Image description

রাফসান গালিব

১.

গত রাতে (রোববার) শাহবাগ দিয়ে বাসায় ফিরছিলাম। রাত দশটা পার হয়ে গেছে। তখনো স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসার শিক্ষকেরা বিক্ষোভ চালিয়ে যাচ্ছেন। অবাকই হলাম। শাহবাগ মোড়ে শিক্ষকদের এ রকম বহু অবস্থান ধর্মঘট দেখা হয়েছে এর আগে। টানা কয়েক দিনও সেখানে অবস্থান করেন তারা। কিন্তু এত রাত পর্যন্ত প্রতিবাদী সমাবেশ দেখি নাই কখনো।

একের পর এক শিক্ষক প্রতিনিধি বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন। দিনে তাদের ওপর পুলিশ যেভাবে হামলা চালিয়েছে, সেটির ক্ষোভই প্রকাশ পাচ্ছে তাদের সবার কণ্ঠ থেকে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে শুনলাম। তাঁরা বলছেন, যে শিক্ষকদের হাতে প্রজন্মের পর প্রজন্মের ধর্মীয় শিক্ষার হাতেখড়ি, তাদের এভাবে পুলিশ দিয়ে পেটানো হলো, ফ্যাসিস্ট হাসিনা পতনের পর এমন আচরণের শিকার হবেন, তারা তা কোনোভাবেই ভাবতে পারেননি। তারা তাদের দাবি পূরণ চায়, তাদের ওপর হামলার বিচার চায় এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদত্যাগ চান।  

অনেকের মনে থাকতে পারে ১৯৭৮ সালে এক অধ্যাদেশের মাধ্যমে বেসরকারি প্রাইমারি স্কুল ও বেসরকারি ইবতেদায়ি মাদ্রাসাগুলো সরকারিভাবে রেজিস্ট্রেশনভুক্ত হয়। এরপর থেকে এসব প্রতিষ্ঠান দাবি করে আসছে জাতীয়করণের। অবশেষে ২০১৩ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেসরকারি প্রাইমারি বিদ্যালয়কে জাতীয়করণের ঘোষণা দেন।

স্কুলের সংখ্যা ছিল ২৬ হাজারের বেশি। সেসব স্কুলের শিক্ষকদের ঘরে ঘরে আনন্দ নেমে আসল। অন্যদিকে একই সময়ে রেজিস্টার্ড হওয়া বেসরকারি ইবতেদায়ি মাদ্রাসার শিক্ষকেরা হতাশার গ্লানিতে আরও ডুবে গেলেন। পনেরো হাজারেরও বেশি ইবতেদায়ি মাদ্রাসার সংখ্যা নেমে এল মাত্র কয়েক হাজারে। সেটিই স্বাভাবিক, একজন ইবতেদায়ি শিক্ষকের বেতনই যদি হয় মাত্র তিন হাজার ৩০০ টাকা, তাহলে কীভাবে টিকে থাকে মাদ্রাসা। তবুও সামান্য বেতনের এ শিক্ষকেরা ধারকর্জ করে বছরে কয়েকবার করে ঢাকায় এসে ধরনা দিলেও সরকারের মন গলে না। সেই সরকারেরও পতন হলো, এবার তাদের দাবি অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে। দুঃখজনক হচ্ছে, দাবি জানাতে গিয়ে পুলিশের মার খেতে হলো।

বেহাল অর্থনীতি ও মানুষের বিপুল দাবির চাপে পিষ্ট অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে এই শিক্ষকদের দাবি পূরণ কতটা সম্ভব বা সেই বাস্তবতা আছে কী না, তা নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে কিন্তু অবহেলিত এ শিক্ষক সমাজের প্রতি পুলিশ যে আচরণ করল তা কোনোভাবে মানা যায় না। যার কারণে নাগরিক সমাজও ক্ষুব্ধ এ ঘটনায়। এর আগে পাঠ্যপুস্তকে গ্রাফিতি ইস্যুতে পুলিশের দ্বিচারী আচরণ আমরা দেখেছি।

এসব ভাবতে ভাবতে শাহবাগ মোড়ে এসে দেখলাম চারদিকের সব রাস্তায় চরম যানজট। রাত প্রায় ১১টা। যানজটের কারণে বাংলামোটর পর্যন্ত হেঁটে আসা লাগল। বুঝতে পারছিলাম না, এত রাতেও কী কারণে এ যানজট!

