Image description

সিরাজগঞ্জ সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর মো. আমিনুল ইসলামের বিরুদ্ধে ভুয়া বিল ভাউচারের মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে নেওয়াসহ নানা অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) কর্তৃক গঠিত তদন্ত কমিটি। শিক্ষার্থীদের কাছে বাস ভাড়ার নামে আদায় করা ৭০ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত কমিটি। শুধু তাই নয়; পরীক্ষার আপ্যায়নে একদিনে কেবল খাসির মাংসের বিল করা হয়েছে দেড় লাখ টাকার বেশি। এসব অনিয়মের মাধ্যমে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন অধ্যাপক আমিনুল ইসলাম।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে তদন্ত কমিটির প্রধান (বর্তমান মাউশির ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক) প্রফেসর বি এম আব্দুল হান্নান দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘মাউশির কাজ তদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দেওয়া। আমরা তা করেছি। এ বিষয়ে পরবর্তী ব্যবস্থা শিক্ষা মন্ত্রণালয় নেবে।’

পরিবহন খাতে অস্বাভাবিক ব্যয়
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিপত্র অনুযায়ী শিক্ষার্থীপ্রতি বিবিধ খাতে ১০০ টাকা নেওয়ার নিয়ম থাকলেও অধ্যক্ষ ভর্তি ও ফরম পূরণের সময় দ্বিগুণ ফি নিয়ে প্রায় ২০ লাখ টাকা বাড়তি আদায় করেন। এসব টাকা তার ব্যক্তিগত গাড়ির তেল, সিএনজি গ্যাস, ড্রাইভারের বেতনও কলেজ তহবিল থেকে পরিশোধ করা হয়। 

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কলেজের মাইক্রোবাস শহরের ভেতরে ব্যবহৃত হলেও মাত্র তিন মাসে প্রায় পাঁচ লাখ টাকারও বেশি পরিবহন খরচ দেখানো হয়েছে। পূর্ববর্তী অধ্যক্ষের তুলনায় আমিনুল ইসলাম এ খাতে ৩ থেকে ৪ গুণ বেশি অর্থ ব্যয় করেছেন। এত বিপুল পরিমান জ্বালানি ও মেরামত ব্যয় কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয় বলে জানিয়েছে তদন্ত কমিটি। এছাড়া ব্যক্তিগত গাড়ির খরচ কলেজের নামে ভাউচার করা হয়েছে।

মাইক্রোবাসের জ্বালানির ভাউচার বিশ্লেষণে দেখা যায়, সেপ্টেম্বরে ৩৩ হাজার ৬৩ টাকা, অক্টোবরে ৪১ হাজার ৫০৫, নভেম্বরে ৫৩ হাজার ৪১, ডিসেম্বরে ৭৩ হাজার ৩০১, জানুয়ারিতে ৭১ হাজার ৭৫৪, ফেব্রুয়ারিতে ৮০ হাজার ৯৭৮, মার্চে ৬৮ হাজার ৭৩ এবং এপ্রিলে ৫৬ হাজার ৫৮৫ টাকার ভাউচার করা হয়েছে। কলেজের মাইক্রোবাস মূলত শহরের ভেতরেই চলাচল করে। এ অবস্থায় এত বিপুল জ্বালানি খরচ কোনভাবেই সম্ভব নয় বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। সাবেক অধ্যক্ষ যেখানে চার মাসে মোট ৩১১ লিটার অকটেন ব্যবহার দেখিয়েছিলেন, আমিনুল ইসলাম তিন মাসেই ৯৫২ লিটার তেল খরচ দেখিয়েছেন। এসব কিছুই তিনি ভুয়া ভাউচারের মাধ্যমে করেছেন।

