
বিরল খনিজের রিজার্ভ নিয়ে গোটা বিশ্বের নেতা ও কৌশলপ্রণেতারা বলা যায় অঙ্কের টেবিলে বসে আছেন। নানা হিসাব‑নিকাশ চলছে। এরই মধ্যে আগের পর্বগুলোয় বলেছি যে, ইউক্রেন যুদ্ধের সম্ভাব্য ফলের সাথে কীভাবে বিরল খনিজের মজুতের বিষয়টি জড়িয়ে আছে। সে ক্ষেত্রে প্রশ্ন ওঠে যে, প্রতিবেশী মিয়ানমারে চলমান গৃহযুদ্ধের সঙ্গেও কি এমন কোনো বিষয় যুক্ত?
এই প্রশ্নের সোজা উত্তর নেই। তবে বিভিন্ন মাধ্যমে পাওয়া কিছু তথ্যে মিলতে পারে কিছু ইঙ্গিত। প্রথমেই বলে নেওয়া যাক যে, মিয়ানমারে বিরল খনিজের কোনো ঘোষিত মজুত নেই। অর্থাৎ, সেখানে কী পরিমাণ বিরল খনিজ আছে, কোন কোন অঞ্চলে আছে, তার সুনির্দিষ্ট ঘোষিত তথ্য পাওয়া যায় না।
মার্কিন সংবাদমাধ্যম নিউজউইকের একটি প্রতিবেদনে গোটা বিশ্বে বিরল খনিজের মজুতের একটি মানচিত্র প্রকাশ করা হয়েছে। সেই মানচিত্রে সবচেয়ে বেশি মজুত রয়েছে এমন দেশ বা অঞ্চলগুলোকে গাঢ় খয়েরি রঙে চিহ্নিত করা হয়েছে। ওই মানচিত্রের দিকে তাকালে দেখা যাবে, ভারত, চীন–দুটি অঞ্চলই এই রঙে চিহ্নিত। অর্থাৎ, বিশ্বের এই অঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকায় রয়েছে বিরল খনিজের বিপুল মজুত। অথচ এই মানচিত্রেই বাংলাদেশ ও মিয়ানমার একেবারে রংহীন। কিন্তু এত বিপুল মজুতের এলাকার মধ্যবর্তী অংশে পড়লে তো তারও থাকার কথা, অন্তত ছিটেফোঁটা হলেও মজুত। কিন্তু তেমনটি দেখা যায় না।
এখানে বলে রাখা ভালো যে, গ্রিনল্যান্ডের ১৫ লাখ মেট্রিক টনের মজুত পাওয়ার পর একই ভূগঠনের অঞ্চলগুলোয় অনুসন্ধান অব্যাহত থাকে। স্বাভাবিকভাবেই ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র এই খনিজের মালিকানা পেতে মরিয়া হওয়ায় তারা এ সম্পর্কিত অনুসন্ধানেও মরিয়া হয়ে ওঠে। সেই মরিয়া চেষ্টার ফল আমরা এখন জানতে পারছি যে, একই প্লেটের আওতাধীন হওয়ায় গ্রিনল্যান্ডের মতো করে নর্ডিক দেশগুলোতেও বিরল খনিজের ভালো মজুত আছে বলে মনে করা হচ্ছে। এরই মধ্যে সুইডেনে আশানুরূপ মজুতের দিশা পাওয়া গেছে।
তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে–একই ভূগঠনের হওয়া সত্ত্বেও এবং চারপাশে বিরল খনিজের মজুত থাকলেও মাঝখানে শুধু মিয়ানমার ও বাংলাদেশে হঠাৎ করে তা শূন্য হয়ে গেল কী করে? শূন্য যে নয়, তা মিয়ানমার সম্পর্কিত অন্য কিছু তথ্যের দিকে তাকালে বোঝা যাবে।
চীনের শুল্ক প্রশাসনের তথ্যমতে, ২০২৩ সালে মিয়ানমার থেকে চীন ৪০ হাজার মেট্রিক টনের বেশি বিরল খনিজ আমদানি করেছে। ২০২৪ সালে এই পরিমাণ ৫০ হাজার মেট্রিক টন ছাড়িয়ে গেছে বলে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স। আর বাংলাদেশ? না সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই। তবে কিছু গবেষণা প্রতিবেদন আছে, যার একটির কথা আগের পর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। একটু অন্য আলাপে ঢোকা যাক। একটু ভারতের দিকে তাকানো যাক, যেখানে ৬৯ লাখ মেট্রিক টন বিরল খনিজের মজুত রয়েছে।
ভারতের পরমাণু শক্তি কমিশনের তথ্যমতে, ভারতের কেরালা, তামিলনাড়ু, ওড়িশা, অন্ধ্রপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র ও গুজরাটের উপকূলীয় অঞ্চলের বালুতে বিরল খনিজের বড় মজুত রয়েছে। পাশাপাশি ঝাড়খন্ড, পশ্চিমবঙ্গ ও তামিলনাড়ুর মধ্যবর্তী ভূমিতেও রয়েছে বিরল খনিজের উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি। গুরুত্বপূর্ণ চারটি বিরল খনিজের মধ্যে নিওডিমিয়াম ও প্রাসিওডিমিয়ামের বেশ ভালো উপস্থিতি রয়েছে। তবে ডিসপ্রোসিয়াম ও টারবিয়ামের উপস্থিতি তুলনামূলক কম।
