শচ্যুতি; অছাত্রদের দিয়ে কমিটি গঠন; পুঁজিবাদের প্রভাব; একগুঁয়ে চিন্তা-ভাবনা; বাস্তবতা বিমুখতা এবং মধ্যমপন্থি রাজনৈতিক দলগুলোর অগণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ডে অনাস্থায় ডানপন্থিদের উত্থানকে বামপন্থিদের জনপ্রিয়তা কমার কারণ হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা।
তবে বাম সংগঠনগুলোর নেতৃবৃন্দ তাদের সীমাবদ্ধতা ও দুর্বলতার কথা স্বীকার করেছেন। সোভিয়েত পতনের প্রভাব; নব্বই দশক থেকে সাংগঠনিক পরিধির হ্রাস; রক্ষণশীল ডানপন্থি প্রবণতা বৃদ্ধি এবং শিক্ষা বা শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক রাজনীতিতে অন্যমনস্ক হওয়াসহ কিছু বিষয়কে জনপ্রিয়তা কমার কারণ হিসেবে বিবেচনা করছেন তারা।
সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। জানা গেছে, ডাকসু নির্বাচনে বামপন্থি বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী, ছাত্র কাউন্সিল, ছাত্র যুব আন্দোলন, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ, গণতান্ত্রিক ছাত্র মঞ্চের নেতৃবৃন্দসহ আরও কয়েকজন শিক্ষার্থী সমন্বয়ে গঠিত হয় ‘প্রতিরোধ পর্ষদ’ প্যানেল। এছাড়া, তিনটি বামপন্থি সংগঠন মিলে ‘অপরাজেয় ৭১ অদম্য ২৪’ ১৫ সদস্যের আংশিক প্যানেল ঘোষণা করে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন (একাংশ), সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট (বাসদ) এবং বাংলাদেশ ছাত্রলীগ-বিসিএলের নেতাকর্মীরা।
অন্যদিকে, সম্প্রতি জাকসু নির্বাচনে বামপন্থিদের প্রার্থী সংকট, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, ছাত্র ইউনিয়নের দীর্ঘদিনের বিভাজন এবং সাংস্কৃতিক জোটের ভাঙনের ফলে এক জোট হতে পারেনি তারা, বাধ্য হয়ে একাধিক ভিন্ন প্যানেলে লড়তে দেখা যায় তাদেরকে।
ফলাফল বিশ্লেষণ করে জানা যায়, ডাকসু নির্বাচনে ভিপি, জিএস ও এজিএস এবং ১২টি সম্পাদক পদের মধ্যে ৯টিতে জয় পেয়েছেন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির–সমর্থিত ‘ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোটের’ প্রার্থীরা। যেখানে বামপন্থিদের ভরাডুবি হয়েছে। তবে প্রতিরোধ পর্ষদ প্যানেল (বাম সমর্থিত) থেকে একমাত্র সদস্য পদে জয়ী হয়েছেন পার্বত্য চট্টগ্রামের হেমা চাকমা।
“বাম রাজনীতিকরা যখন ছেঁড়া বা ঢিলা গেঞ্জি-প্যান্ট পরে বই বা ছাতা নিয়ে ঘুরে তাদের একটা আদর্শিক অবস্থান দেখানোর চেষ্টা করে, এ বিষয়গুলো এখন আর মানুষকে আকর্ষিত করে না। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সাথে বামদের খাপ খাওয়ানোর জন্য যে অ্যাডাপ্টিভ মেথড রান করানোর কথা ছিল, সেটা তারা পারেনি” - শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
অন্যদিকে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদ (জাকসু) নির্বাচনেও সংখ্যাগরিষ্ঠ পদে বিজয়ী হন ইসলামী ছাত্রশিবির–সমর্থিত ‘সমন্বিত শিক্ষার্থী জোট’ প্যানেলের প্রার্থীরা। তারা জাকসুর ২৫টি পদের মধ্যে সাধারণ সম্পাদক (জিএস), দুটি যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকসহ (এজিএস) ২০টি পদে জয় পেয়েছেন। এ ছাড়া স্বতন্ত্র প্রার্থীদের প্যানেল থেকে সহসভাপতি (ভিপি) পদ এবং দুটি করে পদে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ (বাগছাস)–সমর্থিত প্যানেলের প্রার্থী ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছেন। কিন্তু বামপন্থি কোনো প্যানেলের কোনো প্রার্থীকে জাকসুতে নির্বাচিত হতে দেখা যায়নি, যদিও অনিয়ম ও পক্ষপাতিত্বেরে অভিযোগে নির্বাচনই বর্জন করেছেন তারা। যদিও এ প্রতিষ্ঠানকে বামপন্থিদের ‘ঘাঁটি’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