বাসা এসে ফেসবুকে ঢুকে বুঝতে পারলাম সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা সায়েন্স ল্যাব মোড়সহ সেদিককার সড়ক ব্লক করেছে, যার প্রভাব আশপাশে পড়েছে। এরপর তো আরও রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে মারামারি বা সংঘর্ষ শুরু হয়ে গেল। হুট করে এত রাতে কেন এই মুখোমুখি অবস্থান কেউ কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শুধু মারামারির ছবি ও লাইভ। উত্তেজনায় ভরপুর। কাহিনি কী আসলে?

২.

সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের তাদের কিছু সমস্যার সমাধানের দাবিতে কিছুদিন ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে ধরনা দিচ্ছেন। তাদের দাবিগুলো কী? দাবিগুলো হলো ২০২৪-২৫ সেশন থেকেই সাত কলেজের ভর্তি পরীক্ষায় অযৌক্তিক কোটা পদ্ধতি বাতিল করা, শ্রেণিকক্ষের ধারণক্ষমতার বাইরে শিক্ষার্থী ভর্তি না করা, শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত বিবেচনায় নিয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি করা, ভর্তি পরীক্ষায় ভুল উত্তরের জন্য নম্বর কাটতে হবে ও সাত কলেজের ভর্তি ফির স্বচ্ছতা নিশ্চিতে মন্ত্রণালয় গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটির সঙ্গে সমন্বয় করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ব্যতীত নতুন অ্যাকাউন্টে ভর্তি ফি জমা রাখতে হবে।

দাবিগুলো পড়ে বোঝাই যাচ্ছে, খুব কঠিন কোনো দাবি না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আলোচনার ভিত্তিতে চাইলেই কিছু দাবি সহজে পূরণ করতে পারে বা দাবি পূরণে ইতিবাচক কোনো পদক্ষেপ নিতে পারে। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সে পথে যায়নি। স্বাভাবিকভাবেই ক্ষোভ তৈরি হয় সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে।
দাবি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক উপ-উপাচার্যের সঙ্গে দেখা করতে গেলে তিনি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করার অভিযোগ ওঠে। যদিও বিষয়টি তিনি অস্বীকার করেছেন।

এরপর তো ক্ষুব্ধ সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ করলেন এবং একপর্যায়ে মিছিল নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে এগিয়ে যান। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এসে তাদের বাধা দিলে সেখানে দুই পক্ষের মধ্যে মুখোমুখি অবস্থান সংঘর্ষে জড়ায়। বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ‘ইগোয়িস্টিক’ বিরোধ তো নতুন নয়। কিন্তু সাত কলেজের দাবি তো বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের প্রতি। কর্তৃপক্ষ সেটি কীভাবে সমাধান করবে তা তাদের দেখার বিষয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজ হিসেবে কলেজ শিক্ষার্থীদেরও অধিকার আছে বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যাম্পাসে গিয়ে তাদের দাবির পক্ষে বিক্ষোভ করা। কিন্তু সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কেন জড়াবেন? তাহলে কি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ‘লাঠিয়াল’ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছেন? অতীতে যেমনটি আমরা দেখতাম, ছাত্রলীগকে (নিষিদ্ধঘোষিত) যেভাবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ব্যবহার করত!

সংঘর্ষে পুলিশ-বিজিবির পক্ষে দেখা গেছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের। এটিও বা কেন হবে? নানা সময়ে সমন্বয়কের বড় ভাই হিসেবে পরিচয় দেওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সাবেক শিক্ষার্থীকে সেখানে দেখলাম পুলিশ ও বিজিবি সদস্যকে শাসাচ্ছেন। সাংবাদিকের সঙ্গেও তিনি দুর্ব্যবহার করেছেন। সংঘর্ষ থামাতে ঘটনাস্থলে ছুটে গিয়েছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী হাসনাত আবদুল্লাহ। উল্টো হেনস্তার শিকার হলেন।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন ছবি ও ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীরা বেশ আগ্রাসী ছিল। আবার এও দেখা গেছে, সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের পক্ষে বিভিন্ন ফেসবুক পেজ থেকে নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে নানা উসকানি দেওয়া হচ্ছে এবং সংঘর্ষের লাইভও করা হচ্ছে। ফল সব মিলিয়ে ঘোলাটে পরিস্থিতিই তৈরি হয় গত রাতে।

