
রাতের ভোটের কারণে দেশে-বিদেশে আলোচিত হয়েছিল একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ২০১৮ সালের সেই নির্বাচনের সব সহযোগী আছেন আতঙ্কে। পাশাপাশি ২০১৪ ও ২০২৪ নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করা কর্মকর্তারাও স্বস্তিতে নেই। গত তিনটি নির্বাচনের সময় দায়িত্ব পালন করা সচিব, জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও পুলিশ সুপারের পাশাপাশি ইউএনও-ওসিরাও আসছেন শাস্তির আওতায়। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
প্রশাসন ও পুলিশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, রাতের ভোটের নেতৃত্বে ছিলেন সে সময়ের রিটার্নিং কর্মকর্তা ও জেলার পুলিশ সুপাররা। তাদের সঙ্গে সহযোগিতায় জড়িত সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করা ৪০০ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং ৫ শতাধিক পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তাদের ওএসডি করার পাশাপাশি দুর্নীতির অভিযোগও খতিয়ে দেখা হবে। রাতের ভোটের ‘কুশীলবদের’ সম্পর্কে ইতোমধ্যেই অনুসন্ধানে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। পাঁচ সদস্যের একটি টিম নির্বাচনে জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত ইসি, প্রশাসন ও পুলিশসহ সবার বিরুদ্ধেই অনুসন্ধান করছে।
নির্বাচন সংস্কার কমিশনের প্রধান ও সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক অধ্যাপক ড. বদিউল আলম মজুমদার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, নির্বাচনে কারচুপির সঙ্গে জড়িত সবাইকে শাস্তির আওতায় আনা উচিত। তদন্তসাপেক্ষে জড়িতরা অন্যায় করে যেন পার না পায়। শাস্তি হলে অন্যরা এমন করতে সাহস পাবে না।
২০১৮ সালের নির্বাচনে পছন্দের প্রার্থীকে জেতাতে ভোটের আগের রাতেই সব ব্যালটে সিল মেরে বাক্সে ভরে রাখা হয়েছিল। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহায়তা করেছিলেন সে সময়ের রিটার্নিং কর্মকর্তা থেকে শুরু করে প্রিসাইডিং কর্মকর্তা প্রত্যেকেই। সেই ভোটে জড়িত সব কর্মকর্তার ভূমিকাই খতিয়ে দেখছে সরকার।
জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ সাবেক সচিব এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ওই সময় নির্বাচনে যারা দায়িত্ব পালন করেছেন তারা কখনোই সরকারের ওপরে ছিলেন না। তবে অনিয়ম করার জন্য শাস্তি হতেই পারে। সেই শাস্তি সবারই হওয়া উচিত। যারা নিরপরাধ তাদের বাদ দিতে হবে আর যারা জড়িত তাদের সবাইকে আইনের আওতায় আনতে হবে। শাস্তি মানে শুধু ডিসি এসপির শাস্তি তা নয়, বিভিন্ন বাহিনীর যারা দায়িত্ব পালন করেছেন বিশেষ করে নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তা, প্রিসাইডিং অফিসার, সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার তারাও জড়িত ছিলেন, কাউকে বাদ দেওয়া ঠিক হবে না বলে জানান আবদুল আউয়াল মজুমদার।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্যে জানা গেছে, বিতর্কিত নির্বাচনের কারণে ইতোমধ্যেই রিটার্নিং কর্মকর্তাদের বাধ্যতামূলক অবসর ও ওএসডি করা হয়েছে। ২০১৪ ও ২০২৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করা ডিসি, ইউএনও, এসপি ও ওসিদের মধ্যে যারা এখনো কর্মরত রয়েছেন তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৬৪ জেলায় ৬৫ রিটার্নিং কর্মকর্তা দায়িত্ব পালন করেন। ৪৯৪ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা ছিলেন সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা। তাদের মধ্যে ৪০০ ইউএনওর বিরুদ্ধে ভোট জালিয়াতির অভিযোগ রয়েছে। তারা সবাই চাকরিতে রয়েছেন। ইতোমধ্যেই সাবেক ডিসিদের মধ্যে যারা রিটার্নিং কর্মকর্তা ছিলেন একাদশ নির্বাচনে এমন ৪৩ জনকে ওএসডি ও ২২ জনকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা ও পুলিশ কর্মকর্তাদের কার্যক্রম ভিতরে ভিতরে প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। যাদের চাকরির বয়স ২৫ বছরের কম তাদের ওএসডি করা হয়েছে। আর যাদের চাকরির বয়স ২৫ বছরের বেশি তাদের বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়েছে। বিতর্কিত নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করায় গত মাসে এক দিনেই ২২ জনকে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার এ পর্যন্ত ১২ জন সচিব, পাঁচজন গ্রেড-১সহ ২৯ জন অতিরিক্ত সচিব, একজন যুগ্ম সচিব এবং একজন উপসচিবকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠিয়েছে।
এদিকে বিগত নির্বাচনে অনিয়মের জন্য পুলিশকে দায়ী করেছেন সে সময়ের রিটার্নিং ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তারা। গত ৯ ডিসেম্বর নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সঙ্গে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে বিগত নির্বাচনের ৩০ জন রিটার্নিং ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা পুলিশকে দায়ী করেন। তাদের দাবি, পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের কোনো কথা শুনতেন না। ভোট কেন্দ্রের নিরাপত্তার দায়িত্বে পুলিশ ছিল বলে সরাসরি তাদের ছত্রচ্ছায়ায় সব অনিয়ম হয়েছে। পুলিশের বিরুদ্ধে অনিয়মের পাহাড় থাকায় দায়িত্ব পালন করা পুলিশও শাস্তির আওতায় আসছেন। ২০১৮ সালের নির্বাচনে ৬৪ জেলায় যারা পুলিশ সুপারের দায়িত্বে ছিলেন, তারাও শাস্তির আওতায় আসছেন। বাদ যাবে না দায়িত্ব পালন করা সে সময়ের সংশ্লিষ্ট থানার ওসিরাও। ইতোমধ্যেই ২০১৮ সালের নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করার জন্য এক অতিরিক্ত আইজিপি, ১৩ জন ডিআইজি, ৪৯ জন অতিরিক্ত ডিআইজি ও ১৯ জন পুলিশ সুপার পদমর্যাদার কর্মকর্তাকে ওএসডি করা হয়েছে। এটি চলমান প্রক্রিয়া বলে জানা গেছে।
স্বরাষ্ট্র ও পুলিশের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, বিভিন্ন সময় নির্বাচনে ভোটের অনিয়মে সহযোগিতা করায় তালিকা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যেই ২০১৮ সালের নির্বাচনে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থাকায় পুলিশের সাবেক ১০৩ কর্মকর্তার পুলিশ পদক প্রত্যাহার করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, পদক কেড়ে নেওয়াও এক ধরনের শাস্তি।