Image description
 

দেশে সরকারি আইন সহায়তা কার্যক্রম এখন আর শুধু বিনা খরচে গরিব-অসহায় মানুষের মামলা পরিচালনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থার মাধ্যমে দেওয়া এই আইন সহায়তার পরিধির ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটেছে। বিনা খরচে মামলা পরিচালনার পাশাপাশি যে কোনো বিচারপ্রার্থীকে আইনি পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। ৯টি আইনের বিরোধ প্রচলিত আদালতে মামলা দায়েরের আগেই আইনগত সহায়তা প্রদান অফিসে মধ্যস্থতার মাধ্যমে নিষ্পত্তির উদ্যোগ গ্রহণ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। শ্রমিকের আইনি সহায়তার জন্য আইন সহায়তা সেল স্থাপনসহ নানামুখী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে লিগ্যাল এইড (আইনগত সহায়তা) অফিসের সক্ষমতা বাড়ানোর।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জনমুখী বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা, ধনী-গরিব সবার জন্য সমান আইনি অধিকার প্রাপ্তি নিশ্চিত করা, স্বল্প ও কম খরচে মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করাসহ নানা দিক বিবেচনায় সরকার এসব পদক্ষেপ নিয়েছে। দেশের প্রচলিত আদালতে যে পরিমাণ মামলা বিচারাধীন, তাতে করে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে বিকল্প উপায়ে বিরোধ নিষ্পত্তির বিকল্প নেই। সেই লক্ষ্যে সরকারের আইনি সহায়তা কার্যক্রমকে ঢেলে সাজানো হয়েছে। এই কার্যক্রমকে গতিশীল ও ফলপ্রসূ করার জন্য এবার জাতীয় আইনগত সহায়তা সংস্থা বিলুপ্ত করে আইনগত সহায়তা অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠা করতে যাচ্ছে সরকার। এরই মধ্যে আইনগত সহায়তা প্রদান আইন দ্বিতীয় দফায় সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সংশোধিত অধ্যাদেশের খসড়াও চূড়ান্ত করা হয়েছে। আগামী সপ্তাহে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সচিব পর্যায়ের বৈঠকে খসড়া অধ্যাদেশটি চূড়ান্ত করা হবে বলে সূত্র জানিয়েছে।

সংশোধিত অধ্যাদেশে জাতীয় আইনগত সহায়তা সংস্থা বিলুপ্ত করে বাংলাদেশ আইনগত সহায়তা অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে। এই অধিদপ্তরের প্রধান হবেন একজন মহাপরিচালক। বিদ্যমান আইনে সংস্থা পরিচালনার জন্য জাতীয় পরিচালনা বোর্ড রয়েছে। এর পরিবর্তে অধ্যাদেশে জাতীয় উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করার কথা বলা হয়েছে।

 

অধিদপ্তরের বিশেষ দায়িত্বের ব্যাপারে খসড়া অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, ‘অধিদপ্তর বাংলাদেশে আইনগত সহায়তা সেবা সংক্রান্ত কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সরকারিভাবে এখতিয়ারসম্পন্ন একমাত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে; আইনগত সহায়তা সেবা সংক্রান্ত কার্যক্রম পরিচালনার সাথে সম্পৃক্ত বেসরকারি সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানসমূহের কর্মএলাকা নির্ধারণে সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠানকে সুপারিশ বা মতামত প্রদান করতে পারবে এবং সময় সময় তাদের আইনগত সহায়তা প্রদান কার্যক্রমসমূহ পর্যবেক্ষণ করবে; পেশাদার মধ্যস্থতাকারী সৃষ্টির উদ্দেশ্যে প্রশিক্ষণ কার্যক্রমসহ মধ্যস্থতার সনদ প্রদান করবে; প্রবাসী নাগরিক ও বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশি শ্রমিকদের আইনগত সহায়তা প্রদানের জন্য বিভিন্ন দূতাবাসে লিগ্যাল এইড অফিসার পদায়নে সরকারকে সুপারিশ ও প্রয়োজনীয় পরামর্শ প্রদান করবে; অধিদপ্তর এই ধারার বিধান বাস্তবায়নকল্পে প্রয়োজনীয় যে কোনো নির্দেশনা প্রস্তুত ও জারি করতে পারবে।’