তবে ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায়, স্বাধীনতার আগে থেকে শুরু করে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত অনুষ্ঠিত প্রায় সব ডাকসু নির্বাচনে বামপন্থিরা বিজয়ের মুখ দেখেছেন। ওই সময়ে মতিয়া চৌধুরী, মাহফুজা খানম, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমসহ অনেকেই তাদের প্যানেল থেকে নির্বাচিত হয়ে আন্দোলন-সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তবে ১৯৯০-এর পর থেকে ধীরে ধীরে তাদের জনপ্রিয়তা হ্রাস পায়। বর্তমানে তারা নিজেদের ভেতর বিভাজন ও দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছেন। সর্বশেষ ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনে কর্মী সংকটের কারণে কোনো হলে প্যানেলেই ঘোষণা করতে পারেনি তারা। ঐক্যবদ্ধভাবে প্যানেল ঘোষণার চেষ্টা থাকলেও সমন্বয়হীনতার কারণে সেখানেও ব্যর্থতা দেখা দেয়।
আর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে ১৯৭২ সালে বামপন্থি সংগঠন জাসদ ছাত্রলীগ থেকে জাকসুর ভিপি-জিএস নির্বাচিত হয়েছিলেন গোলাম মোর্শেদ এবং রোকনউদ্দীন। এছাড়া ১৯৭৩ সালেও এ সংগঠন থেকে রফিকউল্লাহ নামে একজন ভিপি পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন।
“সাম্প্রতিক সময়ে দেশে রক্ষণশীল ডানপন্থি প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। আমরা নিজেদেরকে প্রগতিশীল সংগঠন হিসেবে দেখি। সমাজে যদি ডানপন্থি প্রবণতা বৃদ্ধি পায়, তাহলে প্রগতিশীল পক্ষের বিকাশ যথাযথভাবে ঘটে না, বর্তমানে এ বিষয়টি একটি ফ্যাক্টর” - মাহির শাহরিয়ার রেজা, সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন।
বিগত সময়ের পর্যালোচনা বলছে, গত এক দশকে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে ভাঙন ধরেছে একাধিক বাম সংগঠনে। তাদের মধ্যে আছে পুরোনো সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র ফেডারেশন ও সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট। ২০২১ সালে কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করে সংগঠনে বিদ্রোহ ও পরে পৃথক কাউন্সিলের মাধ্যমে দুই ভাগ হয়েছে ছাত্র ইউনিয়ন। একই অবস্থা ছাত্র ফেডারেশনেরও। এই সংগঠনেরও অংশ দুটি। একটি জোনায়েদ সাকির গণসংহতি আন্দোলনপন্থি, অন্যটি বদরুদ্দীন উমরের জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলপন্থি। একই চিত্র সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টেরও। ২০১৮ সালে ভাগ হওয়ার পর থেকে এই সংগঠনটির একটি মার্কসবাদী, আরেকটি অংশ খালেকুজ্জামানপন্থি হিসেবে পরিচিত।
