Image description

আদালতে বিভিন্নভাবে হয়রানি ও ভোগান্তির শিকার হননি এরকম লোক পাওয়া দুষ্কর। কিন্তু নানাভাবে হেনস্তার শিকার হলেও প্রতিকার পাওয়ার ছিল না কোনো বিশ্বস্ত জায়গা। দিনের পর দিন ভোগান্তি সহ্য করে মনের দুঃখ মনে রাখতেন বহু মানুষ। হয়রানির শিকার এসব ব্যক্তির জন্য আশীর্বাদ হিসেবে এসেছে সুপ্রিম কোর্ট অনলাইন হেল্পলাইন সার্ভিস। বিপ্লবোত্তর বাংলাদেশে আদালতসংক্রান্ত এ অনলাইন সেবা চালুর পর থেকে গত সাত মাসে কয়েক হাজার ফোন পাওয়া গেছে। প্রতিদিনই বাড়ছে ভুক্তভোগী ও আইনি পরামর্শ চেয়ে ফোনকলের সংখ্যা।

খুলনার রমজান ফকিরের ছেলে হাফিজুর রহমান চলতি বছরের ১৮ জানুয়ারি হাইকোর্টে একটি মামলা থেকে মুক্তি পান। কিন্তু রায়ের কপিটি দুর্নীতিবাজ কর্মচারীরা কারাগারে পাঠাতে দেরি করছিলেন। ফলে তার ছেলের মুক্তি বিলম্বিত হয়। ভুক্তভোগী রমজান ফকির হাইকোর্টের অনলাইন ফোন সেন্টারে অভিযোগ দেওয়ার পরদিনই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নড়েচড়ে বসে। রায়ের কপিটি দ্রুত কারাগারে পৌঁছে যায় এবং তার ছেলে মুক্তি পান।

নাটোরের মো. বাবু জানান, তার ক্রিমিনাল মিস মামলাটি রেকর্ড শাখায় খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। দুর্নীতিবাজদের কেউ এটি গায়েব করে দিয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছিল। অভিযোগটি হাইকোর্টের অনলাইন ফোনকলের হেল্পলাইন সার্ভিস সেন্টারে জানালে দ্রুত এটি খুঁজে পাওয়া যায়।

একই ভাবে রাজধানীর পল্লবীর মো. ইসহাক চৌধুরীর দায়ের করা রিট পিটিশনটি কার্যতালিকায় ৩৭ নম্বরে থাকলেও নথি কোর্টে পাঠানো হচ্ছিল না। তিনি অভিযোগ দায়ের করার পরপরই নথি দ্রুত পাঠানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।

গত বছরের ২৬ সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্টের অনলাইন ফোনের হেল্পলাইন চালু করা হয়। এর পর থেকে ভুক্তভোগীদের কাছে তা ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। শুরুতে ০১৩১৬১৫৪২১৬ নম্বর দিয়ে হেল্পলাইনটি চালু করা হয়। ভুক্তভোগীদের ব্যাপক সাড়া পাওয়ার পর ০১৭৯৫৩৭৩৬৮০ নম্বরটিও যুক্ত করা হয়। এসব নম্বরে সরাসরি ফোনকল অথবা হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমেও যোগাযোগ করা যায়। সরকারি ছুটির দিন ছাড়া রোব থেকে বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত সাধারণ মানুষ আইনসংক্রান্ত যেকোনো অভিযোগ-অনুযোগ ও পরামর্শ জানাতে পারবেন এ নম্বরগুলোতে। এ ছাড়া [email protected]এর ই-মেইল থেকেও সহায়তা পাওয়া যাবে। সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইট https://www.supremecourt.gov.bd-তে প্রবেশ করে কমপ্লেইন রেজিস্টারেও অভিযোগ জানানো যাবে। সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রারের অফিসের তত্ত্বাবধানে এ হেল্পলাইন পরিচালনা করা হচ্ছে এবং সেবাগ্রহীতাদের প্রয়োজনে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ, প্রয়োজনীয় সাহায্য ও পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে হেল্পলাইন চালুর পর প্রথম মাসেই আসে ৩৩৭টি ফোনকল। এসব কলে অভিযোগ জানানোর পাশাপাশি আইনি পরামর্শ ও মামলার তথ্যও জানতে চান অনেকে। পরে বিভিন্ন অনিয়ম, ঘুস, কাজে অবহেলা, বিলম্বে সেবাপ্রাপ্তি ও অসদাচরণের ১৫৩টি অভিযোগ আসে এসব ফোনকলে। অভিযোগ আসে খোদ বিচারক, আইনজীবী, আদালতের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধেও। এমনকি সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে হয়রানি এবং দুর্নীতির শিকার হওয়ার বিষয়েও ৩৪টি অভিযোগ আসে প্রধান বিচারপতি বরাবর।

