ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে, ততই উত্তপ্ত হয়ে উঠছে দেশের নির্বাচনি মাঠ। সব কিছু ঠিক থাকলে ৮ থেকে ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে তফসিল ঘোষণা করতে পারে নির্বাচন কমিশন। অপরদিকে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত করছে।
গত ৩ নভেম্বর প্রথম দফায় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ২৩৭ আসনে প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করে। এর আগে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীও তাদের খসড়া প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করে। এরপরই নির্বাচনি মাঠে অস্থিরতা শুরু হয়। দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে সংঘাত ও সহিংসতা। রাজধানী ঢাকা, বন্দরনগরী চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জেলায় মনোনয়ন-বঞ্চিত নেতাদের বিক্ষোভ, সড়ক অবরোধ ও সংঘর্ষের ঘটনায় উদ্বিগ্ন সাধারণ মানুষ। তবে নির্বাচনি বাস্তবতাকে মেনে নিয়েই পুলিশ সার্বিক প্রস্তুতি নিয়েছে বলে জানিয়েছেন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
স্থানীয় সূত্র ও পুলিশ জানিয়েছে, বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দলকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন এলাকায় দলীয় কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ ও হামলার ঘটনা ঘটেছে। মনোনয়ন পাওয়া নেতাদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে নেমেছেন মনোনয়নবঞ্চিত সম্ভাব্য প্রার্থী এবং তাদের অনুসারীরা। এতে দলের ভেতরে আস্থার সংকট তৈরি হওয়ার পাশাপাশি সাধারণ মানুষও পড়ছেন চরম ভোগান্তিতে।
বিএনপির প্রার্থী তালিকা ঘোষণার পরপরই রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মনোনয়নবঞ্চিত নেতাকর্মীরা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানান। চট্টগ্রাম-৪ (সীতাকুণ্ড) আসনে বিএনপির সাবেক যুগ্ম মহাসচিব আসলাম চৌধুরীকে দলীয় মনোনয়ন না দেওয়ায় ওইদিন সন্ধ্যায় তার বিক্ষুব্ধ কর্মী-সমর্থকরা সীতাকুণ্ড উপজেলার ভাটিয়ারী শহীদ মিনার এলাকায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করেন।
অন্যদিকে, ঢাকা-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়েতে মনোনয়নবঞ্চিত নেতার সমর্থকরা প্রতিবাদ হিসেবে টায়ার জ্বালিয়ে সড়ক অবরোধ করেন। পরদিন ৪ নভেম্বর দেশের আরও কয়েকটি স্থানে পুরোনো ও নতুন মনোনীত প্রার্থীদের সমর্থক এবং বিক্ষুব্ধদের মধ্যে সংঘর্ষ, ভাঙচুর ও ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। মেহেরপুরের গাংনীতে মনোনয়ন পরিবর্তনের দাবিতে বিক্ষোভ হয়।
৫ নভেম্বর চট্টগ্রাম-৮ আসন থেকে বিএনপির মনোনয়নপ্রাপ্ত প্রার্থী এরশাদ উল্লাহ জনসংযোগে বের হলে দুর্বৃত্তদের গুলিতে তার অনুসারী সরোয়ার হোসেন বাবলা নিহত হন। ওই ঘটনায় প্রার্থী এরশাদ উল্লাহ পেটে গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হলেও প্রাণে বেঁচে যান। পুলিশ জানিয়েছে, নিহত বাবলার বিরুদ্ধেও নানা অভিযোগ রয়েছে। ৭ নভেম্বর ফরিদপুরে বিএনপির দুই গ্রুপের সংঘর্ষে পুলিশ সদস্যসহ বেশ কয়েকজন আহত হন।
২৭ নভেম্বর পাবনার ঈশ্বরদীতে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষ চলাকালে এক যুবককে অস্ত্র হাতে গুলি ছোড়ার একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এ ঘটনায় উভয় পক্ষই পরস্পরের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলে। বিএনপি দাবি করে, অস্ত্রধারী যুবক জামায়াত-শিবিরের কর্মী। অন্যদিকে, জামায়াত নেতারা দাবি করেন ওই অস্ত্রধারী বিএনপির কর্মী। এ ঘটনায় উভয় পক্ষের অন্তত ২৫ জন আহত হন।
মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএস) ৩ ডিসেম্বরের তথ্য অনুযায়ী, নভেম্বর মাসে সারা দেশে রাজনৈতিক সহিংসতার ৯৬টি ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় ১২ জন নিহত এবং ৮৭৪ জন আহত হয়েছেন। এতে মনোনয়নকেন্দ্রিক সম্ভাব্য প্রার্থী ও মনোনয়নবঞ্চিতদের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ, হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় আহত হয়েছেন আরও ৮৭৪ জন। এর মধ্যে বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দল সংশ্লিষ্ট ৪২টি ঘটনায় অন্তত ৫১২ জন আহত এবং ১০ জন নিহত হয়েছেন।
এইচআরএস আরও জানিয়েছে, বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে ৯টি সংঘর্ষে ৫২ জন আহত হয়েছেন। বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে ৬টি সংঘর্ষে আহত হয়েছেন ৪১ জন। বিএনপি ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের মধ্যে ১৫টি ঘটনায় আহত হয়েছেন ১৫৫ জন। এছাড়া অন্যান্য দলের মধ্যে সংঘর্ষের ২৪টি ঘটনায় আহত ১১৪ জন এবং নিহত হয়েছেন ২ জন।
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে নতুন বাস্তবতা
