Image description

আবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে জাতীয় পার্টি। পার্টির কাউন্সিল ও নেতৃত্বের কোন্দল মাথাচাড়া দেওয়াতে ভাঙনের মুখে পড়েছে জাপা। ভাঙনের হাত থেকে রেহাই পেতে মুজিবুল হক চুন্নুকে অব্যাহতি দিয়ে ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারীকে মহাসচিব হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয় জাতীয় পার্টির সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, কো চেয়ারম্যান এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদারকে পার্টির প্রাথমিক সদস্যসহ সব পদ-পদবি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।

আওয়ামী লীগের সরকার পতনের পর রাজনীতির মাঠে বেকায়দায় থাকা কেন্দ্রীয় সম্মেলন আয়োজন নিয়ে দ্বিধা-বিভক্ত হয়ে পড়ে জাপা। চেয়ারম্যানের একক কর্তৃত্ব নিয়ে দলের মধ্যে বিদ্রোহ দেখা দেয়। চেয়ারম্যান জিএম কাদেরকে সরানোর জন্য একটি অংশ তৎপর হয়ে ওঠে। এটিকে সামাল দিতেই দলের মহাসচিব পদে পরিবর্তন আনা হয়েছে বলে জানা গেছে। 
এদিকে দায়িত্ব গ্রহণের পর শামীম হায়দার পাটোয়ারী জনকন্ঠকে বলেন, পার্টির চেয়ারম্যান আমাকে মহাসচিবের দায়িত্ব দিয়েছেন। সে জন্য তাকে ধন্যবাদ। তৃণমূলকে সঙ্গে নিয়ে দল ঢেলে সাজানো হবে। একই সঙ্গে হারানো আসনগুলো উদ্ধারের কাজ করব। সকলকে সঙ্গে নিয়ে নতুন জাপা গড়ে তোলা হবে। এ জন্য সবার সহয়োগিতা কামনা করছি।

এদিকে বর্তমান মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুকে দলের বৈধ মহাসচিব দাবি করে ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারির নিয়োগকে চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের চরম অগণতান্ত্রিক, অসাংবিধানিক এবং গঠনতন্ত্রের সরাসরি লঙ্ঘন বলে অভিহিত করেন ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার। সোমবার বিকেলে চুন্নুকে বাদ দিয়ে শামীমকে নতুন মহাসচিব নিয়োগের এক প্রতিক্রিয়ায় গণমাধ্যমে পাঠানো এক যৌথ বিবৃতিতে এ কথা বলেন তারা। 
আওয়ামী লীগের সঙ্গে সখ্যের ‘পাপ’ থেকে দলকে মুক্ত করতে এরশাদের ভাই জিএম কাদেরকে নেতৃত্ব থেকে সরানোর উদ্যোগ নিয়েছে পার্টির বড় একটি অংশ। জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও রুহুল আমিন হাওলাদার এ অংশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এ নিয়ে দল আরেক দফা ভাঙলে অবাক হবার কিছু নেই। সোমবার জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ (জিএম) কাদের নতুন মহাসচিব নিয়োগ দেন। বিষয়টি নিশ্চিত করেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের প্রেস সেক্রেটারি খন্দকার দেলোয়ার জালালী।

জাতীয় পার্টির দপ্তর থেকে জানানো হয়, দলের গঠনতন্ত্রের ক্ষমতাবলে মুজিবুল হক চুন্নুকে জাতীয় পার্টির মহাসচিব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। তার জায়গায় মহাসচিব করা হয়েছে শামীম হায়দার পাটোয়ারীকে। সাবেক সংসদ সদস্য শামীম হায়দার পাটোয়ারী জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও অতিরিক্ত মহাসচিব পদে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। তিনি জাতীয় পার্টির প্রয়াত চেয়ারম্যান  হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের উপদেষ্টা ছিলেন।