খেয়াল করলেই দেখা যাবে যে, এই পুরোটাই মানচিত্রের সমুদ্রতীরবর্তী অঞ্চল। এই সমুদ্রতীরবর্তী অঞ্চলে বিরল খনিজের উপস্থিতি কি তবে ভারতের মানচিত্র মেনেই এসে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারে এসে শূন্য হয়ে গেছে? না, তা হওয়ার কথা নয়। পৃথিবীর ভূ-গঠন ও তাতে থাকা নানা ধরনের খনিজের উপস্থিতি মানুষের বানানো রাজনৈতিক মানচিত্র মেনে চলে না। সে চলে তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে। ফলে বাংলাদেশের কক্সবাজার বা মিয়ানমারের রাখাইন ইত্যাদি অঞ্চলে বিরল খনিজ‑শূন্য খাতা‑কলম বা পরিসংখ্যানে হতে পারে। কিন্তু বাস্তব অনুসন্ধান হয়তো বড় কোনো সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিতে পারে। আচ্ছা এটা কি সম্ভাবনা, নাকি শঙ্কা? প্রশ্নটি আসছে রাখাইনের বিদ্যমান পরিস্থিতি ও গোটা মিয়ানমারে চলমান গৃহযুদ্ধ পরিস্থিতির দিকে তাকিয়ে।
আগেই বলা হয়েছে যে, মিয়ানমারে বিরল খনিজের কোনো ঘোষিত মজুত না থাকলেও উৎপাদনে দেশটির অবস্থান শীর্ষ দেশ চীনের পরপরই। আর এই উৎপাদনের পুরোটাই আবার রপ্তানি হয় চীনে।
এখানেই চলে আসে মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংঘাত ও অস্থিরতার বিষয়টি। সে আলোচনায় পুরোপুরি যাওয়ার আগে রয়টার্সে গত বছরের অক্টোবরে প্রকাশিত এ সম্পর্কিত প্রতিবেদনের কিছু অংশে চোখ বোলানো যাক।
মিয়ানমারের কাচিন প্রদেশে অবস্থিত বিরল খনিজের খনি। ছবি: রয়টার্সরয়টার্স জানাচ্ছে, মিয়ানমারে বিরল খনিজের উৎপাদন মুখ্যত হয় দেশটির কাচিন প্রদেশে, যা চীনের দক্ষিণ‑পশ্চিমাঞ্চলীয় ইউনান প্রদেশের পার্শ্ববর্তী। গত ২৩ অক্টোবর কাচিন প্রদেশের বিরল খনিজসমৃদ্ধ খনি এলাকায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার দাবি করে মিয়ানমার জান্তাবিরোধী কাচিন ইনডিপেনডেন্স আর্মি (কেআইএ) নামের একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী। কেআইএ সে সময় দাবি করে, তারা কাচিনের পানওয়া ও চিপবে এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে।
প্রসঙ্গত, কাচিনের পানওয়া ও চিপবে এলাকাতেই রয়েছে বিরল খনিজের খনিগুলো। ফলে এ দুই অঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পর মিয়ানমার আর্মির মতো করে কেআইএ চীনের সঙ্গে কাজ করবে কিনা, সে প্রশ্ন ওঠে। অর্থাৎ, বিরল খনিজের সরবরাহ আসলে কার কাছে যাবে, তা নিয়েই সংশয় তৈরি হয়। রয়টার্সও গোষ্ঠীটির নেতৃত্বকে এ প্রশ্ন করতে ভোলেনি। কিন্তু সে সময় গোষ্ঠীটি এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করেনি।
কেআইএর আগে কাচিন নিয়ন্ত্রণ করত মিয়ানমার জান্তা সরকারের অনুগ্রহপুষ্ট এনডিএ‑কে গোষ্ঠী। তারা চীনা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সংশ্লিষ্ট খনি এলাকায় কাজ করতে স্বাগত জানিয়েছিল।