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর রাজনৈতিক মাঠে বড় পরিবর্তন এসেছে। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর আওয়ামী লীগের কার্যক্রম স্থগিত করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। ফলে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে দলটির অংশগ্রহণ নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সক্রিয় নেতারা বলে আসছেন, আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে জাতীয় নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না। এ দাবির পরিপ্রেক্ষিতে আগামী দিনগুলোতে রাজনৈতিক মাঠ আরও উত্তপ্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
অন্যদিকে, আওয়ামী লীগের সময়ে ২০১৩ সালে নিবন্ধন হারানো এবং ২০২৪ সালের ৩ আগস্ট নিষিদ্ধ হওয়া জামায়াতে ইসলামী নতুন করে রাজনৈতিক তৎপরতা বাড়িয়েছে। দলটি খসড়া প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করেছে। জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) আরও কয়েকটি দলও নির্বাচনের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে নিজেদের প্রার্থী তালিকা প্রাথমিকভাবে তৈরি করেছে। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে রবিবার (৭ডিসেম্বর) এক সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), আমার বাংলাদেশ পার্টি (এবি পার্টি) ও বাংলাদেশ রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন মিলে নতুন রাজনৈতিক মঞ্চ ‘গণতান্ত্রিক সংস্কার জোট’র ঘোষণা দিয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে এই জোটের ঘোষণা দেন এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম।
প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর প্রার্থীরা এরই মধ্যে অনলাইনে-অফলাইনে প্রচারণা শুরু করে দিয়েছেন। দল মনোনীত প্রার্থীর সঙ্গে মনোনয়ন বঞ্চিতদের যেমন সংঘর্ষের খবর পাওয়া গেছে, তেমনি কিছু জায়গায় প্রতিদ্বন্দ্বী অন্য দলের কর্মীদের মধ্যেও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এমন পরিস্থিতিতে সারা দেশে ধারাবাহিকভাবে ভয়াবহ হামলা ও প্রকাশ্য হত্যাকাণ্ডের ঘটনাও ঘটেছে। যদিও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বারবার গণমাধ্যমগুলোকে আশ্বস্ত করে বলছেন, ‘ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের আগে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির কোনও আশঙ্কা নেই।’ তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ‘নির্বাচন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে উত্তেজনা আরও বাড়তে পারে।’
নির্বাচন কেন্দ্রিক সহিংসতা নিয়ে শঙ্কিত হওয়ার পরিস্থিতি বিরাজমান কিনা প্রশ্নে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. সাজ্জাদ সিদ্দিকী বলেন, ‘নির্বাচন হতে হলে যে পরিস্থিতি রাখা দরকার, সরকারের যে দায়িত্ব ছিল তারা সেটা রাখতে ব্যর্থ হয়েছে না বললেও অনেক ক্ষেত্রে সফলভাবে করতে পারেনি। শুরু থেকে নির্বাচনের দিনক্ষণ নিয়ে ধূম্রজাল সৃষ্টি করেছে। নির্বাচনের তারিখসহ স্পষ্ট রোডম্যাপ সামনে থাকলে অনেকে যে সরকারের দিক থেকে টালবাহানার অভিযোগ আনছেন সেটা আসতো না। রাজনৈতিক দলগুলো পারস্পরিক যে বিষোদগার করছে সেটা পরিস্থিতি আরও খারাপ দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আবার নির্বাচনি মাঠে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডও নেই। আওয়ামী লীগ নেই, এখনও জাতীয় পার্টি নেই, বিএনপির শীর্ষ নেতা দেশের বাইরে ও হাসপাতালে। ফলে সরকার আগে থেকে যত্নবান না হওয়ার পরিপ্রক্ষিতে এ ধরনের একটা পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে বলে আমি মনে করি।’
নির্বাচনি সহিংসতা ঠেকাতে পুলিশের সর্বাত্মক প্রস্তুতি
তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচনি সংঘাত-সহিংসতা প্রতিরোধে সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিয়েছে পুলিশ। সারা দেশে গোয়েন্দা নজরদারিও বাড়ানো হয়েছে। অস্ত্র উদ্ধার ও সন্ত্রাসী গ্রেফতার অভিযানও অব্যাহত রয়েছে। তবে সহিংসতা থামবে নাকি আরও বাড়বে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তারা যা বলছেন
নির্বাচনি সহিংসতা প্রতিরোধে পুলিশের প্রস্তুতি সম্পর্কে জানতে চাইলে আইজিপি বাহারুল আলম বলেন, ‘আমরা পুরোপুরি প্রস্তুত রয়েছি। এ নিয়ে আমরা গত কয়েক মাসে মূল্যায়ন করেছি। আর তফসিল ঘোষণার পর আমাদের মতো দেশে সংঘাত ও সহিংসতা একটু বাড়তে পারে। মৃত্যুহীন নির্বাচন তো এ পর্যন্ত হয়নি। বড় দুটি দল যদি একসঙ্গে থাকতো তাহলে হয়তো বেশি হতো।’
তফসিল ঘোষণার পর ঢাকাসহ দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে, এমন আশঙ্কা করছেন অনেকে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী বলেন, ‘সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো। এখন পর্যন্ত কোনও সমস্যা নেই।’