Image description
 

সপ্তাহ খানেক আগে কয়েকজন পশ্চিমা কূটনীতিকের সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতি নিয়ে কথা হচ্ছিল। তারা বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অবনতি নিয়ে আমার কাছে উদ্বেগ প্রকাশ করছিলেন।

তারা আমাকে বারবার বোঝানোর চেষ্টা করলেন, আঞ্চলিক সহযোগিতা বৃদ্ধির স্বার্থে বাংলাদেশের জনগণের ভারতের সব নষ্টামির কথা ভুলে গিয়ে সামনের দিকে তাকানো উচিত। আমি পাল্টা যুক্তি দিয়ে বলেছিলাম, বড় দেশ হিসেবে বরং ভারতেরই ক্ষুদ্র প্রতিবেশীদের প্রতি বন্ধুত্বের হাত বাড়াতে হবে।

বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের পূর্বশর্ত হিসেবে দিল্লির শাসকদের ফ্যাসিস্ট হাসিনার প্রতি অন্ধ প্রেম ছাড়তে হবে। দিল্লির আশকারায় হাসিনার দানব হয়ে ওঠার দায় ভারত সরকার এড়াতে পারে না। তা ছাড়া অতীত কি চাইলেই মুছে ফেলা যায়? অতীত ভুলে গেলে তো আমরা বারংবার একই ভুলের আবর্তে ঘুরপাক খেতে থাকব।

ব্যক্তি, সমাজ, কিংবা রাষ্ট্রের অতীত ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়, সেটা উচিতও নয়। অতীত থেকে শিক্ষা নিয়েই ভবিষ্যৎ নির্মাণ করতে হয়। তবে এটা ঠিক যে, অতীতের তিক্ততা সারাক্ষণ মনে পুষে রাখলে কারোরই মঙ্গল হবে না। সেটা ব্যক্তিগত ও রাষ্ট্রীয় উভয় সম্পর্কের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্রের বাংলাদেশ নিয়ে সাম্প্রতিক মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে ওপরের কথাগুলো লিখতে হলো। সার্ক-বিষয়ক এক প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে সেই মুখপাত্র আমাদের বিরুদ্ধে রীতিমতো বিষোদ্গার করেছেন। তিনি বাংলাদেশে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মিথ্যা অভিযোগ উত্থাপন করে প্রফেসর ইউনূসের সরকারকে সেগুলো নিয়ন্ত্রণের নসিহত করেছেন।

পলাতক হাসিনা দিল্লিতে বসে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অনবরত যেসব ষড়যন্ত্র করে চলেছেন—ভারত সরকারের মুখপাত্রের মন্তব্য যে তারই অংশ, সেটা বুঝতে কারো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। বাংলাদেশকে আর কখনো ভারতীয় রাডারের বাইরে যেতে না দেওয়ার যে কল্পজগৎ দিল্লির নীতিনির্ধারকরা ২০১০ সালে নির্মাণ করেছিলেন, সেখান থেকে তারা যেন কিছুতেই বের হতে পারছেন না।

বাংলাদেশে আর দখলদারিত্ব চলবে না, এটা ভাবতেই তাদের মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে। এ কারণেই তাদের অন্তর্জ্বালার ক্ষণে ক্ষণে বহিঃপ্রকাশ ঘটছে। নিজ অপরাধে সৃষ্ট মানসিক কারাগার থেকে দিল্লি বের হতে পারছে না বলেই ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে জটিলতার অবসান হচ্ছে না।