ব্যাংক স্টেটমেন্ট বিশ্লেষণেও অস্বাভাবিক লেনদেন পাওয়া যায়। পরিবহন খাত থেকে পূর্ববর্তী অধ্যক্ষ তিন মাসে উত্তোলন করেছিলেন ১ লাখ ৩০ হাজার ৩৯২ টাকা, আর বর্তমান অধ্যক্ষ একই সময়ে উত্তোলন করেন ৪ লাখ ৯৬ হাজার ৫৫৬ টাকা। ফেব্রুয়ারি থেকে জুন ২০২৫ পর্যন্ত বিভিন্ন তারিখে একই খাত থেকে উত্তোলন করা হয় ৩৫ হাজার ৪১৭, ৮৮ হাজার ৯০৪, ১ লাখ ২২ হাজার ৬৭৮, ৩০ হাজার ৯৫০, ৫৮ হাজার ৭৫, ১ লাখ ৬০ হাজারেরও বেশি, ৩৩ হাজার ৯৩৮, ৬৩ হাজার ৫২০, ২২ হাজার ৯৬১, ২৪ হাজার ৩৫ এবং ১ লাখ ৬ হাজার ৪২৫ টাকা। এই ব্যয় কলেজের মাইক্রোবাসের পরিচালন ব্যয় হতে পারে না বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। অধ্যাপক আমিনুল ইসলাম ব্যক্তি খাতে এস অর্থ ব্যয় করেছেন। পরবর্তী ভুয়া ভাউচারের মাধ্যমে এটি সামঞ্জস্য করার চেষ্টা করেছেন।

ভর্তি ফি ও পরীক্ষার খাত থেকে ভুয়া বিল-ভাউচারে টাকা আত্মসাৎ
উচ্চমাধ্যমিক ভর্তি ফি, অনার্স ২য় বর্ষ, মাস্টার্স শেষবর্ষ, অনার্স ১ম বর্ষসহ বিভিন্ন পরীক্ষার আয়-ব্যয়ের খাত পর্যালোচনা করে দেখা যায়, প্রায় সব ক্ষেত্রেই অস্বাভাবিক হারে খরচ দেখানো হয়েছে। খাসির মাংসের ক্ষেত্রে একদিনেই এক লাখ ৫৫ হাজার ৬০৪ টাকা ব্যয়ের ভাউচার করা হয়েছে। অনার্স ২য় বর্ষ পরীক্ষা-২০২৩ খাতে এ ব্যয় দেখানো হয়েছে।

২০২৪–২৫ শিক্ষাবর্ষে একাদশ শ্রেণির ভর্তি বাবদ শিক্ষাবোর্ড থেকে ৯১ হাজার ২০০ টাকা বরাদ্দ পায় সিরাজগঞ্জ সরকারি কলেজ। ব্যয়ের ভাউচারে দেখা যায়, তিনটি ছোট খাতে ৩ হাজার ৫৫০, ২ হাজার ২০০ এবং ৩০ জন কর্মচারীকে জনপ্রতি ২ হাজার ৮৫০ টাকা দিয়ে মোট ৮৫ হাজার ৫০৮ টাকা দেখানো হয়েছে। তবে ৬ সদস্যের মনিটরিং কমিটিকে কোনো সম্মানী দেওয়া হয়নি। কেবল ৩০ কর্মচারীর নামে পুরো টাকার ভাউচার করা হয়েছে। যা অস্বাভাবিক।

প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, অনার্স দ্বিতীয় বর্ষ অভ্যন্তরীণ পরীক্ষা থেকে কলেজের আয় হয় ৭ লাখ ৫৬ হাজার ৮০০ টাকা। এ অর্থ পরীক্ষা পরিচালনা বাবদ ব্যয় দেখানো হয়েছে ৬ লাখ ২৪ হাজার টাকা। উত্তরপত্র বাবদ ৫৬ হাজার ৭৬০ এবং ডিউটি বাবদ ৩৪ হাজার ৮১৩ টাকা। এর বাইরে আপ্যায়ন খাতেই একাধিক আশ্চর্যজনক ভাউচার পাওয়া যায়। ২০২৪ সালের ৬ জুনের ভাউচারে ব্রয়লার মুরগি ৫ হাজার ৮০০ টাকা, ইলিশ-রুই মাছে ৩১ হাজার, খাসি ১৬ হাজার ৫০০, পরীক্ষা সামগ্রীতে ১১ হাজার ২৬৫ এবং একই মাসে অপর দুটি তারিখে আপ্যায়ন বাবদ ৪৭ হাজার ৭৮০ টাকা, ১ লাখ ৫৩ হাজার ৪৯৫ ও ১ লাখ ৫৭ হাজার ২৬০ টাকা ব্যয় দেখানো হয়। এই সময় সাবেক অধ্যক্ষ আমিনুল ইসলাম দায়িত্বে না থাকলেও ভাউচারগুলো তিনি অনুমোদন করেছেন। ফলে পুরো ব্যয়ই সাজানো বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