ছাত্র ফ্রন্টের ভাঙা অংশ আরও একবার ভাঙে ২০২১ সালে। এসময় ভাঙা অংশ থেকে ভেঙে আরও একটি সংগঠন হয়। যেটি ‘গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিল’ হিসেবে মধুর ক্যান্টিন থেকে আত্মপ্রকাশ করে। এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি ছাত্র কাউন্সিল, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ (জাসদ)-সহ হাতে গোনা কয়েকটি সংগঠনে অন্তর্দ্বন্দ্ব না থাকলেও টুকটাক কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে ধুঁকে ধুঁকে টিকে আছে। এসব সংগঠনের কর্মসূচিগুলোতে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা খুবই নগণ্য।
“ছাত্রদের সংকটগুলো চিহ্নিত করে বামপন্থিদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন এবং ছাত্রদের সংগঠিত করতে হবে। ছাত্রদের সাথে আরো গভীর সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে এবং তাদের সুখ-দুঃখের সাথী হতে হবে। শিক্ষার সংকট, সামাজিক অবক্ষয় এবং নৈতিক সংকট– এসবের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে” - সালমান সিদ্দিকী, সভাপতি, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট।
এরপর সংকট কাটিয়ে উঠতে বামপন্থি আটটি সংগঠন নিয়ে ২০২২ সালের নভেম্বরে আত্মপ্রকাশ হয় গণতান্ত্রিক ছাত্র জোটের। সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট (মার্ক্সবাদী), বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট (বাসদ), বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন (মুক্তি কাউন্সিল), গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিল, বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ, বিপ্লবী ছাত্র যুব আন্দোলন এ জোটের অংশীজন। তবে এই জোটেও হয় ভাঙন। গত জুলাইয়ে গণতান্ত্রিক ছাত্র জোট থেকে বেরিয়ে যায় ছাত্র ফেডারেশন। তাদের অভিযোগ ছিল, জুলাই গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে গণতান্ত্রিক ছাত্র জোট উপযুক্ত রাজনৈতিক কর্মসূচি হাজির করতে ব্যর্থ হয়েছে এবং নিছক ইস্যুভিত্তিক কর্মসূচি পালনের একটি মঞ্চে পরিণত হয়েছে। আর বাসদ নেতাদের যৌন হয়রানি নিয়ে বিবৃতি দিয়ে গণতান্ত্রিক ছাত্র জোট প্রতিবাদ জানালে, জোট থেকে বেরিয়ে যায় সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট (বাসদ)। অন্যদিকে জোটে থাকা বিপ্লবী ছাত্র যুব আন্দোলনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো কমিটি নেই বলে জানা গেছে। নিজস্ব কর্মসূচিও পালন করতে দেখা যায় না তাদেরকে। পাশাপাশি বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের কার্যক্রমও তেমন চোখে পড়ে না।
বাম সংগঠনগুলোর এমন দুরাবস্থার কারণ হিসেবে মতামত জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের ২০১৭-১৮ সেশনের শিক্ষার্থী জামাল রুহানী দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, বাম সংগঠনগুলো স্থান-কাল-পাত্রভেদে তাদের সেকেলে কাঠামো, রাজনৈতিক কর্মসূচি ও স্লোগান সংস্কার করেনি। আর বাংলাদেশের মানুষ শতভাগ রিলিজিয়ন প্র্যাকটিসিং না হলেও ধর্মপ্রাণ। ধর্মবিশ্বাসকে গুরুত্ব না দেওয়া এবং ধর্ম নিয়ে কটূক্তি হলে বাম সংগঠনগুলোর চুপ থাকার কারণে তাদের জনপ্রিয়তা কমছে।
নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী মো. হোসাইন বলেন, আজকের তরুণ প্রজন্ম যেখানে উন্নয়ন, কর্মসংস্থান ও প্রযুক্তি নির্ভর রাজনীতিতে বেশি আগ্রহী, সেখানে বামপন্থিরা নিজেদের অবস্থান তৈরি করতে পারেনি। একইসাথে অসংখ্য ভাঙন, দুর্বল নেতৃত্ব ও সমসাময়িক রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কার্যকর বিকল্প হয়ে উঠতে না পারায় তারা পিছিয়ে পড়েছে। তাছাড়াও, গ্রহণযোগ্যতা হারানোর পিছনে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কারণ হল- বিএনপি ও জামায়াতের নেতাকর্মীদের জুডিশিয়াল কিলিংয়ের বৈধতা দিতে তাদের সে সময়কার কার্যক্রম। যা বর্তমান সময়ে দেশের জনগণের কাছে তাদের গ্রহণযোগ্যতা তলানিতে নামিয়েছে।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে চাইলে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি মাহির শাহরিয়ার রেজা বলেন, বামপন্থি সংগঠনগুলোর আগে যে সাংগঠনিক পরিধি ছিল, তা বর্তমানে নেই। সাংগঠনিক শক্তিও অনেক বেশি কমে এসেছে। আমি মনে করি, এটা সব বামপন্থি সংগঠনের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত যে সাফল্য সেটা আমরা ধরে রাখতে পারিনি। দ্বিতীয়ত, সাম্প্রতিক সময়ে দেশে রক্ষণশীল ডানপন্থি প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। আমরা নিজেদেরকে প্রগতিশীল সংগঠন হিসেবে দেখি। সমাজে যদি ডানপন্থি প্রবণতা বৃদ্ধি পায়, তাহলে প্রগতিশীল পক্ষের বিকাশ যথাযথভাবে ঘটে না, বর্তমানে এ বিষয়টি একটি ফ্যাক্টর। আওয়ামী লীগের সময়েও এই সমস্যাটি হয়েছিল। সেময়ও আমরা স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারিনি। সে কারণে শিক্ষার্থীদের সাথেও সংযোগ ঘটেনি, যেহেতু হলগুলোতে আমরা থাকতে পারিনি। সে কারণে ছাত্র সংসদগুলোতে আমাদের এক ধরনের ব্যর্থতা হয়েছে বলে আমরা মনে করি।
বাম সংগঠনগুলোতে এত বিভাজন কেন জানতে চাইলে এর জবাবে রেজা বলেন, প্রত্যেকটা সংগঠনেরই নিজস্ব রাজনৈতিক চিন্তা, মত, উদ্দেশ্য ও কর্মপরিকল্পনা থাকে। বাম সংগঠনগুলোর বেলায়ও একই কথা। এরকম কিছু কিছু কারণে সংগঠনগুলোতে বিভাজন রয়েছে। যখন সংগঠনের গঠন প্রক্রিয়া, লক্ষ্য-উদ্দেশ্য, কর্মপরিকল্পনা ও রাজনৈতিক কর্মসূচি আলাদা হবে তখন সংগঠনও আলাদা হওয়া স্বাভাবিক।
শিক্ষার্থীদের সাথে যুক্ত হওয়ার জন্য আপনার কী করছেন? এ প্রশ্নের জবাবে মাহির শাহরিয়ার রেজা বলেন, আওয়ামী লীগের সময় থেকেই বাম সংগঠনগুলো জাতীয় রাজনীতিতে বেশি সময় ব্যয় করে ফেলেছে বলে মনে করি। ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থার অবসান ঘটাতে যেটির আসলে প্রয়োজনও ছিল। কিন্তু আমরা ছাত্র সংগঠন। আমাদের প্রাথমিক লক্ষ্য হওয়া উচিত শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক। দীর্ঘসময় ধরে যেটিতে আমরা পিছিয়ে পড়েছি। আমি মনে করি, আগামী দিনে আমাদের কার্যক্রম এমন হওয়া উচিৎ যেটির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের অধিকার ও স্বার্থ আদায়ে ভূমিকা রাখা যায়। এতে করে আমাদের ওপর তাদের হারানো আস্থা ফিরে পাব বলে বিশ্বাস করি।