কোনোরকম বিদেশি সহায়তা ছাড়া এ দেশের নিরস্ত্র ও অকুতোভয় ছাত্রজনতার শুধু বুকের রক্তের তীব্র স্রোতধারায় ভারতীয় শৃঙ্খল ভাসিয়ে দেওয়ার বাস্তবতা দিল্লি স্বীকার করে নিলে আমাদের সম্পর্কের নতুন সূচনা সহজেই হতে পারত। তা না করে নরেন্দ্র মোদি ওয়াশিংটন সফরে গিয়ে সব কূটনৈতিক ভব্যতা জলাঞ্জলি দিয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কাছে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নালিশের পসরা খুলে বসেছিলেন। সেখান থেকে দৃশ্যত ব্যর্থ হয়ে ফিরে ভারত সরকার নতুন করে ‘ইসলামি সন্ত্রাসী’ কার্ড খেলতে চাচ্ছে। ভারতের এই খেলায় অবশ্য কোনো নতুনত্ব নেই। ৫০ বছর ধরে দেশটি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে ‘মাইনরিটি’ ও ‘ইসলামি জঙ্গি’—এই দুই কার্ড ব্যবহার করেই চলেছে।

জুলাই বিপ্লবের পর ভারত প্রথমে ইসকন ও গেরুয়া সন্ত্রাসী চিন্ময়কে ব্যবহার করে মাইনরিটি কার্ড খেলে বিফল হয়েছে। চট্টগ্রামে এক নিরপরাধ মুসলমান আইনজীবীকে হত্যা করেও এ দেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগানো সম্ভব হয়নি। বাস্তবে তিন দশক ধরে ভারতেই চরমপন্থা ও সাম্প্রদায়িকতার ভয়াবহ বিস্তার ঘটছে। সে দেশের সংখ্যালঘু মুসলমান প্রতিনিয়ত উগ্র হিন্দুদের দ্বারা নির্যাতিত হচ্ছে।

সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের জন্য দেশটির গোয়েন্দা সংস্থা খোদ মার্কিন মুলুকেই অভিযুক্ত হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে মাইনরিটি কার্ড অতিরিক্ত ব্যবহার করলে সেটি শেষ পর্যন্ত নিজেদের জন্যই ব্যুমেরাং হয়ে পড়তে পারে বুঝতে পেরে ভারত সরকার এখন প্রচারণার দ্বিতীয় অস্ত্র ‘ইসলামি জঙ্গি’ কার্ড ব্যবহার করার চেষ্টা করছে। এ প্রসঙ্গে আমরা এবার খানিকটা অতীত থেকে শিক্ষা নেওয়ার চেষ্টা করি।

২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপির নেতৃত্বে চারদলীয় জোট সরকারের শাসনামলে ভারত ‘ইসলামি জঙ্গি’ কার্ড ব্যবহার করে যথেষ্ট সফল হয়েছিল। তবে সেই সফলতার পেছনে তৎকালীন সরকারের ব্যর্থতাও অনেকাংশে দায়ী ছিল। উদাহরণস্বরূপ জেএমবির কথা বলা যেতে পারে। এই উগ্রবাদী ইসলামিক দলটির প্রধান ব্যক্তির নাম ছিল শায়েখ আবদুর রহমান। তিনি আওয়ামী সন্ত্রাসী সংগঠন যুবলীগের তৎকালীন সেক্রেটারি মির্জা আজমের আপন বোনের স্বামী ছিলেন।

সন্ত্রাসী মির্জা আজমের বিরুদ্ধে বিডিআর ম্যাসাকারেও সম্পৃক্ততার অভিযোগ রয়েছে। আওয়ামী লীগের এই কেন্দ্রীয় নেতা বর্তমানে পলাতক রয়েছেন। তার বর্তমান আস্তানা সম্ভবত ভারতেই। জেএমবির সামরিক শাখার প্রধান ছিলেন একই মির্জা আজমের ভাগনে আবদুল আওয়াল সানি। আমি যতদূর জানি, তারা সবাই আহলে হাদিসপন্থি ছিলেন।