 
 

অধিদপ্তরের দায়িত্ব ও কার্যাবলির ব্যাপারে খসড়ায় আরও বলা হয়েছে, আর্থিকভাবে অসচ্ছল, সহায়-সম্বলহীন এবং নানাবিধ আর্থসামাজিক কারণে বিচারপ্রাপ্তিতে অসমর্থ বিচারপ্রার্থী জনগণকে সরকারি খরচে আইনগত সহায়তা প্রদান; স্বল্পতম সময়ে ও ন্যূনতম ব্যয়ে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি সেবা প্রদানের উদ্দেশ্যে মধ্যস্থতা সেবার সম্প্রসারণ ও বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ; কোনো নাগরিক বা শিশু বা সংক্ষুদ্ধ ব্যক্তির তাৎক্ষণিক জরুরি আইনগত সহায়তা প্রয়োজন হলে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে জরুরি আইনগত সহায়তা ও আইনি পরামর্শ প্রদান; অধিদপ্তরের সামর্থ্য সাপেক্ষে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে পুনবার্সনমূলক আইনগত সহায়তা প্রদান করবে; মহানগর, জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে বা যে কোনো স্থানে আইনগত পরামর্শ প্রদানে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করবে।

 

এতে বলা হয়েছে, আইনগত শিক্ষা বিস্তারে পদক্ষেপ গ্রহণ; আইন বিষয়ে মৌলিক ধারণালব্ধ জনগোষ্ঠীর হার বৃদ্ধির উদ্যোগ গ্রহণ; স্বেচ্ছায় আইনগত সেবা প্রদানে ইচ্ছুক জনগোষ্ঠী গড়ে তোলা; কেন্দ্রীয় থেকে তৃণমূল সব পর্যায়ে আইনগত সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে সভা, সেমিনার, গণশুনানি, উঠান-বৈঠক, কর্মশালার আয়োজন ও প্রচারণামূলক কার্যক্রম গ্রহণ; জনসচেতনতামূলক তথ্যপ্রচার; প্রচারণামূলক সামগ্রী তৈরি ও বিতরণ এবং প্রচারের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা।

এতে বলা হয়েছে, সব বিচারপ্রার্থী জনগণের জন্য আইনগত সহায়তা কার্যক্রম ডিজিটাল পদ্ধতিতে সহজলভ্য করণ; মহানগর, জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়সহ অধিদপ্তরের অধীন সকল কার্যালয়ে আইনগত সহায়তা ও বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি সংক্রান্ত কার্যক্রম তদারকি ও নিয়ন্ত্রণ; অসমর্থ বিচারপ্রার্থীগণের আইনগত সহায়তা পাওয়ার যোগ্যতা নিরূপণসহ আইনগত সহায়তা সংশ্লিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন; আইনের অধীন দায়িত্বপ্রাপ্ত চিফ লিগ্যাল এইড অফিসার, লিগ্যাল এইড অফিসার, প্যানেল আইনজীবী এবং স্পেশাল মধ্যস্থতাকারীদের কার্যাবলি নিয়ন্ত্রণ ও তত্ত্বাবধান করা।

আইন বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের স্পেশাল কনসালট্যান্ট ব্যারিস্টার তানিম হোসেন শাওন এ ব্যাপারে বলেন, বর্তমান সরকার লিগ্যাল এইড কার্যক্রমের ব্যাপ্তি ও পরিধি অনেক বাড়িয়েছে। গরিব-অসহায় মানুষকে আইন সহায়তা প্রদানের পাশাপাশি মধ্যস্থতার মাধ্যমে মামলা নিষ্পত্তিতে জোর দিয়ে সংশ্লিষ্ট আইনের সংশোধনী এনেছে। প্রচলিত আদালতে মামলা জটের যে অবস্থা, তাতে লিগ্যাল এইড অফিসের মাধ্যমে মধ্যস্থতার ভিত্তিতে বিরোধ নিষ্পত্তির কোনো বিকল্প নেই। এই পদ্ধতিতে স্বল্প খরচে, কম সময়ে বিরোধ নিষ্পত্তি করা সম্ভব। সেজন্য সরকার লিগ্যাল এইড অফিসের কার্যক্রমকে ফলপ্রসূ ও সফল করার উদ্দেশ্যে আইনগত সহায়তা অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠা করতে যাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, এ ছাড়া অধিদপ্তরের একটি কাজ হলো পেশাদার মধ্যস্থতাকারী তৈরি করা যাতে সরকারের লিগ্যাল এইড অফিসের বাইরেও তারা বিরোধ নিষ্পত্তিতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেন। এটা করা সম্ভব হলে আদালতে মামলার চাপ অনেক কমে যাবে। এ ছাড়া বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের সুপারিশেও আইনগত সহায়তা সংস্থাকে অধিদপ্তর করার প্রস্তাব করা হয়েছিল। সে অনুযায়ী মন্ত্রণালয় পদক্ষেপ নিয়েছে।