সেই কবে চর্যাপদে বলা হয়েছে–‘আপনা মাঁসে হরিণা বৈরী’। হরিণের সুস্বাদু মাংসই তার সবচেয়ে বড় শত্রু। মিয়ানমারের ক্ষেত্রেও কি তাই? দেশটিতে প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে বিপুল পরিমাণে। আর এই প্রাকৃতিক সম্পদের খনিগুলো ঘিরেই সক্রিয় একেকটি সশস্ত্র গোষ্ঠী। দেশটির সরকার বা প্রশাসনের নেতৃত্বের মধ্যেও রয়েছে এই একই সম্পদের পেছনে চলা নিরন্তর ইঁদুর দৌড়ের ফলে সৃষ্ট সংঘাত ও সমঝোতা।
মিয়ানমারের জান্তা সরকারকে কার্যত স্বীকৃতি দিয়ে রেখেছে চীন। ছবি: রয়টার্সমিয়ানমারের জান্তা সরকারকে কার্যত স্বীকৃতি দিয়ে রেখেছে চীন। একই অবস্থান নিয়ে রেখেছে রাশিয়া। দেশটির সামরিক ও অর্থনৈতিক অন্যতম সহযোগী হিসেবে রয়েছে মস্কো। চীন অবশ্য বহু বছর ধরেই মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করে আসছে। দেশটির রাজনৈতিক নানা উত্থান‑পতনের সঙ্গে এই সম্পর্কের চিহ্নসমষ্টি বেশ ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
কাউন্সিল ফর ফরেইন রিলেশন্স ২০২২ সালে মিয়ানমারে বিভিন্ন বিশ্বশক্তির স্বার্থ ও সে অনুযায়ী কার্যাবলি নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে বলা হয়, মিয়ানমারে চীন ও যুক্তরাষ্ট্র মোটামুটি যুযুধান অবস্থায় রয়েছে।
মিয়ানমারে সামরিক শাসন বলবৎ হওয়ার পর ১৯৮০‑এর দশক থেকে মার্কিন অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার আওতায় ছিল। প্রায় দুই দশক একটানা এই নিষেধাজ্ঞার বোঝা টানতে হয়েছে দেশটিকে। তারপর মার্কিন সমর্থিত অসামরিক একটি সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। ২০১২ সালে বারাক ওবামা প্রশাসন মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক নবায়ন করে এবং ২২ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো দেশটিতে মার্কিন রাষ্ট্রদূত নিয়োগ দেয়। যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সে সময় মিয়ানমার এতটাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল যে, বারাক ওবামা তাঁর মেয়াদকালে দুবার মিয়ানমার সফর করেছেন! ২০১৫ সালের নির্বাচনের পর মিয়ানমারের ওপর থেকে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার পূর্ণ প্রত্যাহার হয়। তবে কিছু অন্য ধরনের নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকে।
ওবামার পর প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও কিন্তু তাঁর প্রথম মেয়াদে মিয়ানমারের সঙ্গে একই সম্পর্ক অব্যাহত রাখেন। কারণ কী? অং সান সু চি? ঠিক তাই। শান্তিতে নোবেলজয়ী এই নেত্রীই ছিলেন মিয়ানমারে যুক্তরাষ্ট্রের তুরুপের তাস। তাই ট্রাম্প ক্ষমতায় এসে ওবামার বহু কিছুকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করলেও মিয়ানমার ইস্যুতে ওভারট্রাম্প করেননি। সু চি থাকাবস্থায় রোহিঙ্গা সংকট বাস্তব। কিন্তু কিছু নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা ব্যতিরেকে তেমন কোনো কঠোর পদক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্র নেয়নি, যেমনটা নিয়েছিল ২০২১ সালের পর।