অনার্স কেন্দ্র ফি খাতেও অনিয়মের চিত্র উঠে এসেছে প্রতিবেদনে। তিন হাজার ৬৪৮ শিক্ষার্থীর কাছ থেকে কেন্দ্র ফি হিসেবে পাওয়া ৫ লাখ ৪৭ হাজার ২০০ টাকার মধ্যে ব্যয় দেখানো হয়েছে ৪ লাখ ৩৭ হাজার ৭৬০ টাকা। ২০২৪ সালের ১১ আগস্টের ভাউচার অনুযায়ী একদিনের আপ্যায়নে ব্যয় দেখানো হয়েছে ১ লাখ ৩৫ হাজার ৭৭০ টাকা।

মাস্টার্স শেষপর্ব পরীক্ষার অভ্যন্তরীণ তহবিলে আয় ছিল ৭ লাখ ১০ হাজার ৮৫০ টাকা। পরীক্ষা পরিচালনা ৫ লাখ ২৮ হাজার, উত্তরপত্র ৬০ হাজার ৯৩০ এবং ডিউটি বাবদ ৫৬ হাজার ৫৫ টাকা ব্যয় দেখানো হয়। কিন্তু ২০২৪ সালের ১৪ মাত্র একদিনেই আপ্যায়নে খরচ দেখানো হয় ১ লাখ ৫১ হাজার ৮৭০ টাকা। যা অযৌক্তিক বলে জানিয়েছে কমিটি। একইভাবে মাস্টার্স কেন্দ্র ফি আয় ৪ লাখ ৮৪ হাজার ৯৫০ টাকার মধ্যে ব্যয় দেখানো হয় ৩ লাখ ৮৭ হাজার ৯৬০ টাকা, যেখানে একদিনের আপ্যায়ন খরচ থাকে ১ লাখ ৩৯ হাজার ৪১২ টাকা দেখানো হয়েছে।

সবচেয়ে আলোচিত ভুয়া ভাউচার পাওয়া গেছে অনার্স ২য় বর্ষ পরীক্ষার ক্ষেত্রে। এ পরীক্ষায় কলেজের মোট আয় ছিল ১২ লাখ ৯৫ হাজার ১০০ টাকা, যার ১১ লাখ ৯৫ হাজারই পরীক্ষা পরিচালনা খাতে ব্যয় দেখিয়েছিলেন তৎকালীন অধ্যক্ষ আমিনুল ইসলাম। এ ব্যয়ের মধ্যে ডিসি অফিস ৩০ হাজার, ট্রেজারি ২৫ হাজার, সিভিল সার্জন ২০ হাজার, পোস্ট অফিস ২৫ হাজার, মেডিকেল সহকারী ২০ হাজার, ভেন্যু পরিচালনা ৫০ হাজার, সকল কর্মচারী ৩ লাখ ১০ হাজার, কুলি মজুরি ৩৫ হাজার, লেবার বিল ১ লাখ, বেঞ্চে সিট লাগানো ১ লাখ ৩০ হাজার, পুলিশ রিকশাভাড়া ১৯ হাজার ৫০০ টাকা রয়েছে। এ পরীক্ষা চলাকালীন ২০২৫ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি শুধু একদিনে আপ্যায়ন ও খাসির মাংস বাবদ ব্যয় দেখানো হয়েছে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৬০৪ টাকা।