জানা গেছে, আর্থিক সংকটের কারণে যাতে নাগরিকরা আইনের আশ্রয় লাভের ক্ষেত্রে সমতার সুযোগ থেকে বঞ্চিত না হয়, এ জন্য ২০০০ সালে ‘আইনগত সহায়তা প্রদান’ আইন করা হয়। এ আইন অনুসারে, ২০০১ সালে জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা গঠন করা হয়। ২০০৯ সালের আগ পর্যন্ত সংস্থাটির কার্যক্রম ছিল স্থবির। ২০০৯ সালে সংস্থার জন্য পৃথক কার্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। পাশাপাশি প্রতিটি জেলা আদালতে সংস্থার কার্যালয় স্থাপন করা হয়। এখন দেশের ৬৪ জেলায় স্থায়ী লিগ্যাল এইড অফিস রয়েছে।

জানা গেছে, ২০০৯ সাল থেকে গত মার্চ পর্যন্ত এ সংস্থায় ১১ লাখ ৯৫ হাজার ৭৫ জন অসচ্ছল বিচারপ্রার্থী বিনামূল্যে আইনি সেবা নিয়েছেন। সুপ্রিম কোর্ট লিগ্যাল এইড অফিস, দেশের ৬৪ জেলা লিগ্যাল এইড অফিস, ঢাকা ও চট্টগ্রাম শ্রমিক আইনগত সহায়তা সেল, সরকারি আইনি সহায়তায় জাতীয় হেল্পলাইন কলসেন্টারে (টোল ফ্রি-‘১৬৪৩০’) মাধ্যমে এ সেবা দেওয়া হয়। আর এ সময়ে ক্ষতিপূরণ হিসেবে ২৫২ কোটি ৫১ লাখ ৬১ হাজার ৮১ টাকা আদায় করে বিচারপ্রার্থীদের দিয়েছে জেলা লিগ্যাল অফিসগুলো।

আইনের ২১ক ধারা অনুসারে সারা দেশে লিগ্যাল এইড অফিসার বিকল্প পদ্ধতিতে প্রচলিত আদালতের বাইরে বিরোধ নিষ্পত্তি করেন এবং আইনি সেবাপ্রত্যাশীদের আইনি পরামর্শ প্রদান করেন। আইনের অধীনে থেকে লিগ্যাল এইড অফিসার ‘মধ্যস্থতা কার্যক্রম’ পরিচালনা করেন এবং আইনি প্রক্রিয়ায় দুপক্ষের সম্মতি ও সমঝোতায় মধ্যস্থতা চুক্তি সম্পাদন করে থাকেন। এ প্রক্রিয়ায় বিরোধ নিষ্পত্তিতে সুফলও মিলছে। অর্থ ও সময় দুটিই সাশ্রয় হচ্ছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে সারা দেশে ৪৫ লাখ মামলা বিচারাধীন। মামলাজট চরম আকার ধারণ করেছে। বিদ্যমান মামলার সঙ্গে প্রতিনিয়ত নতুন দায়েরকৃত মামলা যুক্ত হচ্ছে। মামলার সংখ্যানুপাতে বিচারকের সংখ্যা অপ্রতুল। এ অবস্থায় যেসব বিরোধ আপসযোগ্য অথবা সমঝোতায় দ্রুত এবং সহজে নিষ্পত্তি করা সম্ভব, সেসব বিরোধ বা অভিযোগ চিহ্নিতক্রমে মামলা দায়েরের আগেই মধ্যস্থতার মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা গেলে বিচারপ্রার্থীরা যেমন উপকৃত হবেন, তেমনি এ খাতে রাষ্ট্রের অর্থ ব্যয়ও হ্রাস পাবে। সে লক্ষ্যে সরকার বর্তমানে লিগ্যাল এইডের মাধ্যমে যে পরিমাণ মামলা নিষ্পত্তি হচ্ছে, তা তিন গুণ বৃদ্ধির লক্ষ্যে গত ১ জুলাই আইন সংশোধন করে অধ্যাদেশ জারি করে।