২০২১ সালে সু চিকে হটিয়ে মিয়ানমারে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতায় বসে জান্তা সরকার। আগেই বলা হয়েছে, চীন ও রাশিয়া এই জান্তা সরকারকে প্রকাশ্যে না হলেও কার্যত স্বীকৃতি দেয়। বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্র চীনসহ বাকি দেশগুলোকে চাপ দিতে থাকে, তারা যেন এই জান্তা সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করে। এ ক্ষেত্রে আঞ্চলিক জোট আসিয়ানকেও চাপ দিতে থাকে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র এমনকি জান্তা সরকার প্রত্যাখ্যান করে গঠিত ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্টকে (এনইউজি) প্রকারান্তরে স্বীকৃতি দিয়ে বসে। মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান এমনকি এনইউজির সঙ্গে ভার্চ্যুয়াল বৈঠকও করেন বলে জানিয়েছে কাউন্সিল ফর ফরেইন রিলেশন্স। শুধু তাই নয়, এনইউজিকে আর্থিক সহায়তাও দেওয়া শুরু করে ওয়াশিংটন। এখানে মার্কিন কংগ্রেসে পাস হওয়া বার্মা অ্যাক্ট–২০২২ এর কথাও বলা যায়, যেখানে মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক সংগ্রামে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি সহায়তা দেবে বলে ঘোষণা করা হয়। স্বীকৃতি দেওয়া হয় এনইউজিকে এবং জান্তা সরকারকে সরাসরি ‘বেআইনি’ ঘোষণা দেওয়া হয়।
এই ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট কিন্তু মিয়ানমারে জান্তাবিরোধী বিক্ষোভ শুরু করে, যা সশস্ত্র ও সংঘাতপূর্ণ। এর সাথে বিভিন্ন আধাসামরিক বাহিনী একে একে যুক্ত হতে থাকে।
আর চীন? চীন জান্তা সরকার, তার মদদপুষ্ট বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠী ইত্যাদির মাধ্যমে তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট কাজ চালিয়ে নিতে থাকে। আগেই বলা হয়েছে মিয়ানমারে মোট বিরল খনিজের খনির সবকটিই চীন সমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর নিয়ন্ত্রণে। না, বিরল খনিজই একমাত্র স্বার্থ নয়। মিয়ানমার চীনের কাছে আরও নানা কারণেই গুরুত্বপূর্ণ। দেশটির কৌশলগত পরিকল্পনা বা মহাপরিকল্পনা হিসেবে আলোচিত বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই), বা পুরোনো সিল্করোড পুনরুদ্ধার পরিকল্পনায় মিয়ানমার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অঞ্চল।
কাউন্সিল ফর ফরেইন রিলেশন্স জানায়, মিয়ানমার ঘিরে চীনের পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে বিআরআই, চীন‑মিয়ানমার তেল‑গ্যাস পাইপলাইন, রাখাইনের মধ্য দিয়ে চীনের ইউনান প্রদেশ থেকে ভারত মহাসাগর পর্যন্ত চায়না‑মিয়ানমার ইকোনমিক করিডর ইত্যাদি। আর এই ইউনান ঘেঁষা এবং রাখাইনমুখী এলাকার মধ্যেই রয়েছে সেই কাচিন ও চিন প্রদেশ, যেখানে রয়েছে বিরল খনিজ তো বটেই নানা ধরনের খনিজের বিপুল মজুত। রাখাইনেও কি আছে? সংঘাতপূর্ণ এলাকাটির দিকে তাকালে এবং জাতিগত নিধনের মধ্য দিয়ে সেখান থেকে বিপুল পরিমাণে মানুষকে সরিয়ে দেওয়ার ঘটনাপ্রবাহের দিকে তাকালে প্রশ্নটিকে অবান্তর আর মনে হয় না।
কারণ কী? বিরল খনিজ উত্তোলনের প্রক্রিয়া একটি বড় কারণ। উন্মুক্ত পদ্ধতিতে খনি থেকে এই খনিজ উত্তোলন করা হয়, যার বিরূপ প্রভাব পড়ে পরিবেশের ওপর। ২০২২ সালে মিয়ানমারের কাচিন প্রদেশের দুটি এলাকাতেই শুধু বিরল খনিজের তিন শটির বেশি খনি শনাক্ত করেছে গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল উইটনেস। মার্কিন এই গবেষণা প্রতিষ্ঠান বলছে, স্যাটেলাইট ইমেজিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে শনাক্ত করা এই খনিগুলো রয়েছে মাত্র ৭০০ থেকে ৮০০ বর্গকিলোমিটার এলাকার মধ্যে।