এ বিষয়ে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের সভাপতি সালমান সিদ্দিকী বলেন, নব্বইয়ের দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের প্রভাব বিশ্বের বামপন্থি আন্দোলনের ওপর পড়ে, এদেশেও সেটা পড়ে। বিগত দিনে সাংগঠনিক দুর্বলতা এবং সঠিক দৃষ্টিভঙ্গির অভাবে শক্তিশালী বাম আন্দোলন গড়ে তোলা যায়নি। বর্তমান সময়ে পুঁজিবাদী রাজনীতির প্রভাবে ভোগবাদী মানসিকতা, স্বার্থপরতা এবং সমাজবিচ্ছিন্নতা অনেক বেড়েছে। ফলে রাজনীতি দাঁড়িয়েছে ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধি এবং কিছু পাওয়ার উপায়ের লক্ষ্য হিসেবে। শাসকশ্রেণির সংগঠনগুলো ছাত্রদের মাঝে ‘পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতি’ চালু করেছে। এসব সমস্যা আমাদের মোকাবেলা করতে হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, এ পরিস্থিতিতে ছাত্রদের সংকটগুলো চিহ্নিত করে বামপন্থিদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন এবং ছাত্রদের সংগঠিত করতে হবে। ছাত্রদের সাথে আরো গভীর সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে এবং তাদের সুখ-দুঃখের সাথী হতে হবে। শিক্ষার সংকট, সামাজিক অবক্ষয় এবং নৈতিক সংকট– এসবের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
গবেষক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের চেয়ারম্যান ড. সাজ্জাদ সিদ্দিকী দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, বামপন্থিদের অবস্থা খুব একটা খারাপ সেটা আমি বলব না। ৫ আগস্ট ২০২৪ পরবর্তী প্রেক্ষাপটে পোস্ট-আইডোলজির প্রভাব অনেক বেশি বিস্তৃত। ফলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে বামপন্থিরা বিলীন হয়ে গেছে অথবা যাচ্ছে। বিষয়টা ঠিক এরকম নয়। পরিস্থিতির কারণে হয়ত তারা নানা শঙ্কায় একটু চুপ আছে। তবে এই পক্ষ যে খুব বেশি শক্তিশালী সেটাও আমি বলছি না। যদি এমনটা হতো, তাদের ক্ষমতার লড়াই অনেক বেশী স্পষ্ট থাকত। তারা মূলত এক ধরনের সিভিল সোসাইটি হিসেবেই কাজ করে, যা দরকারি বলেই আমি মনে করি।
তিনি বলেন, বামপন্থিদের কিছু ন্যারেটিভ আছে, যেগুলোর অধিকাংশই একগুঁয়ে এবং সেকেলে। যেগুলো জনগণ আর আগের মত গ্রহণ করছে না। ভোগবাদী অর্থনৈতিক বাস্তবতায় মানুষ বিবেচনা করে বস্তুগত নগদ প্রাপ্তির সাপেক্ষে। বিশেষ করে, সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রতিদিনের সমস্যা, যেমন: আবাসন, খাবারের মান, বিশুদ্ধ পানি, ইত্যাদি বিষয়ে কোনো হস্তক্ষেপ করছে কিনা। মানুষ চায় ইমিডিয়েট সলিউশন বা অ্যাকশন। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বৈধ-অবৈধতার প্রশ্ন এই প্রজন্মের কাছে প্রায় মলিন। কর্পোরেট কালচারের জন্য এরকম চিন্তা-ভাবনা মানুষের মাঝে তৈরি হয়ে গেছে। আগে রাজনীতিবিদদের সম্পদের দিকে ঝোঁক কম ছিল, কিন্তু এখন রাজনৈতিক দলের নেতা মানেই অন্ততপক্ষে একটি গাড়ি বা বাইক থাকতে হবে। কিন্তু এসময়ে এসেও বাম রাজনীতিকরা যখন ছেঁড়া বা ঢিলা গেঞ্জি-প্যান্ট পরে বই বা ছাতা নিয়ে ঘুরে তাদের একটা আদর্শিক অবস্থান দেখানোর চেষ্টা করে, এ বিষয়গুলো এখন আর মানুষকে আকর্ষিত করে না। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সাথে বামদের খাপ খাওয়ানোর জন্য যে অ্যাডাপ্টিভ মেথড রান করানোর কথা ছিল, সেটা তারা পারেনি।