সংশোধিত অধ্যাদেশে লিগ্যাল এইড অফিসের পরিধি বাড়ানোর কথা হয়েছে। এ ছাড়া ৯টি আইনের (দেওয়ানি পাঁচটি ও ফৌজদারি চারটি) বিরোধ ও অভিযোগে প্রচলিত আদালতে মামলা দায়েরের আগেই মধ্যস্থতার মাধ্যমে নিষ্পত্তির উদ্যোগ গ্রহণ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এরই মধ্যে ১২টি জেলায় এ বিধান কার্যকর করা হয়েছে। জেলাগুলো হচ্ছে—ফরিদপুর, ময়মনসিংহ, দিনাজপুর, রংপুর, সাতক্ষীরা, কুষ্টিয়া, কুমিল্লা, নোয়াখালী, রাঙামাটি, সিলেট, মৌলভীবাজার এবং সুনামগঞ্জ। এ ছাড়া এ বিধান প্রয়োগের জন্য বিধি তৈরি করেছে সরকার।

‘যেসব আইনের বিরোধ মধ্যস্থতার মাধ্যমে নিষ্পত্তির উদ্যোগ নিতে হবে’

সংশোধিত অধ্যাদেশে পারিবারিক আদালত আইন, ২০২৩-এর ধারা ৫-তে উল্লিখিত বিষয়; বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৯১-তে উল্লিখিত বিরোধ; সহকারী জজ আদালতের এখতিয়ারভুক্ত কটন সম্পর্কিত বিরোধ; স্টেট অ্যাকুইজিশন অ্যান্ড টেনান্সি অ্যাক্ট-১৯৫০-এর সেকশন ৯৬-তে উল্লিখিত অগ্রক্রয় সম্পর্কিত বিরোধ; নন-এগ্রিকালচার টেনান্সি অ্যাক্ট, ১৯৪৯-এর সেকশন ২৪-এ উল্লিখিত অগ্রক্রয় সম্পর্কিত বিরোধ: পিতা-মাতার ভরণপোষণ আইন, ২০১৩-এর ধারা ৮ অনুসারে পিতা-মাতার ভরণপোষণ সম্পর্কিত বিরোধ; নিগোশিয়েবল ইন্সট্রুমেন্ট অ্যাক্ট, ১৮৮১-এর সেকশন ১৩৮-এ বর্ণিত চেক ডিজঅনার সম্পর্কিত অভিযোগ (অনধিক ৫ লাখ টাকা মূল্যমান চেকের ক্ষেত্রে); যৌতুক নিরোধ আইন, ২০১৮-এর ধারা ৩ ও ৪ তে বর্ণিত যৌতুক সম্পর্কিত অভিযোগ এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০-এর ধারা ১১(গ)-তে বর্ণিত যৌতুকের জন্য নির্যাতন সম্পর্কিত অভিযোগে মামলা দায়েরের পূর্বে মধ্যস্থতার মাধ্যমে নিষ্পত্তির উদ্যোগ গ্রহণ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