সব মিলিয়ে গত সাত মাসে কয়েক হাজার ফোনকল রিসিভ করে হেল্পলাইন। এর মধ্যে এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত দুই হাজারের মতো ফোনকল আসে। এর মাঝে রয়েছে আপিল বিভাগের সাবেক বিচারকের বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ, হাইকোর্ট বিভাগের বিচারকদের বিরুদ্ধে তিনটি, জেলাপর্যায়ের আদালতের বিচারকদের বিরুদ্ধে ২৫টি, জেলা আদালতের কর্মচারীদের বিরুদ্ধে ২৫টি এবং আইনজীবীদের বিরুদ্ধেও ৯টি অভিযোগ পাওয়া যায়। এ ছাড়া আদালতে ঘুস, অনিয়ম, কাজে অবহেলা, বিলম্বে সেবাপ্রাপ্তি এবং অসদাচরণের মোট ১৫৩টি অভিযোগ পাওয়া যায়। সমস্যাগুলো সমাধানে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ায় ভুক্তভোগীরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।

এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের মুখপাত্র ও বিশেষ অফিসার মোয়াজ্জেম হোসেন আমার দেশকে বলেন, বিচারপ্রার্থী জনগণের জন্য সেবা সহজ করাসহ সুপ্রিম কোর্ট এবং অধস্তন আদালতের কর্মকর্তা-কর্মচারীর পেশাগত কাজে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতে এ সার্ভিস চালু হয়েছে। বিচার বিভাগে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে রোডম্যাপের অংশ হিসেবে প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ সুপ্রিম কোর্টের কর্মকর্তাদের উদ্দেশে ১২ দফা নির্দেশনা দেন। এর মধ্যে অন্যতম এজেন্ডা হলো দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স। এ ছাড়া বিচারপ্রার্থী জনগণের সুবিধার্থে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের বিভিন্ন শাখায় দেওয়া সেবা নিশ্চিত ও সহজ করার লক্ষ্যে হেল্পলাইন চালুর উদ্যোগটি নেওয়া হয়।

প্রধান বিচারপতির নির্দেশনায় বলা হয়, যদি কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী আচরণবিধি ও নির্দেশনার ব্যত্যয় ঘটিয়ে সেবাগ্রহীতাকে হয়রানি করেন বা আর্থিক লেনদেন করেন, তাহলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নির্দেশনায় আরো বলা হয়, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দায়িত্ব পালনে আচরণবিধি মানতে হবে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে সেবা নিশ্চিত করতে হবে। দায়িত্ব পালনের সময় আর্থিক লেনদেন করা যাবে না। সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে অহেতুক বিলম্ব করা যাবে না। সেবাগ্রহীতাকে কোনোরকম হয়রানি না করে তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল আচরণ করতে হবে।

সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে ৩৮টি ও আপিল বিভাগে ১৯টি শাখা রয়েছে। দেশের শীর্ষ আদালতে একজন রেজিস্ট্রার জেনারেল, তিনজন রেজিস্ট্রার, চারজন অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার, একজন স্পেশাল অফিসার, ১২ জন ডেপুটি রেজিস্ট্রার, ২০ জন সহকারী রেজিস্ট্রারসহ বিভিন্ন কোর্ট ও শাখায় দুই হাজার ৫০০ কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োজিত আছেন।

অনলাইন হেল্পলাইন সম্পর্কে কথা হয় হাইকোর্টের তরুণ আইনজীবী মোহাম্মদ শাহীন মণ্ডলের সঙ্গে। তিনি বলেন, প্রধান বিচারপতির এ উদ্যোগ খুবই সুন্দর। সাধারণ বিচারপ্রার্থী মানুষ যারা সরাসরি আদালতের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করতে পারতেন না, যারা আইনজীবী বা আদালতের কর্মচারীদের ওপর এতদিন নির্ভরশীল ছিলেন, তারা এ হেল্পলাইনের মাধ্যমে যথাযথ সাহায্য নিতে পারবেন। তিনি আরো বলেন, ‘আমি মনে করি ফোন নম্বর আরো বাড়ানো দরকার এবং উচ্চ আদালতের পাশাপাশি ফোনকলের সেবাগুলো প্রতিটি জেলা জজ আদালতপর্যায়েও চালু করা গেলে তৃণমূলপর্যায়ের মানুষ আরো সেবা পাবেন। এতে দুর্নীতি কমে আসবে।