Image description

বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী হাইকোর্ট বিভাগে আরো অস্থায়ী বিচারক নিয়োগ হতে যাচ্ছে। সঠিক সংখ্যা জানা না গেলেও বিচারক নিয়োগে তোড়জোড় চলছে পুরোদমে। এসব বিচারক প্রথমবারের মতো সুপ্রিম জুডিশিয়াল অ্যাপয়েন্টমন্ট কাউন্সিলের সুপারিশে নিয়োগ পাবেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।

তবে আগে বিচারকরা প্রধান বিচারপতির সুপারিশে নিয়োগ পেতেন। ফলে নিয়োগে প্রাধান্য পেত সরকারের ইচ্ছা। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এতদিন বিচারক নিয়োগ হতো প্রধান বিচারপতির সুপারিশে। প্রধান বিচারপতির সুপারিশের আড়ালে সরকারের পছন্দের ব্যক্তিরাই নিয়োগ পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রাধান্য পেতেন। বিষয়টি আইন বা সংবিধান স্বীকৃত ছিল না, এটি প্রচলিত ছিল প্রথা হিসেবে। একসময় এই প্রথা কিছুটা মেনে চলা হতো। ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার আমলে এই প্রথাকেও বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে দলীয় ক্যাডার, সন্ত্রাসে অভিযুক্ত, খুনের মামলায় চার্জশিটভুক্ত ব্যক্তিও বিচারক হিসেবে নিয়োগ পান। এতে সুপ্রিম কোর্টসহ পুরো বিচার বিভাগ সরকারের আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠায় হাসিনার অন্যতম সহযোগীর ভূমিকায় ছিল বিচার বিভাগ। ফ্যাসিবাদ পতনের পর ওই বিচারকরাই এখন আওয়ামীবিরোধী আইনজীবীদের ঢালাও সুবিধা দিয়ে যাচ্ছেন। আওয়ামী সিন্ডিকেটের জায়গায় এসেছে নতুন মুখ।

এদিকে হাসিনা পালানোর পর অন্তর্বর্তী সরকারও একদফা তাদের পছন্দের ব্যক্তিদের বিচারক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে। এই নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়েও দেখা দেয় প্রশ্ন। এরপরই ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার বিচারক নিয়োগের জন্য সংবিধানের নির্দেশনার আলোকে একটি কাউন্সিল গঠন করে। এই কাউন্সিলের মাধ্যমেই প্রথমবারের মতো বিচারক নিয়োগ হতে যাচ্ছে।

রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশের মাধ্যমে গঠিত কাউন্সিলের চেয়ারম্যান প্রধান বিচারপতি। অন্য সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন— আপিল বিভাগের কর্মে প্রবীণ একজন বিচারপতি, হাইকোর্ট বিভাগে কর্মে প্রবীণ একজন বিচারপতি, চেয়ারম্যান কর্তৃক মনোনীত আপিল বিভাগ থেকে অবসরপ্রাপ্ত একজন বিচারপতি, অ্যাটর্নি জেনারেল, যিনি পদাধিকার বলে বার কাউন্সিলের সভাপতি এবং চেয়ারম্যান কর্তৃক মনোনীত আইনের একজন শিক্ষক বা আইন বিশেষজ্ঞ।

কাউন্সিলের প্রথম সভায় চেয়ারম্যান প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমদের মনোনীত আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি তারিক উল হাকিম এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের শিক্ষক সুমাইয়া খায়েরকে কাউন্সিলের সদস্য হিসেবে অনুমোদন করা হয়। এরপর আরো দুটি সভা হয়। সভায় বিচারক নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু করে কাউন্সিল। সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আগ্রহী প্রার্থীদের নির্ধারিত ফরম পূরণ করে সিভি জমা দিতে বলা হয়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ৭০ জনের মতো প্রার্থী বিচারক হওয়ার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করে কাউন্সিলে আবেদন করেছেন। এই আবেদন যাচাই-বাছাই করার পর এই সপ্তাহেই কাউন্সিলের আরেকটি বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। এরপর বিচারকদের নিয়োগের জন্য সুপারিশ তৈরি করা হবে। এর আলোকে রাষ্ট্রপতি বিচারকদের নিয়োগ চূড়ান্ত করবেন।

বিচারক নিয়োগ অধ্যাদেশে প্রার্থীদের যাচাই-বাছাই করার ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে— প্রার্থীর বয়স ন্যূনতম ৪৫ বছর হতে হবে। যদিও আগে এই বয়সের সীমারেখা ছিল না। আগে সুপ্রিম কোর্টে অ্যাডভোকেট হিসেবে তালিকভুক্তির ১০ বছর হলেই হতো। প্রার্থী তালিকভুক্ত হয়ে বিদেশে অবস্থান করেও বিচারক হয়েছেন। এ ছাড়া অনেকে ৩০-৩৫ বছর বয়সেও বিচারক হয়েছেন। এ ছাড়া প্রার্থীর শিক্ষাগত যোগ্যতা, পেশাগত দক্ষতা, প্রশিক্ষণ, প্রকাশনা, আইনের নির্দিষ্ট শাখায় প্রার্থীর বিশেষ জ্ঞান ও দক্ষতা, প্রার্থীর সামগ্রিক জ্ঞান, প্রজ্ঞা, সুনাম, আইনের প্রতি শ্রদ্ধা ইত্যাদি যাচাই-বাছাই করবে কমিশন। প্রার্থীর ফৌজদারি মামলায় দণ্ডপ্রাপ্তির বিষয়েও যাচাই-বাছাই করার কথা বলা হয়েছে নিয়োগ অধ্যাদেশে।