ওয়ারউইক ইউনিভার্সিটি ও কাচিনল্যান্ড রিসার্চ সেন্টার ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে এ সম্পর্কিত একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করে। ওই গবেষণায় বলা হয়েছে, মিয়ানমারে বিরল খনিজের উৎপাদন সময়ের সঙ্গে ব্যাপকভাবে বাড়ছে। ২০২৩ সালে দেশটি ১৪০ কোটি ডলারের বিরল খনিজ চীনে রপ্তানি করেছে। অবশ্য এটি প্রদর্শিত পথে রপ্তানির হিসাব। আর গৃহযুদ্ধে পর্যুদস্ত হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই দরদামের সুবিধা চীন নেবে–এটা অনুমান করতে কষ্ট করা লাগে না।
গোটা মিয়ানমারে ২৫টির বেশি সশস্ত্র গোষ্ঠী সক্রিয়। ছবি: রয়টার্স
সে যাক, মিয়ানমার দেশ হিসেবে প্রাকৃতিক নানা সম্পদ, বিশেষত খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ। এর নানা অঞ্চলের মধ্যে কাচিন, চিন, শান, রাখাইন প্রভৃতি প্রদেশ খনিজ সম্পদে বেশ সমৃদ্ধ এবং এই অঞ্চলগুলো সংঘাতেও বিপর্যস্ত। এসব অঞ্চলসহ গোটা মিয়ানমারে ২৫টির বেশি সশস্ত্র গোষ্ঠী সক্রিয়। এসব গোষ্ঠীর মধ্যে আবার নানা ধরনের জোটও রয়েছে। বলা যায়, সারা বিশ্ব যেমন নানা স্বার্থে নানা ঘরানায় ঢুকে সংঘাত করে, এক মিয়ানমারের মধ্যেই এই স্বার্থসংশ্লিষ্ট সংঘাতের হাজারটা উদাহরণ রয়েছে।
রয়েছে এসব সংঘাতের ফলে সৃষ্ট জোটও। যেমন আরাকান আর্মি (এএ) রাখাইন, চিন, কাচিন ও শান প্রদেশে বেশ সক্রিয়। তারা আবার এসব অঞ্চলে বিদ্যমান অন্য সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে নানা মাত্রায় জোটভুক্ত। একটা আপসরফার মধ্য দিয়ে এসব সশস্ত্র গোষ্ঠী নিজেদের মধ্যে সম্পদের ভাগ‑বাটোয়ারা বুঝে নেয়। আর তাদের নিয়ন্তা হিসেবে দূরে বসে সেই ভাগের দিকে প্রখর দৃষ্টি রাখে চীন, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়ার মতো শক্তিগুলো। এই গোষ্ঠীগুলো নিয়ে বিস্তারিত জানতে হলে ইন্টারনেটে একটু চোখ বোলালেই হবে। একটু ভালো করে খুঁজলেই এ সম্পর্কিত বিপুল তথ্যের দেখা মিলবে।
যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপ মিয়ানমারের ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্টকে স্বীকৃতি দিয়ে এবং তার ছাতার নিচে থাকা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে নানা ধরনের সহায়তা দিয়ে পাশে আছে। আবার চীন ও রাশিয়া রয়েছে জান্তা সরকার ও তার ছাতার নিচে থাকা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর পাশে। এই সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো আবার জোটে থেকেও জোটের মধ্যে প্রভাব বিস্তার নিয়ে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়। সেই দ্বন্দ্বের মীমাংসায় আবার মুরুব্বী হিসেবে এগিয়ে আসে বিশ্বমোড়লেরা, যাদের স্বার্থ তালিকায় বিআরআই যেমন আছে, তেমনি বিরল খনিজও রয়েছে। ফলে মিয়ানমারের এই সম্পদই প্রকারান্তরে তার ভোগান্তির কারণ। অবশ্য দেশটির মধ্যেকার অনৈক্য ও ক্ষমতার আশপাশে থাকা মানুষগুলোর গগনচুম্বি লোভের কথাও কারণ হিসেবে বলা যায়।
লেখক: উপবার্তা সম্পাদক, ডিজিটাল বিভাগ, ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশন
[এই মতামত লেখকের নিজস্ব। এর সঙ্গে ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের প্রাতিষ্ঠানিক সম্পাদকীয় নীতিমালার কোনো সম্পর্ক নেই।]