২০১৭ সালের ১৯ ডিসেম্বর গাইবান্ধা-১ আসনের সংসদ সদস্য গোলাম মোস্তফা আহমেদের মৃত্যু হলে শূন্য আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন ব্যারিস্টার শামীম। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি জাতীয় পার্টির লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করে পুনরায় এমপি হিসেবে নির্বাচিত হন।
বারবার ভাঙনের কারণে অস্তিত্ব সংকটে পড়া জাতীয় পার্টিতে সম্প্রতি বিরোধ আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। ২৮ জুন দলের জাতীয় সম্মেলন ঘোষণা দিয়েছিলেন জিএম কাদের। এর মধ্যেই জাপায় নতুন নেতৃত্ব গড়ার উদ্যোগ নেন কেন্দ্রীয় নেতাদের বেশির ভাগ সদস্য। বিশেষ করে কাউন্সিলে চেয়ারম্যান হিসেবে কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও রুহুল আমিন হাওলাদার মহাসচিব পদপ্রত্যাশী বলে জানালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে জিএম কাদেরের কপালে। বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগ দেন মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুও। এ পরিস্থিতিতে ভেন্যু জটিলতার কথা বলে ২৮ জুনের সম্মেলন স্থগিত করেন জিএম কাদের।
সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের হাতে গড়া দল জাতীয় পার্টি প্রতিষ্ঠার পর থেকে বারবার ভাঙনের মুখে পড়ে। এর মধ্যে নব্বইয়ের গণআন্দোলনে এরশাদের পতনের পর প্রথমবারের মতো ভাঙন ধরে জাতীয় পার্টিতে। দ্বিতীয় দফার ভাঙন হয় ১৯৯৭ সালে আনোয়ার হোসেন মঞ্জু ও শেখ শহিদুল ইসলামের নেতৃত্বে।

কাজী জাফর ও শাহ মোয়াজ্জেমের নেতৃত্বে ১৯৯৮ সালে, ২০০১ সালে নাজিউর রহমানের নেতৃত্বে চতুর্থ দফা এবং ২০১৩ সালের ২০ ডিসেম্বর বিশেষ কাউন্সিলের মাধ্যমে জাপায় পঞ্চমবারের মতো ভাঙন ধরে। ২০১৯ সালে এরশাদ মারা যাওয়ার পর সবশেষ ২০২৪ সালের ২০ এপ্রিল তার স্ত্রী রওশন এরশাদের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টির একটি অংশ ভাগ হয়ে যায়। এবারও জিএম কাদের সম্মেলন ডাকতে গড়িমসি করলে সপ্তমবারের মতো দল ভাঙনের মুখে পড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
প্রসঙ্গত, জাতীয় পার্টির গঠনতন্ত্রের ২০ (ক) ধারায় দলের চেয়ারম্যানকে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে কোনো ধরনের শোকজ কিংবা কারণ দর্শনোর নোটিস ছাড়াই যে কাউকে বহিষ্কার করতে পারবেন। এর আগে মসিউর রহমান রাঙ্গাকে মহাসচিব থেকে বহিষ্কার করে মুজিবুল হক চুন্নুকে মহাসচিব করেছিলেন জিএম কাদের। 
জাতীয় পার্টির নেতারা বলছেন, দলের গঠনতন্ত্রের ২০(ক) ধারা অনুযায়ী জাপা চেয়ারম্যান কারণ দর্শানো ছাড়াই দলের যে কাউকে পদ থেকে সরাতে পারেন, বহিষ্কার করতে পারেন। যে কাউকে যেকোনো পদ দিতে পারেন। এ জন্য তাকে জবাবদিহিতা করতে হয় না। এ ধারাকে ‘অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারী’ বলছেন দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা। তাদের মতে এটি একনায়কতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র। তারা বলেন, ‘আমরা পার্টি থেকে সেটা সরাতে চাই।

পার্টিতে যদি স্বৈরতন্ত্র থাকে, তাহলে গণতন্ত্রের কথা বলে তো লাভ নাই।’ যে কারণে দলের বর্তমান কমিটির সিনিয়র নেতাদের বড় একটি অংশ বর্তমান চেয়ারম্যানকে এই ধারা সংশোধন করার অনুরোধ করেন। দলের বর্তমান মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুও এই বিদ্রোহী গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত। এ কারণে শেষ পর্যন্ত মহাসচিব পদে পরিবর্তন আনলেন জিএম কাদের।