দেশে আশঙ্কাজনক হারে কমছে অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যকারিতা। বাংলাদেশ মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটি (বিএমইউ) পরিচালিত এক বছরের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের প্রতি চার জনের একজনের দেহে বিভিন্ন ধরনের জীবাণু শনাক্ত হয়েছে। এসব জীবাণুর বিরুদ্ধে বহুল ব্যবহূত অ্যান্টিবায়োটিক অনেক ক্ষেত্রে কাজ করছে না।
বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএমইউ) গত এক বছরে মাইক্রোবায়োলজি ও ইমিউনোলজি বিভাগের উদ্যোগে বিভিন্ন রোগীর ৪৬ হাজার ২৭৯টি নমুনা বিশ্লেষণ করা হয়। বিশ্লেষণে দেখা যায়, ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ও ছত্রাকের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহারের কারণে সিপ্রোফ্লক্সাসিন, অ্যামোক্সিসিলিন, সেফট্রিয়াক্সোন, জেন্টামাইসিন, মেরোপেনেম, টিগেসাইক্লিনসহ বহু ওষুধ আর কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। রোগীর দেহে রেজিস্ট্যান্স তৈরি হওয়ায় এসব অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকর হয়ে পড়ছে। এর ফলে রোগ নিরাময়ে সময় দীর্ঘ হচ্ছে, এমনকি অনেক ক্ষেত্রে রোগীর মৃত্যুঝুঁকি পর্যন্ত তৈরি হচ্ছে।
বিশ্ব অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল সচেতনতা সপ্তাহ ২০২৫ উপলক্ষে সোমবার (৮ ডিসেম্বর) অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স রিপোর্ট ২০২৪–২০২৫ প্রকাশ করে বিএমইউ। ওই রিপোর্টে এসব তথ্য জানানো হয়।
রিপোর্টে বলা হয়, অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স হলো এমন একটি অবস্থা, যখন ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, ছত্রাক বা পরজীবীর মতো অণুজীবগুলো অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল ওষুধ (অ্যান্টিবায়োটিক, অ্যান্টিভাইরাল, অ্যান্টিফাঙ্গাল ইত্যাদি) দ্বারা আর মারা যায় না বা তাদের বৃদ্ধি ব্যাহত হয় না। ফলে সংক্রমণ নিরাময় কঠিন হয়ে পড়ে। এটি বিশ্বব্যাপী জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি। অ্যান্টিবায়োটিকের ভুল ব্যবহার বা অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে অণুজীবগুলো নিজেদের পরিবর্তন করে ওষুধ-প্রতিরোধী হয়ে ওঠে, ফলে সাধারণ সংক্রমণও প্রাণঘাতী হতে পারে।
‘এখনই পদক্ষেপ নিন, আমাদের বর্তমানকে রক্ষা করুন, আমাদের ভবিষ্যৎকে সুরক্ষিত করুন’—এই স্লোগান নিয়ে বিএমইউর মাইক্রোবায়োলজি ও ইমিউনোলজি বিভাগ এ সচেতনতা সপ্তাহ উদযাপন করেছে।
অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্সের (এএমআর) ক্রমবর্ধমান হুমকি মোকাবিলায় জনসচেতনতা বৃদ্ধি, অ্যান্টিবায়োটিকের যুক্তিসংগত ব্যবহার, সংক্রমণ প্রতিরোধ এবং স্বাস্থ্যসেবার ভবিষ্যৎ রক্ষায় কমিউনিটির সম্পৃক্ততা বাড়ানোই এ আয়োজনের মূল উদ্দেশ্য।
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন বিএমইউর ভাইস চ্যান্সেলর (ভিসি) অধ্যাপক ডা. মো. শাহিনুল আলম। সভাপতিত্ব করেন মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড ইমিউনোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. আবু নাসের ইবনে সাত্তার।
এ সময় ভিডিও বার্তায় প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. সায়েদুর রহমান বলেন, “একসময় মানুষ ব্যাকটেরিয়ার কাছে পরাস্ত হতো, কারণ তখন তাদের হাতে ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধের মতো যথেষ্ট ওষুধ ছিল না। আগামী ১০–১৫ বছরের মধ্যে মানবজাতি আবার সেই একই সংকটে পড়তে পারে, তবে এবার ওষুধ থাকবে, কিন্তু সেগুলো ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে কার্যকর হবে না। তাই অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্সকে এখন বিশ্বব্যাপী ‘এক মহাবিপর্যয়’ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।”
