Image description

জুলাই বিপ্লবে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সর্বশেষ একতরফা নির্বাচনে সংশ্লিষ্টদের বাগে আনতে রাষ্ট্রীয় শক্তির চরম অপব্যবহার করেন। এ সময় বিচারাধীন মামলার রায়কে উপেক্ষা করে অবৈধ রূপসা প্রকল্পে বিলাসবহুল ফ্ল্যাট উপহার দেওয়া হয় তৎকালীন বিচারপতি ও আমলাদের। রাজধানীর গুলশানের প্রাণকেন্দ্রে প্রায় তিন হাজার ১০০ বর্গফুটের অভিজাত এসব ফ্ল্যাট দেওয়া হয় পানির দামে।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আমলা ও বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের বাগে আনতে ফ্যাসিজমের দোসর ৪৮ ভিআইপিকে শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে ফ্ল্যাট উপহার দেওয়া হয়।

ফ্ল্যাট পাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছেনÑতৎকালীন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান শাহীন, তৃতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ আপিল বিভাগের বিচারপতি আবু জাফর সিদ্দিকী, হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি (বর্তমানে বহাল) কামরুল হাসান মোল্যা, আপিল বিভাগের পদত্যাগকারী বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের ছোট ভাই আশিকুর রহিম, সাবেক স্বরাষ্ট্র সচিব (বর্তমানে কারাগারে) জাহাঙ্গীর আলম, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের তৎকালীন জ্যেষ্ঠ সচিব আমিনুল ইসলাম খান, রাজউকের তৎকালীন চেয়ারম্যান আনিসুর রহমান মিঞা এবং সাবেক আইজিপি ও আওয়ামী লীগের এমপি নূর মোহাম্মদ।

সম্প্রতি দুদকের এনফোর্সমেন্ট ইউনিটের একটি টিম গুলশানে অভিযান চালিয়ে ফ্ল্যাট বরাদ্দের ক্ষেত্রে চরম অনিয়ম ও দুর্নীতির সত্যতা পায়। দুদম টিমের পাওয়া তথ্যমতে, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে গুলশান-২-এর ওয়েস্টিন হোটেলের পেছনের সিএনডব্লিউ (বি) রোড-৩৫, বাড়ি নম্বর ৮ প্লটে রাজউকের রূপসা প্রকল্পে নিজেদের পছন্দের লোকজনসহ বিচারপতি, আমলা, রাজনৈতিক নেতা ও তাদের সন্তানদের কম দামে ফ্ল্যাট বরাদ্দ দেয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের এনফোর্সমেন্ট টিমের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, মূলত বিগত সময়ে যারা শেখ হাসিনার বিভিন্ন অবৈধ কর্মকাণ্ডে সহায়তা করেছিলেন, তাদের বেছে বেছে খুব কম দামে ফ্ল্যাট দেওয়া হয়। বিশেষ করে চব্বিশের নির্বাচনকে টার্গেট করেই এগুলো করা হয়।

উচ্চ আদালত ও মামলা সূত্রে জানা গেছে, ১৯৬৩ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি জাহিরা ওসমানের স্বামী মরহুম ওসমান শেখের নামে তৎকালীন ডিআইটি রূপসা প্রকল্পের প্লটটি ৯৯ বছরের জন্য লিজ দেয়। পরে সম্পত্তিটি পরিত্যক্ত ‘ক’ তালিকাভুক্ত হলে জাহিরা ওসমান কোর্ট অব সেটেলমেন্টে মামলা করেন। তখন আদালত বাদীর পক্ষে রায় দেয়। ওই রায়ের বিরুদ্ধে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় ১৯৯৭ সালে একটি রিট পিটিশন মামলা করে। তাতেও আদালত সরকারের বিপক্ষে রায় দেয় এবং কোর্ট অব সেটেলমেন্টের রায় বাস্তবায়ন করে মালিককে প্লট বুঝিয়ে দিতে ৬০ দিন সময় বেঁধে দেয়। কিন্তু সেটি পালিত না হলে জাহিরা ওসমান হাইকোর্টে আদালত অবমাননার মামলা করেন। মামলাটিতে হাইকোর্ট সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে ২০১০ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি আবেদনকারীর পরিচয় শনাক্তের মাধ্যমে দ্রুত রায় বাস্তবায়ন করতে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেয়। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার আদালতের সুনির্দিষ্ট রায়কে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সেখানে রূপসা অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্প শুরু করে, যেখানে বিচারপতি ও আমলাদের ফ্ল্যাট উপহার দিয়ে এক ঢিলে দুই পাখি মারে তারা। গুলশানে যেখানে ফ্ল্যাটের দাম কমপক্ষে ৩০ হাজার টাকা বর্গফুট, সেখানে এসব ভিভিআইপিকে দেওয়া হয় মাত্র ১৪ হাজার টাকায়। তাও আবার মাত্র ৩০ শতাংশ বুকিংয়ের বিনিময়ে।