জেএমবির সঙ্গে আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠতার বিষয়ে জেনেও চারদলীয় জোট সরকার বিস্ময়করভাবে উগ্রবাদী সংগঠনটিকে প্রাথমিকভাবে উপেক্ষা করার আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তারা ভেবেছিল, বাম সর্বহারা সন্ত্রাসী ও ধর্মীয় উগ্রবাদী জেএমবির মধ্যে খুনোখুনি হলে সেক্ষেত্রে সরকারের বিশেষ কোনো দায় নেই। সেই ভুলের সুযোগ নিয়ে বাংলাদেশের ভারতপন্থি মিডিয়ার সহায়তাক্রমে দিল্লি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশকে একটি জঙ্গি রাষ্ট্ররূপে চিত্রিত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে।

বেশ কয়েকটি পশ্চিমা মিডিয়ায় বাংলাদেশে ইসলামি চরমপন্থার উত্থান নিয়ে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে সরকারের ঘুম ভাঙে। ভুল শোধরানোর জন্য জোট সরকার শেষ পর্যন্ত জেএমবির বিরুদ্ধে পুলিশি অভিযানে যায় এবং বেশ সফলতাও লাভ করে। শায়েখ আবদুর রহমান, আবদুল আওয়াল সানি ও অন্য চরমপন্থিদের গ্রেপ্তারের পর আদালতে সোপর্দ করা হয়। চারদলীয় জোট সরকারের আমলেই তারা সর্বোচ্চ সাজায় দণ্ডিত হয় এবং এক-এগারো সরকারের সময় সাজাপ্রাপ্তদের ফাঁসিও কার্যকর করা হয়। কিন্তু অদ্যাবধি সময়-সুযোগ পেলেই ভারত বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ইসলামি জঙ্গির প্রসঙ্গ উত্থাপন করে অপপ্রচারে নেমে পড়ে। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্রের সর্বশেষ বক্তব্যে সেই পুরোনো খেলা পুনরায় শুরু করার ইঙ্গিত মিলেছে।

ভারতীয় ষড়যন্ত্র এবার যাতে সফল হতে না পারে সেই লক্ষ্যে সরকারের পাশাপাশি জনগণেরও সতর্ক থাকা আবশ্যক। মনে রাখতে হবে, অতি ইসলামিস্ট হলে সর্বদা রাষ্ট্রের শত্রুরাই লাভবান হয়। এসব ইসলামিস্ট আগেও দেশবিরোধী শক্তিদের দ্বারা ব্যবহৃত হয়ে যথেষ্ট ক্ষতির কারণ হয়েছেন। এ দেশে হলি আর্টিজান ম্যাসাকারের মতো বর্বর ঘটনাও ঘটেছে। মহান জুলাই বিপ্লবের পর বুঝে অথবা না বুঝে কতিপয় ব্যক্তি আবারো অতি ইসলামিস্ট হয়ে উঠেছেন—কেউ মাজার ভাঙাভাঙি করছেন, কেউ মেয়েদের ফুটবল খেলা বন্ধ করে দিচ্ছেন, আবার কেউ কনসার্ট আটকাচ্ছেন। অনেক ক্ষেত্রে ‘তৌহিদি জনতা’র ব্যানার ব্যবহার করে এসব বিতর্কিত কাজ করা হচ্ছে।

সারা দেশের দু-একটি ঘটনাকে অতিরঞ্জিত করছে বিশেষ মহল। কতিপয় অতি উৎসাহীর এসব বালখিল্য আচরণে আমাদের বৈরী প্রতিবেশী যারপরনাই আনন্দলাভ করছে। এই বিচ্ছিন্ন ঘটনাগুলোকে তারা ফলাও করে সর্বত্র প্রচার করছে, যাতে পতিত ও পলাতক ফ্যাসিস্ট হাসিনার প্রত্যাবর্তনের সুযোগ সৃষ্টি হয়। বিশ্বকে দিল্লি এমন একটা ধারণা দিতে চাচ্ছে যে, হাসিনা ও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না থাকলেই বাংলাদেশে ইসলামি চরমপন্থা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে।