অনার্স ১ম বর্ষের পরীক্ষায় আয় ছিল ১২ লাখ ৩ হাজার ৬০০ টাকা। ব্যয়ের মধ্যে পরীক্ষাকক্ষের ১১ দিনের কর্মচারী পারিশ্রমিকই দেখানো হয়েছে ৩ লাখ ৭৫ হাজার ৫০০ টাকা। ডিসি-ট্রেজারি-পোস্ট অফিসের পিয়নদের জন্য ব্যয় দেখানো হয়েছে ৭২ হাজার, বেঞ্চ সাজানো ৬৬ হাজার ৫০০, সিট লাগানো ৫৫ হাজার ৭০০ এবং আপ্যায়ন হিসাবে দেখানো হয়েছে প্রায় ৩ লাখ টাকা। এ ব্যয়গুলোর ক্ষেত্রে তৈরি করা ভাউচারগুলোও ভুয়া বলে জানা গেছে।

গত ১৯ জুন মাউশির সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক মুহাম্মদ আজাদ খান সিরাজগঞ্জ সরকারি কলেজে যান। মাউশি ডিজির আপ্যায়ন এবং উপহারের কথা বলে কলেজের ১৭টি বিভাগ থেকে ৫১ হাজার টাকা নেন আমিনুল ইসলাম। এছাড়া কয়েকটি কলেজ থেকে অর্ধ লাখ করে টাকা নেন তিনি। এই টাকা মাউশি ডিজির আপ্যায়নে ব্যয় না করে আত্মসাৎ করেছেন আমিনুল ইসলাম।-প্রতিবেদনের তথ্য

পরিবহনহীন কলেজে পরিবহন ফি আদায় ৭০ লাখ, পুরোটাই আত্মসাৎ
সিরাজগঞ্জ সরকারি কলেজে ছাত্র-ছাত্রী পরিবহনের কোনো ব্যবস্থা না থাকা সত্ত্বেও ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ২৫০ টাকা করে পরিবহন ফি নেওয়া আদায় করেন আমিনুল ইসলাম। এই খাতে উত্তোলিত অর্থের পরিমান ৭০ লাখ টাকা। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কলেজে পরিবহন না থাকায় এ ফি আদায়ের যৌক্তিকতা নেই এবং অর্থ ব্যয়ের কোনো বৈধ খাতও নেই। ফলে যে টাকা ব্যয় করা হয়েছে তার পুরোটাই অধ্যাপক আমিনুল ইসলাম ব্যক্তিগতভাবে ব্যয় করেছেন।

মাউশির মহাপরিচালকের আপ্যায়নের নামে তোলা টাকা আত্মসাৎ
প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, গত ১৯ জুন মাউশির সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক মুহাম্মদ আজাদ খান সিরাজগঞ্জ সরকারি কলেজে যান। মাউশি ডিজির আপ্যায়ন এবং উপহারের কথা বলে কলেজের ১৭টি বিভাগ থেকে ৫১ হাজার টাকা নেন আমিনুল ইসলাম। এছাড়া কয়েকটি কলেজ থেকে অর্ধ লাখ করে টাকা নেন তিনি। এই টাকা মাউশি ডিজির আপ্যায়নে ব্যয় না করে আত্মসাৎ করেছেন আমিনুল ইসলাম।

প্রতিবেদন প্রকাশ না করার অনুরোধ, নায়েম ভবনে দেখা করার প্রস্তাব প্রতিবেদককে
এসব অনিয়মের বিষয়ে বক্তব্য জানতে চাইলে অধ্যাপক আমিনুল ইসলাম প্রতিবেদককে সংবাদ প্রকাশ না করতে অনুরোধ করেন। তিনি বলেন, ‘আমি এখন সিরাজগঞ্জ সরকারি কলেজে নেই। আমাকে পাবনা সরকারি এডওয়ার্ড কলেজে বদলি করা হয়েছে। আমার চাকরিই আছে আর কয়েকবছর। আমি শিগগিরই ঢাকা যাব। দেখা করে কথা বলব।’