অধ্যাপক ডা. মো. শাহিনুল আলম বলেন, “সমস্যার দায় ও সমাধানের দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিতে হবে। অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স বিষয়ে গবেষণা, গাইডলাইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে বিএমইউকে নেতৃত্ব দিতে হবে। এএমআরের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা অসম্ভব নয়। মনে রাখতে হবে, যেগুলো সমাধানযোগ্য নয় তারও সমাধান খুঁজে বের করার দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের। সেই দায়িত্ব পালন করে জাতিকে আশা দেখাতে হবে।”
বিএমইউর প্রো-ভিসি (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, “অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। জনস্বাস্থ্য সম্পর্কিত এ সমস্যা মোকাবিলায় সবাইকে এখনই প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে।”
অনুষ্ঠানের সভাপতি মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড ইমিউনোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. আবু নাসের ইবনে সাত্তার বলেন, “অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স (এএমআর) বর্তমানে বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্যের অন্যতম বড় হুমকি। অযথা অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার, নিজে নিজে ওষুধ খাওয়া, অসম্পূর্ণ ডোজ গ্রহণ এবং প্রাণিসম্পদে অ্যান্টিবায়োটিকের অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে জীবাণুগুলো ধীরে ধীরে ওষুধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধী হয়ে উঠছে। এএমআর-এর কারণে আগে যে রোগ সহজেই সেরে যেত, এখন তা জটিল হয়ে যাচ্ছে। চিকিৎসার খরচ বাড়ছে, আইসিইউ ভর্তি থেকে মৃত্যু—সবই বাড়ছে অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহারের ফলে। তাই আমাদের প্রতিজ্ঞা করতে হবে—অ্যান্টিবায়োটিক সচেতনভাবে ব্যবহার করব; নিজের সিদ্ধান্তে নয়, কেবল চিকিৎসকের পরামর্শেই ওষুধ গ্রহণ করব। অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স প্রতিরোধে হাত ধোয়া, টিকাদান, নিরাপদ খাদ্য, সঠিক সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আমরা সবাই দায়িত্বশীল হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি নিরাপদ স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিশ্চিত করা সম্ভব।”
এ ছাড়াও অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন সার্জারি অনুষদের ডিন অধ্যাপক ডা. মো. ইব্রাহীম সিদ্দিক, শিশু বিভাগের ডিন অধ্যাপক ডা. মো. আতিয়ার রহমান, ডেন্টাল অনুষদের নতুন ডিন ডা. সাখাওয়াত হোসেন সায়ন্ত, নবজাতক বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মো. আব্দুল মান্নান, শিশু হেমাটোলজি অনকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মো. আনোয়ারুল করিম, ট্রান্সফিউশন মেডিসিন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. আয়েশা খাতুন, গাইনোকোলজিক্যাল অনকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. জান্নতুল ফেরদৌস, ল্যাবরেটরি মেডিসিন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মোঃ সাইফুল ইসলাম, বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. নায়লা আতিক খান, ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. ইলোরা শারমিন, পরিচালক হাসপাতাল ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইরতেকা রহমান, মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. শাহেদা আনোয়ার, সহযোগী অধ্যাপক ডা. চন্দন কুমার রায়, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. ফারজানা ইসলাম প্রমুখ।
শীর্ষনিউজ