Image description

নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হিসেবে দুই বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছিলেন মোহাম্মদ ইউসুফ। ১০ নভেম্বর, ২০২৪ এই নিয়োগ পান তিনি। কিন্তু এক বছর শেষ হওয়ার আগেই তাকে হঠাৎ এই মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। গত ২৩ অক্টোবর জারি করা এক প্রজ্ঞাপনে তাকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত করা হয়। ২৩ অক্টোবর তাকে যখন সরিয়ে দেওয়া হয় ওই সময় তিনি ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে। তারমধ্যেই হঠাৎ এই প্রজ্ঞাপন জারি হয়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সরিয়ে দেয়া সম্পর্কে আগাম মোটেই আঁচ করতে পারেননি তিনি। বরং প্রজ্ঞাপনের খবরে হতবাক হয়ে যান। গণমাধ্যমে খবরটি দেখার পর প্রথমে বুঝতে ভুলও হয়েছে। ভেবেছিলেন, তাকে জনপ্রশাসন সচিব করা হয়েছে। এজন্য কিছুটা বিরক্তও হয়েছেন, কেন তাকে আগে থেকে জানানো হয়নি।

এক ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি যখন খবরটি মোহাম্মদ ইউসূফের কাছে পাঠায় তা পড়ে বলেন, “আমাকে অবশেষে জনপ্রশাসন সচিব করা হলো? আমি যেতে রাজি আছি কি-না, এটা জানতে না চেয়েই প্রজ্ঞাপন জারি করা হলো? ভালো করেনি।” কিন্তু সচিবের ঘনিষ্ঠ ওই ব্যক্তি সঙ্গে সঙ্গে ভুল ভেঙে দেন এই বলে, “ভুল বুঝছেন। আপনাকে তো জনপ্রশাসন সচিব করা হয়নি। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত করা হয়েছে।” জানা যায়, এরপরে মোহাম্মদ ইউসুফ নিজের ভুল বুঝতে পেরে একেবারে চুপসে যান। সংযুক্তির এমন প্রজ্ঞাপনে তিনি হতবাক হয়ে যান। ওই সময় তার মুখ দিয়ে আর একটি কথাও বের হয়নি।

এভাবে হঠাৎ কেন মোহাম্মদ ইউসুফকে নৌ-সচিব পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হলো, এ বিষয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা গেলো, উপদেষ্টার ছেলের সঙ্গে তদবির বাণিজ্য ও ঘুষের ভাগবাটোয়ারা নিয়ে দ্বন্দ্বের বিষয়টি। উপদেষ্টার ছেলে এম সাফাক হোসেন আলোচনায় আসেন গত বছরের শেষের দিকে। উপদেষ্টা নিজে চট্টগ্রাম বন্দর পরিদর্শনে যাওয়ার সময় সঙ্গী হিসেবে ছেলে সাফাক হোসেনকে নেন। নিজের মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট অনুষ্ঠানে ছেলেকে বক্তা হিসেবে অংশগ্রহণের সুযোগ দেন। ছেলে উপহার নেন চট্টগ্রাম বন্দর চেয়ারম্যানের কাছ থেকে। এসব ছবিসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনা চলে ব্যাপকভাবে। তারপর থেকে কৌশল পাল্টে ফেলেন উপদেষ্টার পরামর্শে তার ছেলে। তলে তলে চট্টগ্রাম বন্দর পুরোই নিজের নিয়ন্ত্রণে নেন। কিন্তু এক পর্যায়ে তাতে ভাগ বসান সচিব মোহাম্মদ ইউসুফও। এ নিয়ে মাঝেমধ্যেই দ্বন্দ্ব তৈরি হতো। তবে নিজেরাই তা মিটিয়ে ফেলতেন। বন্দরের কেনাকাটাসহ সার্বিক বিষয়ে ভাগাভাগি চলছিলো।