একইভাবে নিম্ন আদালতের বিচারক থেকে যারা হাইকোর্ট বিভাগে বিচারক হিসেবে নিয়োগ পেতে আগ্রহী তাদেরও নির্ধারিত ফরমে আবেদনের কথা বলা হয়েছে। নিম্ন আদালতে বিচারক হিসেবে ১০ বছর দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি প্রার্থীকে আরো অনেক শর্ত পূরণ করতে হবে। নিম্ন আদালতে বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করা অবস্থায় প্রার্থীর আদেশের গুণগতমান, আদালত ব্যবস্থাপনা, বিচার কর্ম বিভাগের অভিজ্ঞতা, সততা, সুনাম ও আনুষঙ্গিক বিষয়গুলো যাচাই-বাছাই করবে কাউন্সিল।

এদিকে অস্থায়ীভাবে নিয়োগপ্রাপ্তদের দুই বছরের বিচারিক দক্ষতা মূল্যায়ন করে কাউন্সিল স্থায়ী নিয়োগের জন্য সুপারিশ করবে।

তিন দশক ধরে দেশে হাইকোর্ট বিভাগে অস্থায়ী নিয়োগের পর প্রতিবারই বিতর্কের ঝড় উঠত। এমনকি চার দলীয় জোট সরকারের সময় দেখা গেছে বিচারক নিয়োগের পর আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে নানা অভিযোগে বিতর্কের সৃষ্টি করা হতো। সুপ্রিম কোর্টে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করতেও দেখা গেছে। বিচারক নিয়োগের পর প্রতিবাদে সুপ্রিম কোর্টে অচলাবস্থাও তৈরি হয়েছে বিভিন্ন সময়। গত ১৫ বছরে হাসিনার আমলে আওয়ামী ক্যাডার, আওয়ামী লীগের আইনজীবী নেতাদের মেয়ের জামাই, ভাতিজির জামাই, বিভিন্নভাবে ফ্যাসিবাদকে সহযোগিতা করা ব্যক্তিরা বিচারক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। সুপ্রিম কোর্টে সন্ত্রাসে অভিযুক্ত এবং সন্ত্রাসে জড়িত অবস্থায় ধারণ করা সচিত্র প্রতিবেদনে ছবি থাকা ব্যক্তিরাও বিচারক হয়েছেন দলীয় বিবেচনায়। খুনের মামলায় চার্জশিটভুক্ত প্রধান আসামিও বিচারক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। সেসব ব্যক্তি বিচারকের আসনে এখনো বহাল তবিয়তে রয়েছেন।

এদিকে এই সরকার ক্ষমতায় আসার পর ফ্যাসিবাদ অনুগত বিচারকদের অপসারণের জন্য বারবার দাবি উঠেছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে একাধিকবার সুপ্রিম কোর্ট ঘেরাও করা হয়েছে। আইনজীবীরাও আন্দোলন সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছেন। তারপরও ফ্যাসিবাদের নিয়োগ দেওয়া দলীয় ক্যাডার, নানা কারণে পুরস্কৃত হয়ে বিচারক হওয়া ব্যক্তিরাই এখনো বহাল তবিয়তে রয়েছেন। যদিও আন্দোলন সংগ্রাম থামাতে বর্তমান প্রধান বিচারপতি ১২ জনকে দীর্ঘ মেয়াদে ছুটিতে পাঠিয়েছিলেন। এর মধ্যে পদত্যাগ অথবা চাকরির মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে ছয়জনের। বাকি ছয়জনের বিরুদ্ধে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের অনুসন্ধান ও পর্যালোচনা চলছে। এর মধ্যে বিস্তর দুর্নীতির অভিযোগ ওঠা একজন নারী বিচারক আবারও স্বপদে ফিরে আসবেন বলে শোনা যাচ্ছে। এমন প্রচারণার মধ্যেই প্রধান বিচারপতি হাইকোর্ট বিভাগের আরো তিনজনকে দীর্ঘ ছুটিতে পাঠিয়েছেন বলে জানা গেছে। এই তিনজন হলেন—হাইকোর্ট বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারক ও চার দলীয় জোট সরকারের শুরুর দিকে নিয়োগ পাওয়া মামনুন রহমান, বদরুজ্জামান ও আশরাফুল কামাল।

এর মধ্যে আশরাফুল কামাল একটি মামলার রায়ে অপ্রাসঙ্গিকভাবে ৭ নভেম্বরের বিপ্লবে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ক্ষমতায় আসাকে ডাকাতি বলে উল্লেখ করেছিলেন। মামনুন রহমানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ মুখে মুখে প্রচারিত। ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার আমলেও তিনি গা ভাসিয়ে ছিলেন নৌকায়। ভবিষ্যতে এসব বিতর্ক এড়াতে কতটা সততা ও নিরপেক্ষতার সঙ্গে বিচারক নিয়োগের জন্য বাছাই এবং সুপারিশ করতে পারবে সুপ্রিম জুডিশিয়াল নিয়োগ কাউন্সিল তাই এখন দেখার বিষয়।