বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে কিছু নাম সময়ের সীমানা অতিক্রম করে জনমানসের ভেতর গভীরভাবে গেঁথে থাকে। সেই নামগুলোর অন্যতম—দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। যিনি শুধু একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নন; তিনি গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামী মাতৃমূর্তি, বহুদলীয় রাজনীতির রূপকার, গণমানুষের অধিকার ও ভোটের মর্যাদা রক্ষার এক আপসহীন প্রতীক। তাঁর জীবনের পথচলা যেমন ঘটনাবহুল, তেমনই তা রক্ত–ঘাম–অগ্নিপরীক্ষায় নির্মিত এক অধ্যায়। আজ তিনি গুরুতর অসুস্থ, দীর্ঘদিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এই অসুস্থতা তাঁর জীবনের ব্যক্তিগত সংগ্রামকে সামনে আনে ঠিকই, কিন্তু এর চেয়েও বড় করে সামনে তুলে ধরে—বাংলাদেশের গণতন্ত্রের দীর্ঘ যাত্রায় তাঁর অবদান ও ভূমিকা সম্পর্কে নতুন মূল্যায়নের প্রশ্ন।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ধারাবাহিকতায় বেগম জিয়া এক অনিবার্য নাম। তিনি রাজনীতিতে আসেন প্রতিকূল সময়ের মধ্য দিয়ে—স্বামী রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর, এক অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশে, যখন দেশ দিকহারা। সেই সময় তিনি রাজনীতিতে আসেন দায়িত্ববোধ থেকে, শোককে শক্তিতে পরিণত করে। তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশ পায় নতুন রাজনৈতিক কাঠামো—বহুদলীয় রাজনীতি, জনসম্পৃক্ততা, গণতান্ত্রিক নির্বাচন ও ক্ষমতার ভারসাম্যের ধারণা।
তিনি তিনবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন, যা দেশের ইতিহাসে এক অনন্য রেকর্ড। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—তিনি এমন সময়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন, যখন গণতন্ত্রের ভিত্তি ছিল দুর্বল, রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা ছিল বিশৃঙ্খল, এবং অর্থনীতি ছিল টালমাটাল। তাঁর সরকারের সময় যে অর্থনৈতিক সংস্কার, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, নারীশিক্ষা ও নারীসমাজের অগ্রসরতা নিশ্চিত হয়েছে, তা আজও বহন করে সময়ের প্রমাণ।
কিন্তু বেগম জিয়ার সবচেয়ে বড় পরিচয়—তিনি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার চেয়ে বেশি ছিলেন দেশের গণমানুষের বিশ্বাস। রাজপথে, নির্বাচনে, রাজনৈতিক সংকট ও উত্তাপে—তাঁর প্রতি মানুষের আস্থা কখনো কমেনি। তিনি ছিলেন মানুষের কাছে শক্তি, প্রতিরোধ, উচ্চারণ আর ন্যায়ের প্রতীক।
একজন নারী হয়েও তিনি কঠিন রাজনীতিতে যে দৃঢ়তা দেখিয়েছেন, তা বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথ আরও মজবুত করেছে। তাঁর নীরব দৃঢ়তা, কণ্ঠের স্থিরতা ও সিদ্ধান্তের সাহস তাঁকে জনদৃষ্টিতে ‘মাদার অফ ডেমোক্রেসি’-র মতো এক মর্যাদায় পৌঁছে দিয়েছে।
আজ যখন তিনি অসুস্থ—তখন রাজনৈতিক মতভেদ ভুলে সাধারণ মানুষ তাঁর জন্য প্রার্থনা করছে। কারণ তিনি কোনো দলের মাঝেই আবদ্ধ নন; তাঁর নাম জড়িয়ে আছে দেশের ইতিহাস, গণতন্ত্রের বিকাশ, মানুষের ভোটাধিকার এবং রাষ্ট্র পরিচালনার এক বড় অধ্যায়ের সঙ্গে।
গণতন্ত্র মানে শুধু নির্বাচন নয়—এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে মানুষের মত প্রকাশের অধিকার, আইনের শাসন, রাজনৈতিক অংশগ্রহণ, বিরোধীপক্ষের সম্মান এবং নেতৃত্বের প্রতি আস্থা। আর এই সবগুলো মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় বেগম জিয়ার অবদান অস্বীকার্য। তাঁর বিরুদ্ধে আনা নানা অভিযোগ, মামলা, প্রপাগান্ডা—সবকিছুর মাঝেও তিনি দৃঢ় থেকেছেন। কারাবরণ করেছেন, বহুবার গৃহবন্দী থেকেছেন, স্বাস্থ্য ঝুঁকি সত্ত্বেও আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন।