শুধু চট্টগ্রাম বন্দরই নয়, নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীন অন্যান্য দপ্তর এবং প্রতিষ্ঠানেও একই প্রক্রিয়া চলছিল। আওয়ামী লীগ আমলে এই খাতে ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে। আওয়ামী লীগের মন্ত্রী শাজাহান খান এবং পরবর্তী প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরীও এ খাত থেকে হাতিয়ে নেন হাজার হাজার কোটি টাকা। ড্রেজিং, ড্রেজার ক্রয়, জাহাজ এবং নৌযান ক্রয়সহ বিভিন্ন কেনাকাটায় ব্যাপক অনিয়ম হয়। আওয়ামী লীগের পতনের পর সচেতন মহল আশা করেছিল যে, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন এই অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে সেইসব দুর্নীতি-লুটপাটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, আওয়ামী দুর্নীতি-লুটপাটের ঘটনাগুলোকে ধামাচাপা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এবং এতে উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন এবং সচিব মোহাম্মদ ইউসুফ- উভয়েরই সম্পৃক্ততা রয়েছে। শুধু দুর্নীতি ধামাচাপা দেওয়া-ই নয়, আওয়ামী ফ্যাসিস্ট এবং চিহ্নিত দুর্নীতিবাজদের আকর্ষণীয় পদায়ন-পদোন্নতির মাধ্যমেও পুরষ্কৃতও করা হয়েছে এই আমলে।

প্রশাসন ক্যাডারের ‘৮৬ ব্যাচের কর্মকর্তা মোহাম্মদ ইউসুফ চাকরি জীবনে কখনো ভালো অফিসারের স্বাক্ষর রাখতে পারেননি। বরং নানা অনিয়ম-অপকর্মে ধরা পড়েছেন। তবে পার পেয়ে গেছেন শশুরের কারণে। রাজনীতিতে ভালো ভাবমূর্তির অধিকারী কর্নেল (অব.) অলি আহমদ তার শ্বশুর। শুধু এই পরিচয়ের প্রভাবেই তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ে সিনিয়র সচিব হিসেবে দুই বছরের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছেন। কিন্তু চুক্তিভিত্তিক পদায়নে সচিব পদে বসেই লাগামহীনভাবে দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন।

নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দুর্নীতিতে এত বেপরোয়া সচিব ইতিপূর্বে আর কাউকে দেখেননি। কোনো দর্শনার্থী সাক্ষাত করতে এলেও তিনি এতে ধান্দা খুঁজতেন। ছোটখাটো কোনো কাজ বা সুপারিশও তিনি ‘বিনিময়’ ছাড়া করতেন না। আর কিছু না হোক অন্ততঃ একটা শার্ট-প্যান্ট হলেও ঘুষ চাইতেন। যদিও এখনকার যুগে শার্ট-প্যান্ট এমন উল্লেখযোগ্য কোনো বিষয় নয়। নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা এ প্রসঙ্গে বলেন, সচিবের বেপরোয়া ঘুষ প্রবণতার কারণে বিদেশিদের বৈঠকে অনেক সময় বিব্রতকর পরিস্থিতিতেও পড়তে হয়েছে। মোহাম্মদ ইউসুফ সচিব থাকাকালে তাকে ইঙ্গিত করে কেউ কেউ এমনও বলেছেন- উনি তো শার্ট-প্যান্টও ঘুষ নেন। কেউ কেউ এমনও প্রশ্ন করেছেন, সচিব এত শার্ট-প্যান্ট কী করেন?

জানা গেছে, সিনিয়র সচিব পদে থাকাকালে মোহাম্মদ ইউসুফ ঢাকার বাইরে যেখানেই সফরে যেতেন, আগে থেকে ওই এলাকার ঠিকাদারদের (নৌ মন্ত্রণায়লয় সংশ্লিষ্ট) জড়ো হতে নির্দেশ দিতেন। কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তো উপস্থিত থাকতেনই। তবে তিনি ঠিকাদারদের প্রত্যেকের সাথে আলাদাভাবে একান্ত বৈঠকে বসতেন।

মোহাম্মদ ইউসুফের বিরুদ্ধে আরেকটি বড় অভিযোগ ছিল, ছোট-বড় সব ধরনের বিদেশ সফরই তিনি বাগিয়ে নিতেন। এমনকি যে সফরে সাধারণ একজন কর্মকর্তা- সিনিয়র সহকারী সচিব পর্যায়ের কারো যাওয়া উচিত সেটিতেও যেতেন। এ নিয়ে কর্মকর্তারা তার ওপর অত্যন্ত বিরক্ত ছিলেন বলে জানা যায়।
শীর্ষনিউজ