ড. সাজ্জাদ সিদ্দিকী আরও বলেন, যারা দক্ষিণ বা ডানপন্থি হিসেবে চিহ্নিত কিংবা মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক যারা স্টিগমাটাইজড ছিল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তাদের বিজয়ের পেছনে অন্যতম প্রধান কারণ হল বিএনপি ও আওয়ামী লীগের অগণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ধারা। কারণ, বিএনপি ১৯৯৬ সালে নির্বাচন নিয়ে টালবাহানা না করত এবং ২০০৬ সালে পছন্দের ব্যক্তিকে প্রধান উপদেষ্টা বানানোর জন্য বিচারপতিদের অবসর গ্রহণের বয়স না বাড়াত, তাহলে শেখ হাসিনা সাহস পেত না একের পর এক নির্বাচন ছাড়া ক্ষমতায় থাকার। এই বিএনপি বা আওয়ামী লীগের সময়ে যদি রেগুলার নির্বাচনগুলো হতো এবং গণতান্ত্রিক চর্চাগুলো থাকত, তাহলে জামায়াত-শিবিরের ধর্ম ও মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক এত সেনসিটিভিটি থাকা সত্ত্বেও ছাত্র সংসদগুলোতে শিবির এভাবে বিজয়ী হতে পারত না বলেই আমার অনুমান।
বিষয়টি নিয়ে মতামত জানতে কথা হয় রাজনীতি বিশ্লেষক, গবেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ আইনুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আমরা বিভিন্ন সময়ে দেখেছি বাম সংগঠনগুলোর কেউ কেউ সরকার বা বড় দলগুলোর সঙ্গে নিজেদেরকে মার্জ করে ফেলেছেন, যেটিকে তাদের আদর্শচ্যুতি হিসেবেই ধরা যায়। সেই বড় দলগুলোর অনেক দায় তাদের ওপরও এসে চাপছে। এক্ষেত্রে সব বামপন্থি সংগঠনগুলোর ওপর প্রভাব পড়ছে। উদাহরণ হিসেবে হাসানুল হক ইনু ও রাশেদ খান মেননসহ কয়েকজন বড় বড় নেতার আওয়ামী লীগের সাথে সম্পর্কের কথা উল্লেখ করা যায়। বিষয়টিকে মানুষ ভালোভাবে নেয়নি। আর ডাকসু নির্বাচনের ইশতেহারে গণতন্ত্র নিয়ে বাম ছাত্র সংগঠনগুলোর চিন্তাভাবনার কথা দেখা গেছে, এটাও তাদের সমাজতান্ত্রিক আদর্শের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
তিনি বলেন, অনেক বাম ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতৃত্বে অছাত্ররা রয়েছেন এবং তাদের কমিটিও নিয়মিত হয়না। অনেক সময় এমনও হয় যে, তারা ছাত্রত্ব লম্বা সময় টিকিয়ে রাখতে গিয়ে শিক্ষার্থীদের কাছে জনপ্রিয়তা হারান। শিক্ষার্থীরা আসলে নতুন এবং প্রাসঙ্গিক কিছু চায়। আগে বামপন্থি ছাত্রনেতারা নিয়মতান্ত্রিক ছাত্ররাজনীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন, কিন্তু বর্তমানে সেটা কম দেখা যাচ্ছে। আর ভারতের পশ্চিমবঙ্গে এক সময় বাম রাজনীতির একটা প্রভাব ছিল, কিন্তু এক পর্যায়ে তা অনেকটা ডিক্লাইনড হয়েছে। সেটার প্রভাব বাংলাদেশেও কিছুটা পড়েছে।
বাম সংগঠনগুলো বিভিন্ন অন্যায়-অনাচারের প্রতিবাদ জানিয়ে থাকে, এটা ভাল দিক। তবে প্রায়ই একটা অভিযোগ শোনা যায়, ইসলামপন্থি কেউ ভুক্তভোগী হলে তখন তাদের স্বর অন্যরকম হয়ে যায়। এতে করে তারা যে সমতার কথা বলে, সেটার প্রতিফলন তাদের কাজেই প্রশ্নবিদ্ধ হয়। যার ফলে মুসলিমপ্রধান এ দেশের বড় একটা অংশ তাদের ওপর নেতিবাচক ধারণা পোষণ করে। আর একটা অঞ্চলে সামাজিক মূল্যবোধের বাইরে গিয়ে কাজ করাটা কঠিন। এছাড়া, সমাজ তো পুঁজিবাদের দিকে ধাবিত হচ্ছে। যার কারণে, সমাজতন্ত্র ডিক্লাইন্ড হচ্ছে এবং এর প্রতি মানুষের আকর্ষণ কমছে। সমাজতন্ত্র ডিক্লাইন্ড হলে বাম সংগঠনগুলোও ঝামেলায় পড়বে এটাই স্বাভাবিক।