দুদকের উপপরিচালক (জনসংযোগ) আকতারুল ইসলাম বলেন, বিগত সরকারের আমলে রূপসা অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্পে গোপনে অনুগত বিচারপতি, আমলা, আওয়ামী লীগ নেতা, তাদের সন্তান এবং বিভিন্ন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাকে বাজারদরের তুলনায় অনেক কম দামে ফ্ল্যাট বরাদ্দ দেওয়া হয়। এনফোর্সমেন্ট টিম এ বিষয়ে দুর্নীতি ও অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছে। বরাদ্দ প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা যাচাইয়ে ফ্ল্যাট বরাদ্দের আবেদন, বরাদ্দ প্রদানসংক্রান্ত কাগজপত্র এবং বরাদ্দপ্রাপ্তদের তালিকা সংগ্রহ করা হয়েছে। সর্বশেষ তথ্যমতে, রূপসা অ্যাপার্টমেন্টে দুর্নীতির আনুষ্ঠানিক অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। দুদকের একটি টিম এ অনুসন্ধান পরিচালনা করছে।

এ বিষয়ে জমির বর্তমান অখণ্ড আমমোক্তার মোতালেব ভূঁইয়া বলেন, সব রায় আমাদের পক্ষে এবং আদালত থেকে বারবার সরকারকে প্লট বুঝিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হলেও আওয়ামী লীগ সরকার আমাদের অধিকার হরণ করে। আমি সর্বোচ্চ আদালতের বিচারপতিদের পাশাপাশি প্রধান উপদেষ্টাসহ সবার কাছে আকুল আবেদন জানাচ্ছি, সম্পত্তিটির স্থাবর-অস্থাবর সবকিছু যেন আমাদের বুঝিয়ে দেওয়া হয়। দীর্ঘ সময় আদালতে ঘুরতে ঘুরতে আমি অসুস্থ হয়ে পড়েছি। অনেক সময় আমার জীবনের ওপর হুমকি এসেছে। বর্তমান সরকার এ ব্যাপারে দ্রুত ব্যবস্থা নেবে বলে আশা করি।

এ বিষয়ে জানতে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব নজরুল ইসলামকে মোবাইলে মেসেজ পাঠানো হলেও তিনি কোনো উত্তর দেননি। মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (আইন অধিশাখা) বাবার আলী আমার দেশকে জানান, বিচারাধীন সম্পত্তিতে কীভাবে অ্যাপার্টমেন্ট তৈরি হচ্ছে, সেটি জানা নেই। কাগজপত্র ঘেঁটে দেখতে হবে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ আইন সমিতির আহ্বায়ক ও সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী মনির হোসেন আমার দেশকে বলেন, ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সাড়ে ১৫ বছর বিভিন্নভাবে বিচার বিভাগকে কবজা করতে কাজ করেছেন। বিশেষ করে সর্বশেষ বিতর্কিত ন্যক্কারজনক নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিচারপতি ও আমলাদের বাগে আনতে গুলশানে কম দামে লোভনীয় ফ্ল্যাট দেওয়া ওই ষড়যন্ত্রেরই বহিঃপ্রকাশ। এ ব্যাপারে জড়িতদের দ্রুত আইনের আওতায় আনা উচিত এবং হাসিনার লুটপাটের প্রকল্পটি বাতিল করে সঠিক মালিককে ফিরিয়ে দেওয়া দরকার।