ভারতের এই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ঢালাও বয়ানকে মিথ্যা সাব্যস্ত করার জন্য সবাইকে দায়িত্বশীল হতে হবে। কোনো সময়ে যৌক্তিক প্রতিবাদের প্রয়োজন হলেও সেটি করতে গিয়ে কোনো অবস্থাতেই সীমা অতিক্রম করা যাবে না। সরকারকেও সীমা অতিক্রমকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর হতে হবে।

আমাদের স্মরণে রাখা দরকার, আমরা এক প্রচণ্ড ইসলামোফোবিক দুনিয়ায় বসবাস করছি। আমার প্রায় দুই দশকের লেখালেখির সঙ্গে যারা পরিচিত তারা নিশ্চয়ই জানেন, বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষায় আমি ইসলামোফোবিক বয়ানের বিরুদ্ধে লড়াই করে চলেছি। আমার মতো বাংলাদেশের আরো বেশ কিছু লেখক ও বুদ্ধিজীবীও একইভাবে লড়ছেন।

আপনাদের মনে করিয়ে দিচ্ছি, বাংলাদেশের লেখালেখির জগতে আমাদের চিন্তাধারার মানুষের সংখ্যা বেশ কম। সেই ষাটের দশক থেকেই আমাদের দেশের সাংস্কৃতিক জগৎ মূলত ইসলামবিদ্বেষীদের দখলেই রয়েছে। হাসিনার ১৫ বছরের ফ্যাসিস্ট শাসনামলে ধর্মপালনকারী মুসলমানদের ওপর নির্যাতন করার পেছনে ইসলামবিদ্বেষী বুদ্ধিজীবীদের প্ররোচনাও কাজ করেছে।

জুলাই বিপ্লব এ দেশে বাঙালি মুসলমানের সাংস্কৃতিক রেনেসাঁর এক সোনালি সম্ভাবনা তৈরি করেছে। যারা মাজার ভেঙে অথবা মেয়েদের ফুটবল খেলা বন্ধ করে ইসলাম কায়েম করতে চান, তারা প্রকৃতপক্ষে ভারতীয় হেজেমনির বিরুদ্ধে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক লড়াইটাকেই দুর্বল করে ফেলছেন। তারা হঠকারিতার আশ্রয় নিয়ে ইসলামবিদ্বেষী বুদ্ধিজীবীদের অপপ্রচারের সুযোগ করে দিচ্ছেন এবং পরিণামে ইসলাম, মুসলমান ও দেশের অপকার করছেন।

সমাজকে এ ব্যাপারে সচেতন করার জন্য প্রকৃত আলেম সমাজেরও বিশেষভাবে উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন। প্রকৃতিগতভাবে বাংলাদেশের জনগণ ধর্মীয় বিষয়ে সহনশীল ও অসাম্প্রদায়িক। বাংলার হাজার বছরের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, দূরদেশ থেকে আগত সুফিরা তৌহিদ ও সাম্যের বাণীর মাধ্যমে অনুপ্রাণিত করে এই অঞ্চলের নিপীড়িত জনগোষ্ঠীকে ইসলামের পতাকাতলে নিয়ে এসেছেন।

দিল্লির মুসলিম শাসকরা যে আল্লাহর বাণী প্রচার করতে পারেননি, সেটাই করেছেন আরব, মধ্য এশিয়া ও পারস্য থেকে আগত জানা-অজানা সুফিরা। তারা ভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতির মানুষ হয়েও বাংলাদেশকেই স্বদেশে পরিণত করে এখানেই ঘুমিয়ে আছেন। তাদের প্রতি আমাদের অশেষ কৃতজ্ঞতা। ওয়াজ মাহফিলের জনপ্রিয় বক্তারা এ বিষয়ে ধর্মভীরু মুসলমান জনগোষ্ঠীকে সচেতন করে তুললে বাংলাদেশে যে কোনোরকম উগ্রপন্থা মোকাবিলা করা সহজতর হবে। আমাদের সম্মিলিত লড়াই ফ্যাসিবাদ, উগ্রবাদ ও হেজেমনির বিরুদ্ধে।

 

মাহমুদুর রহমান