এখন তিনি যে অবস্থায় আছেন—তা শুধু একজন নেতার ব্যক্তিগত অসহায়তা নয়; এটি দেশের গণতন্ত্রের স্পন্দনের সাথে যুক্ত।
একজন প্রবীণ, জনপ্রিয়, সাবেক প্রধানমন্ত্রী আজ মৃত্যুশয্যায়—এটি একটি রাষ্ট্রের জন্য মানবিক পরীক্ষার মুহূর্ত। রাষ্ট্র কতটা উদার হবে? কতটা মানবিক হবে? গণতন্ত্র কতটা নিজের মূল্যবোধে অটল থাকবে? এই প্রশ্নগুলো আজ আবার সামনে আসে।
বেগম জিয়ার রাজনৈতিক জীবনের নানা বিতর্ক থাকতেই পারে—কারণ রাজনীতি বিতর্কেরই শিল্প। কিন্তু যে বিষয় নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই, তা হলো তিনি নেত্রী হয়েও কখনো জনবিচ্ছিন্ন ছিলেন না। দেশের দুর্দিনে তিনি ছিলেন মানুষের পাশে—বন্যা, দুর্যোগ, রাজনৈতিক দমন–নিপীড়ন—সবসময়ই তিনি ছিলেন প্রতিবাদের প্রতীক। তাঁর শক্তি ছিল জনগণ, তাঁর সাহস ছিল গণমানুষের ভালোবাসা।
আজ এই উপসম্পাদকীয় লেখার সময়, মনে পড়ে যায় তাঁর শান্ত, ধীর কণ্ঠে উচ্চারিত সেই বাক্য—
“গণতন্ত্র ছাড়া দেশ চলতে পারে না; আর জনগণই আমার শক্তি।”
কথাটি তখন ছিল রাজনৈতিক উচ্চারণ, আর এখন তা হয়ে দাঁড়িয়েছে ইতিহাসের দলিল।
এমন একটি সময়ে, যখন তিনি জীবন–মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে, তখন তাঁর প্রতি মানুষের আবেগ, ভালোবাসা, শ্রদ্ধা প্রমাণ করে—নেতৃত্ব কখনো হারিয়ে যায় না। শরীর দুর্বল হয়, কিন্তু ইতিহাসের পাতায় লেখা শক্তি অমর থাকে। বেগম জিয়া আজ শুধুই একজন রোগী নন—তিনি বাংলাদেশের গণতন্ত্রের জীবন্ত প্রতীক। তাঁর সুস্থতা শুধু একটি পরিবারের প্রত্যাশা নয়; কোটি মানুষের আশা।
রাষ্ট্র, সমাজ, রাজনীতি—সবারই উচিত দ্বন্দ্ব ভুলে মানবিকতার জায়গা থেকে তাঁর সঠিক চিকিৎসা, নিরাপত্তা ও মর্যাদা নিশ্চিত করা।
বেগম জিয়ার অসুস্থতা আমাদের মনে করিয়ে দেয়—গণতন্ত্র শুধু রাজনীতিবিদদের দ্বন্দ্ব নয়; এটি মানুষের জীবন, মূল্যবোধ ও মানবিকতার প্রশ্ন। একজন নেত্রী অসুস্থ হলে পুরো জাতি চিন্তিত হয়—এটাই প্রমাণ করে তিনি কতটা মানুষের হৃদয়ের অংশ।
আজ সারাদেশে অসংখ্য মানুষ দোয়া করছেন—ধর্ম-বর্ণ-রাজনীতি নির্বিশেষে। এটি কোনো প্রচারের বিষয় নয়; এটি অনুভূতির বিষয়। একজন মায়ের জন্য সন্তানের প্রার্থনার মতোই—একজন নেত্রীর জন্য জনগণের প্রার্থনা।
বাংলাদেশের গণতন্ত্র অনেক বাধা অতিক্রম করেছে—সরকার বদলেছে, আন্দোলন হয়েছে, রক্ত ঝরেছে, বিপ্লব হয়েছে। তবুও কিছু নাম আছে যারা সময়ের নিরিখে হয়ে উঠেছেন পথনির্দেশক। খালেদা জিয়া তাঁদের একজন। তাঁর নেতৃত্ব ও ত্যাগ বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎকে এখনও আলোকিত করে।
আজ আমরা শুধু তাঁর সুস্থতার দোয়া করি না—আমরা প্রত্যয় করি, রাজনীতির ভাষা হোক মানবিকতা ও মর্যাদার উপর প্রতিষ্ঠিত। নেতাদের প্রতি শ্রদ্ধা, প্রতিপক্ষের প্রতি সম্মান, এবং গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠাই হোক আমাদের লক্ষ্য।
শেষ কথাটি খুবই সহজ—একজন বেগম জিয়া শুধুই একজন ব্যক্তি নন; তিনি একটি অধ্যায়—যার নাম বাংলাদেশ, যার নাম গণতন্ত্র, যার নাম জনগণের ভালোবাসা।
তিনি সুস্থ হোন, ফিরে আসুন তাঁর প্রিয় মানুষের মাঝে—এটাই আজকের সবার প্রার্থনা।
লেখক
লেকচারার: এসেক্স বিজনেস স্কুল
ড. মোঃ আতাউর রহমান
সাংগঠনিক সম্পাদক
বাংলাদেশ প্রেসক্লাব ইউকে