অধ্যাদেশে ৯টি আইনের বিরোধের বিষয়ে মামলাপূর্ব মধ্যস্থতা প্রক্রিয়ার উদ্যোগ গ্রহণের ব্যাপারে বলা হয়েছে, ‘বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে সংক্ষুব্ধ পক্ষকে আবশ্যিকভাবে ওই বিরোধ প্রথমে লিগ্যাল এইড অফিসে মধ্যস্থতার মাধ্যমে নিষ্পত্তির উদ্দেশ্যে আবেদন করতে হবে; মধ্যস্থতা প্রক্রিয়া ব্যর্থ হলে বিরোধের কোনো পক্ষ প্রয়োজনে উপযুক্ত আদালতে মামলা দায়ের করতে পারবে। মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে মামলা দায়েরকারীকে বিধি দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে প্রস্তুতকৃত প্রতিবেদন সংশ্লিষ্ট আদালতে বাধ্যতামূলকভাবে দাখিল করতে হবে। মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে মামলাপূর্ব মধ্যস্থতা প্রক্রিয়ায় ব্যয়িত সময় তামাদির মেয়াদ গণনার ক্ষেত্রে বাদ যাবে।’

‘লিগ্যাল এইড অফিসের সক্ষমতা বৃদ্ধি’

সংশোধিত অধ্যাদেশের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে এতে প্রতিটি লিগ্যাল এইড অফিসে লিগ্যাল এইড অফিসারের পাশাপাশি একজন চিফ লিগ্যাল এইড অফিসার ও স্পেশাল মেডিয়েটর নিয়োগের কথা বলা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ‘এই আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে সরকার, বিধি দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে, বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিসের সদস্যদের মধ্য হতে, প্রয়োজনীয় সংখ্যক চিফ লিগ্যাল এইড অফিসার এবং লিগ্যাল এইড অফিসার নিয়োগ ও পদায়ন করবে এবং তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সংস্থা, সময় সময়, আদেশ দ্বারা নির্ধারণ করবে।’ এতে আরও বলা হয়েছে, ‘চিফ লিগ্যাল এইড অফিসার বা লিগ্যাল এইড অফিসার আইনগত সহায়তা প্রার্থীকে, বিধি দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে, আইনি পরামর্শ প্রদান করতে পারবে, মামলাপূর্ব মধ্যস্থতার উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারবে এবং প্রচলিত আইনের অধীন আপসযোগ্য যে কোনো বিষয় কোনো আদালত বা ট্রাইব্যুনাল মামলা দায়ের-পরবর্তী মধ্যস্থতা কার্যক্রমের জন্য পাঠালে তা নিষ্পত্তির ক্ষমতা সংশ্লিষ্ট অফিসারের থাকবে।’

মধ্যস্থতা-চুক্তির কার্যকারিতা বিষয়ে আইনে বলা হয়েছে, ‘(১) পক্ষগণের স্বাক্ষর ও মধ্যস্থতাকারীর স্বাক্ষরক্রমে সম্পাদিত এবং চিফ লিগ্যাল এইড অফিসার কর্তৃক প্রত্যায়িত প্রতিটি মধ্যস্থতা চুক্তি চূড়ান্ত, বলবৎযোগ্য এবং পক্ষগণের ওপর বাধ্যকর হবে। ওই চুক্তি আদালতের ডিক্রি অথবা ক্ষেত্রমত, চূড়ান্ত আদেশ বলে গণ্য হবে এবং এখতিয়ারসম্পন্ন আদালতের মাধ্যমে ওই ডিক্রি বা আদেশ জারি করা যাবে। এই আইনের অধীন মামলাপূর্ব মধ্যস্থতা কার্যক্রম চলমান অবস্থায় বিশেষ কোনো ব্যবস্থা গ্রহণের কারণ উদ্ভূত হলে লিগ্যাল এইড অফিস প্রয়োজনীয় আদেশ বা নির্দেশ দিতে পারবে এবং ওই আদেশ বা নির্দেশ বাস্তবায়নে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, সংবিধিবদ্ধ সরকারি সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করবে।’

স্পেশাল মেডিয়েটর (মধ্যস্থতাকারী) নিয়োগের ব্যাপারে সংশোধিত অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, ‘(১) এই আইনের অধীনে স্পেশাল মেডিয়েটর হিসাবে কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সংস্থা, সরকারের পূর্বানুমোদনক্রমে, অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ এবং মধ্যস্থতা বিষয়ে অভিজ্ঞ ও বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আইনজীবীদের মধ্য থেকে স্পেশাল মেডিয়েটরদের একটি তালিকা প্রস্তুত করবে। সংস্থা সরকারের পূর্বানুমোদনক্রমে, ওই তালিকা থেকে প্রত্যেক লিগ্যাল এইড অফিসে মধ্যস্থতা কার্যক্রমের চাহিদা ও প্রয়োজনীয়তা বিবেচনায় প্রয়োজনীয় সংখ্যক স্পেশাল মেডিয়েটর নিয়োগ প্রদান করবে।’