ফ্যাসিবাদের পতনে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি সাত কলেজের শিক্ষার্থীদেরও ভূমিকা ছিল। কিন্তু গত রাতে সংঘর্ষে জড়িয়ে সেই সম্মিলিত শক্তি বা ঐক্যের বিচ্ছেদই ঘটল বলা যায়, যেটি কোনোভাবে কাম্য ছিল না।

সাত কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হওয়ার পর থেকে নানা সমস্যা তৈরি হয়, যেগুলো নিয়ে কলেজের শিক্ষার্থীরা অতীতে বহুবার আন্দোলন করেছেন, যার সমাধানের কখনো চেষ্টা করা হয়নি। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আসলে সাত কলেজের প্রতি একই আচরণেই হেঁটেছে। যার ফলে সরকার পতনের কিছুদিন পরে সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা আলাদা বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবিতে রাস্তায় নামে। সরকার তখন এ ব্যাপারে কমিটি গঠন করে তাদের বুঝিয়ে-সুজিয়ে কলেজে ফেরত পাঠায়। এরপর দেখা গেল তিতুমীর কলেজ নিজেদের আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষণা করে দিয়ে আরেক লঙ্কাকাণ্ড বাঁধিয়ে দিয়েছে।

এখন সাত কলেজ নিয়ে নানা সমস্যার সমাধানও করা হবে না, বছরের পর বছর সেশনজটেও আটক পড়তে হবে, আলাদা বিশ্ববিদ্যালয়েও তারা যাবে না, আবার অধিভুক্ত হওয়ার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে স্বীকৃতিও তাদের হবে না, তাহলে তারা করবেটা কী আসলে?

৩.

গতকালের সংঘর্ষের ঘটনার পর আজ সকালে কিছু দাবি নিয়ে আল্টিমেটাম দেয় কলেজের শিক্ষার্থীরা। যার পরিপ্রেক্ষিতে কলেজগুলোর অধ্যক্ষদের সঙ্গে বৈঠকের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়াজ আহমেদ খান বিকেলে ঘোষণা দেন, সাত কলেজ আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকছে না। তার মানে সাত কলেজ নিয়ে সমস্যার সমাধান তাহলে আলাদা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্রিয়ার দিকে গেল যেহেতু সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা আর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনেও ফিরতে ইচ্ছুক না।

শেখ হাসিনা সরকারের পতনের কয়েক মাস আগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনেও কিছু কলেজকে নেওয়া হয়েছে। তাদের বেলায় কী হবে? দিন শেষে সাত কলেজকে ঘিরে যে সমস্যা সেটির সঙ্গে যুক্ত আছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে তৈরি হওয়া সংকটও।

আজকে সাত কলেজের দীর্ঘ সংগ্রামের পর না হয় একটা সমাধানে পৌঁছা গেল, কিন্তু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও এর অধীনস্থ কয়েক সহস্রাধিক কলেজকে নিয়ে বিবিধ সমস্যা এবং অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলো নিয়ে কী হবে?

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে ভাগ করে বিভাগভিত্তিক আলাদা আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় করার প্রস্তাব এর মধ্যে দেখা যাচ্ছে। প্রতি বিভাগের কলেজগুলো বিভাগভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকবে। আবার অনেকগুলো কলেজের অধীনে আছে উচ্চ মাধ্যমিক প্রতিষ্ঠানও। সেগুলোর বেলায় কী হবে? কলেজগুলোর বিসিএস শিক্ষকেরা আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে যেতে রাজি হবেন কী না? ফলে বিভাগভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশ্নের সঙ্গে এসব প্রশ্নও জড়িত আছে।

এখন সমাধানের পথে হাঁটতে সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন করতে হলো, সংঘর্ষে জড়াতে হলো; এটি তো একটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থার সংকট সমাধানের রাস্তা হতে পারে না। সেই রাস্তায় না হাঁটলে কি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সংকট সমাধানও হবে না?

যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই সবচেয়ে বেশি বেকার হয়, তাদের কথা তো এ রাষ্ট্র ও সরকারকে অবশ্যই ভাবতে হবে। সাত কলেজের মতো সময়ক্ষেপণ ও সংকট ঘনীভূত না করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে একটা সিদ্ধান্তে আসতেই হবে, এ হলো কথা।