‘আইনি সহায়তা মেলে যেখানে’

জেলা পর্যায়ে লিগ্যাল এইড অফিস স্থাপনের পাশাপাশি সরকার ‘সুপ্রিম কোর্ট লিগ্যাল এইড অফিস’ এবং ‘ঢাকা ও চট্টগ্রাম শ্রমিক আইনগত সহায়তা সেল’ প্রতিষ্ঠা করেছে। এ ছাড়া উপজেলা পর্যায়ে উপজেলা লিগ্যাল এইড কমিটি এবং ইউনিয়ন পর্যায়ে ইউনিয়ন লিগ্যাল এইড কমিটি গঠন করা হয়েছে। চৌকি আদালতে ও শ্রম আদালতে গঠিত হয়েছে বিশেষ কমিটি। এসব কমিটির সহযোগিতায় লিগ্যাল এইড অফিসগুলো আর্থিকভাবে অসচ্ছল, সহায়সম্বলহীন এবং নানাবিধ আর্থসামাজিক কারণে বিচার পেতে অসমর্থ বিচারপ্রার্থী ও শ্রমজীবী জনগণকে সরকারি খরচে আইনগত সহায়তা প্রদান করছে। লিগ্যাল এইড অফিস প্রদত্ত আইনগত সেবার মধ্যে রয়েছে : আইনগত পরামর্শ প্রদান; মামলা করার আগে বিরোধ নিষ্পত্তি করা (প্রি-কেইস মেডিয়েশন); চলমান মামলা রেফার করার ভিত্তিতে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি করা (পোস্ট কেইস মেডিয়েশন); বিনামূল্যে ওকালতনামা সরবরাহ; মামলা পরিচালনার জন্য আইনজীবী নিয়োগ; আইনজীবীর ফি পরিশোধ; মধ্যস্থতাকারী বা সালিশকারীর সম্মানী পরিশোধ; বিনামূল্যে রায় কিংবা আদেশের নকল সরবরাহ; ডিএনএ টেস্টের যাবতীয় ব্যয় পরিশোধ; ফৌজদারি মামলায় পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের ব্যয় পরিশোধ এবং মামলার সঙ্গে সম্পর্কিত সংশ্লিষ্ট প্রবিধানমালায় নির্ধারিত প্রাসঙ্গিক সব ব্যয় পরিশোধ।

সর্বশেষ নীতিমালা অনুযায়ী নির্ধারিত আয়কর সীমার নিম্নে বসবাসকারী যে কোনো ব্যক্তি, বীর মুক্তিযোদ্ধা বা যে কোনো শ্রমিক আইনি সহায়তা পাবেন। এ ছাড়া কর্মক্ষম নন, আংশিক কর্মক্ষম, কর্মহীন কোনো ব্যক্তি, বয়স্ক ভাতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি, ভিজিডি কার্ডধারী দুস্থ মা, পাচারের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত নারী ও শিশু, দুর্বৃত্ত দ্বারা অ্যাসিডদগ্ধ নারী ও শিশু, আদর্শ গ্রামে গৃহ বা ভূমি বরাদ্দপ্রাপ্ত ব্যক্তি, অসচ্ছল বিধবা এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সব ধরনের ফৌজদারি ও দেওয়ানি মামলায় আইনি সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে। প্রতিটি আদালত অঙ্গনে রয়েছে আইনি সহায়তা দেওয়ার কার্যক্রম। দেশের সর্বোচ্চ আদালত থেকে অধস্তন আদালত পর্যন্ত এই কার্যক্রম বিস্তৃত। দেশের কোনো নাগরিক যেন আইনি সহায়তা থেকে বঞ্চিত না হন, সে জন্য সরকার বিষয়টির ব্যাপক প্রচার ও তাৎপর্য তুলে ধরার জন্য প্রতি বছর ২৮ এপ্রিল জাতীয় আইনি সহায়তা দিবস পালন করে আসছে।